Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আকাশের বদলে নিয়তি যাকে নিয়ে এসেছে ২২ গজে…


২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ২০:০৪

মোসতাকিম হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

গল্পটা শুরু হতে পারে হারারের ফেব্রুয়ারির রোদেলা দুপুর থেকে। অনুশীলন করছিলেন একমনে, তখনো মাত্র প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটই খেলছেন। টি-টোয়েন্টির রঙিন চশমা পরার সৌভাগ্য হয়নি । সাউদার্ন রকস ফ্র্যাঞ্চাইজির একজন শ্যেন দৃষ্টি রাখছিলেন তার ওপর। খানিক পর এসে বললেন, পরের দিন নয়টায় আমাদের অনুশীলন। আসতে পারলে আমাদের টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা পেয়ে যাবে।

পরের দিন সকালে প্রার্থনা সেরে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে যান মাঠে। এরপর থেকে ক্রিকেট হয়ে গেল জীবনের শুধু নয়, জীবিকারও ধ্রুবতারা। সিকান্দার রাজার জীবনটাই আসলে এমন। আকাশে যার ওড়ার কথা, শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছেন যে ২২ গজে!

‘নিয়তি’ মুচকি হিসেবে এক কথায় উত্তর দিলেন রাজা। এই জিম্বাবুয়ের দলে এখন তিনি সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাদের একজন। গত বছর শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদের হারানোর ইতিহাসে রাজা পথ দেখিয়েছেন সামনে থেকে। ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছরের ‘মিডিওকার’ তকমা ঘুঁচিয়ে রাজা এখন জানান দিচ্ছেন, তিনি সত্যিকারের ম্যাচ উইনার হতে পারেন। ওয়ানডের ব্যাটিং গড় গত এক বছরে বেড়ে গেছে প্রায় দুই গুণ, এই বছরের শুরুটাও হয়েছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু ক্রিকেটেই আসার কথা ছিল না তার।

পাকিস্তানের শিয়ালকোটে যে জায়গায় তার জন্ম, ক্রিকেট সামগ্রীর জন্য সেটি বিখ্যাত। রাজা যখন সেখানে বেড়ে উঠেছেন, পাকিস্তান আচ্ছন্ন ইমরান-ওয়াসিম-ওয়াকারদের দ্যুতিতে। ৯২-এর সেই বিশ্বকাপ এখনো মনে পড়ে তার, জ্ঞান হওয়ার পর সেটাই তার প্রথম ম্যাচ দেখার স্মৃতি। অথচ কী অদ্ভুত কাকতাল, ইমরান-ওয়াসিমদের কেউই তার ছোটবেলার নায়ক ছিলেন না। নব্বইয়ের সেই সময়ে আরও অসংখ্য পাকিস্তানি কিশোর যেমন হতে চাইত ইমরানদের মতো, রাজার তেমন কিছুর স্বপ্ন ছিল না কখনোই!

বিজ্ঞাপন

বিস্ময়ের ধাক্কাটা আরও বেড়ে যায় রাজার পরের কথায়। ক্রিকেট ভালোবাসতেন বটে, তবে ২২ গজের বাঁধনে প্রাণ বাঁধার কোনো ইচ্ছা ছিল না তার। বরং ইচ্ছা ছিল উড়ে বেড়াবেন পাখির মতো, হবেন পাইলট। ১১ বছরের বয়সেই বাবা-মাকে জানিয়ে দিলেন, তিনি ফাইটার পাইলট হতে চান। বাবা-মাও অমত করলেন না, সবই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু নিয়তি অলক্ষ্যে থেকে মুচকি হাসবে, কে জানত?

পাইলট হওয়ার জন্য যতগুলো পরীক্ষা দরকার, তার সবই দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা জায়গায় আটকে গেলেন। চোখের একটা বিরল সমস্যা ধরা পড়ল তার, ডাক্তারি পরিভাষায় যেটিকে বলা হয় ‘বাইলেন্ট্রিক্যাল ওপাসিটি’। অনেক উঁচুতে উঠলে তাই চোখের কোণা দিয়ে ঠিকঠাক দেখতে পারতেন না তার দিকে কী আসছে। বিমানটা কত দূরে আছে সেটা হিসেব করতেও ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। পাইলট হওয়ার স্বপ্নে সেখানেই জলাঞ্জলি। রাজাকে তখনও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, চাইলে তিনি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু পাইলট হতে না পারলে আকাশের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কোনো ইচ্ছা ছিল না তার। বলে দিয়েছিলেন, পাইলট হতে না পারলে সেখানে আর থাকবেন না।

কিন্তু ক্রিকেট তখনো দৃশ্যপটে আসেনি। রাজা এরপর ঠিক করলেন, সফটওয়্যার প্রকৌশল নিয়ে পড়ালেখা করবেন। ভর্তি হলেন গ্লাসগোর ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে পড়ালেখা শেষও করলেন। এর মধ্যেই বাবা-মা পাকিস্তান ছেড়ে থিতু হয়েছেন জিম্বাবুয়েতে, রাজাও চলে গেছেন সেখানে। কে জানত, সেখানে নিয়তি অন্য কিছুর অপেক্ষায় রেখেছে তাকে?

জিম্বাবুয়েতেই হয় তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। তখনো পড়ালেখা শেষ হয়নি, ক্রিকেটটা খুব সিরিয়াসলি খেলতে শুরু করেন। কেটে গেল কয়েক বছর। এরপর টি-টোয়েন্টির ওই প্রস্তাব, রাজা যেটিকে বললেন নিয়তি। ক্রিকেটই হয়ে গেল তার ধ্যানজ্ঞান।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক অভিষেকের জন্য এরপর অবশ্য আরও অপেক্ষা করতে হয়েছে বছর তিনেক। শুরুতে পাথুরে চত্বরে হাঁটতে গিয়ে পা কেটে গিয়েছে অনেক বার, থিতু হতে সময় লেগেছে বেশ। এর মধ্যে স্পিনটা ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারছিলেন না। দুই সপ্তাহের জন্য উড়ে গিয়েছিলেন জন্মভূমি পাকিস্তানের ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। সেখানে পুরোটা সময় দিলেন স্পিনের জন্য। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছিল বেশ। ২২ গজে সেটার ফল পেয়েছেন দ্রুতই। বিপিএলে ৯৫ রানের একটা ইনিংস তো ছিলই, ত্রিদেশীয় সিরিজেও দেখিয়েছেন স্পিনের ভাষা এখন ভালোই পড়তে পারছেন। রাজার ভাষায়, ‘ওই সময় আমি যে পরিমাণ কষ্ট করেছি, এখন সেটারই ফল পাচ্ছি।’

কিন্তু এই গত বছর দেড়েকে নিজেকে এতোটা বদলে ফেলার রহস্যটা কী? রাজার উত্তর থেকে বোঝা গেল, চিন্তাভাবনা কতটা পরিণত, ‘আমার মনে হয় সময়ের সাথে সাথে আপনি আরও অভিজ্ঞ হবেন। যত বেশি অনুশীলন করবেন, দলের সঙ্গে থাকবেন ততই আপনি ঋদ্ধ হবেন। নিজের দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করবেন, প্রতিপক্ষ কীভাবে আপনাকে আউট করবে সেটা বোঝার চেষ্টা করবেন। এটা আপনার হাতেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করার ক্ষুধা আপনার থাকতেই হবে। এটাই আপনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। গত বছর দেড়েক আমি উন্নতি করেছি, এটা ভালো লাগার একটা ব্যাপার। তবে দেশের হয়ে আমি কতগুলো ম্যাচ জেতাতে পেরেছি, সেটাই বড় ব্যাপার।’

সম্পূরক প্রশ্নও এলো, বোমারু বিমান চালানো, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটে আলো ছড়ানো; এটা কি নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরেই সম্ভব হয়েছে? রাজা মানলেন, ছোটবেলা থেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। তবে এতকিছুর পর ক্রিকেটেই বসত গড়ার ব্যাখ্যা তার কাছে এরকম, ‘আমি পাইলট হতে চেয়েছি, পারিনি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম, তাও হয়নি। শেষ পর্যন্ত হয়েছি ক্রিকেটার। আমার মনে হয় ওপরওয়ালার আমাকে নিয়ে কোনো একটা পরিকল্পনা আছে। হ্যাঁ, পাইলট হওয়ার জন্য আমাকে যে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা আমাকে সাহায্য করতে পারে। আর একটা কথা, সব কাজেই চাপ আছে। আপনি পেশাদার হলে এটা থাকবেই। সেটা কীভাবে সামলাবেন সেটা আপনার। মনোবিদ ক্রিস্টোফার পিসের একটা কথা আছে না, চাপই চ্যাম্পিয়ন তৈরি করে, সেটাই ওদের সবচেয়ে বড় গর্ব।’

শুধু ক্রিকেটীয় সামর্থ্যে নয়, মননেও যে রাজা একটু আলাদা, শেষ কথাতেই তো তা বোঝা যায়!

সারাবাংলা/এএম/এমআরপি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর