এ যেন ইংল্যান্ড নয়, অভিবাসী স্কোয়াড
২১ মে ২০১৯ ১৯:৫১
ক্রিকেটের মঞ্চে নিজ দেশকেই সবার ওপরে দেখতে চায় দর্শকরা। আর আসরটি যদি হয় বিশ্বকাপের মতো বড় আসর, তবে একটি জাতির চোখের মনিতে পরিণত হয় মাঠের খেলোয়াড়রা। একটা ট্রফির দখলদারিত্বকে ঘীরে তীব্র জাতীয়তাবোধ কাজ করে ভক্ত-সমর্থকদের মধ্যে। কিন্তু ভাবা যায় একটি দলের অধিনায়ক সহ প্রায় অর্ধেক খেলোয়াড়ই প্রকৃতপক্ষে সেই দেশের না! আজ তেমনই একটি দলের কথা বলব।
দরজায় কড়া নাড়ছে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ। গত মাসে প্রাথমিক স্কোয়াড ঘোষণা করেছিল সব দল। এ মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত সময় ছিল চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণা করার। একে একে প্রায় সবগুলো দলই নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করছে। আজ স্বাগতিক ইংল্যান্ড ঘোষণা করল নিজেদের ১৫ সদস্যের চূড়ান্ত স্কোয়াড। মজার বিষয় হচ্ছে এই ১৫ সদস্যের ৭ জনই অভিবাসী।
১। ইয়ন মরগান: ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবে মরগান। অথচ তিনি ২০০৭ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্ম নেয়া মরগান এর আগে আয়ারল্যান্ড অনূর্ধ্ব ১৩, ১৫ ও ১৭ দলেও প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টে ইংল্যান্ড দলের ১২তম খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম নাম আসে মরগানের। তবে নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে দলে সুযোগ পেতে সময় লেগেছিল আরও দুই বছর। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড ব্যাটিং লাইন আপের আস্থায় পরিণত হন মরগান। ফলে ২০১৫ বিশ্বকাপের দুই মাস আগে ইংলিশ দলপতি হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়।
২। মঈন আলি: সম্প্রতি আইপিএলে দুর্দান্ত সময় কাটানো মঈন আলি ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের অন্যতম ভরসার নাম। ৩১ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের পূর্ব পুরুষের নিবাস পাকিস্তানের কাশমির প্রদেশে। তার দাদা পাকিস্তান ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়ে এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করেন। পাকিস্তানি বংশদ্ভুত হলেও জন্মসূত্রে তিনি ইংলিশ নাগরিক। ২০১৪ সালে প্রথম ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ হয় মঈনের। ব্যক্তি জীবনে প্রচণ্ড ধার্মিক এই মুসলিম ক্রিকেটার।
৩। আদিল রশিদ: মঈনের মতো আদিল রশিদের পরিবারও পাকিস্তানের কাশমির প্রদেশ থেকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ১৯৬৭ সালে। ৩১ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনার ৮৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১৩২ উইকেট। নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে রশিদের অভিষেক হয় ২০১৫ সালে। সতীর্থ মঈনের মতোই ব্যক্তি জীবনে ধর্ম-কর্মের চর্চা করেন রশিদ। রশিদের দুই ভাই ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে থাকেন।
৪। বেন স্টোকস: নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্ম নেয়া বেন স্টোকসের বাবা হলেন স্বনামধন্য রাগবি খেলোয়াড় জেরার্ড স্টোকস। তার বাবা ইংল্যান্ডের ওয়ার্কিং টাউন রাগবি ক্লাবের কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর খুব অল্প বয়সেই স্বপরিবারে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান বেন। ২৭ বছর বয়সী স্টোকস বিধ্বংসী ব্যাটিং ও কার্যকরী মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের জন্য পরিচিত। আইপিএলে সবথেকে দামি বিদেশি খেলোয়াড় ছিলেন স্টোকস। ২০১১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। তবে নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে দলে সুযোগ পেয়েছেন ২০১৩ অ্যাশেজ থেকে।
৫। জেসন রয়: ইংল্যান্ড দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনার জেসন রয়ের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। মাত্র ১০ বছর বয়সে স্বপরিবারে ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন। সারে ক্রিকেট ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১১ দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করার পর ২০১৪ সালে তিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান।
৬। টম কারান: দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া টমের তিন পুরুষ ক্রিকেটার। তার দাদা কেভিন কারান রোডেসিয়ার (বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছেন। তার বাবা কেভিন ম্যালুম কারান খেলেছেন জিম্বাবুয়ের জাতীয় দলের হয়ে। তার ভাই স্যাম কারানও ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দুইটি ম্যাচ। ২৪ বছর বয়সী টম ব্যাটিং ও বোলিং উভয়েই সমান পারদর্শী। জাতীয় দলের হয়ে ১৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ২৭ উইকেট এবং তার ব্যাটিং গড় ৪৪.৫।
৭। জোফরা আর্চার: ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ বারবাডোজে জন্ম নেয়া জোফরার বাবা একজন ইংলিশ। ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত তাকে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না। কারণ তিনি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে বসবাস করেননি। ফলে, নিয়ম অনুসারে বিকল্প পন্থায় ইংল্যান্ডে বসবাসের সাত বছর পূর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ২০২২ সালে তাকে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার অনুমতি দেয়া হবে বলে জানায় ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এ নিয়ম শিথিল করলে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান আর্চার। নীল জার্সি গায়ে মাত্র দুইটি এক দিনের ম্যাচ ও একটি টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। তবে এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন তিনি। সম্প্রতি আইপিএলে রাজাস্থানের হয়ে দারুণ বোলিং করার জন্যই হয়তো নজর কেড়েছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের।
রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের কথা মনে আছে? ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফ্রান্স। অথচ ফ্রান্সের জাতীয় দলটি সাজানো হয়েছিল অভিবাসীদের দিয়ে। চূড়ান্ত স্কোয়াডের ২৩ জনের মধ্যে ১৬ জনই ছিলেন অভিবাসী। বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের এ দলটিকে নিয়ে আসর শুরুর আগেও সমালোচনা করেছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। তৃতীয় হওয়া বেলজিয়ামের ১১ জন আর চতুর্থ হওয়া ইংল্যান্ডের ৬ জন ফুটবলার ছিলেন অভিবাসী। তাহলে কী ক্রিকেট বিশ্বকাপেও ঘটতে পারে এমন ঘটনা? এবারের ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ইংল্যান্ডকে ধরা হচ্ছে ফেভারিট। অভিবাসীদের নিয়ে ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর দলটি কী নিজেদের ঘরেই রেখে দেবে বিশ্বকাপের শিরোপা?
সারাবাংলা/টিএম৬/এমআরপি