Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

টপ অর্ডারেই স্বাচ্ছন্দ্য মাশরাফির


১১ জুন ২০১৯ ১৪:০৪

২৩ নভেম্বর ২০০১। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে টস জিতে জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশকে। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক আগে হলেও এই ম্যাচে অভিষেক হয় বাংলাদেশের এমন এক ক্রিকেটারের যার হাত ধরে শুরু হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিনবদলের। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৪৮.৪ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ১৫৬ রান। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে দলের ব্যাটিং লাইনআপে তখন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, স্টুয়ার্ট কার্লাইল, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারদের মতো বিশ্বক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানরা।

বিজ্ঞাপন

জয়ের জন্য ১৫৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নামেন জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার গ্রান্ট ফ্লাওয়ার এবং ট্রেভর গ্রিপার। বাংলাদেশের পক্ষে বোলিং করতে নামেন ৬ ফুট উচ্চতার নতুন এক বোলার। প্রথম বলেই বোলিং করতে হলো গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের বিপক্ষে। প্রথম ৪ বলই ছিল অফস্ট্যাম্পের পাশ দিয়ে যাওয়া। ৫ম এবং ৬ষ্ঠ বল ডিফেন্স করেন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। জীবনের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের প্রথম ওভারই মেডেন।

নিজের দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে যখন এলেন তখনও ব্যাটিংয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে আধুনিক ক্রিকেটের টেকনিক্যালি কেতাদুরস্ত ব্যাটসম্যান সেই গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। বোলার এলেন এবং করলেন তার প্রথম বল। অফস্ট্যাম্পে থাকা বল ব্যাটসম্যানের প্যাডের পাশ দিয়ে চলে গেলো উইকেট কিপারের কাছে। দ্বিতীয় বলেও গ্রান্ট ফ্লাওয়ার বল ছেড়ে দিলেন। তৃতীয় বলে গ্রান্ট ফ্লাওয়ার আর পারলেন না। বোলারের পেস এবং স্যুইং এর কাছে হার মানলেন। বলের আঘাত উপড়ে ফেলে মিডল স্ট্যাম্প। বাংলাদেশের কোনো পেসার এত দ্রুতগতিতে বল করছে এবং মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলছে এমন দৃশ্য তখন গ্রান্ট ফ্লাওয়ারদের কাছে অচেনা। আর সেই বোলারের যে ৯টা বল খেললেন সেগুলো প্রতিটাতেই তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন সেই বোলারের কথাই। সেই ওভারের পরের তিনটি বল মোকাবিলা করেন স্টুয়ার্ট কার্লাইল। দুইটা বলে ডিফেন্স করেন এবং একটি ছেড়ে দেন। প্রতিটা বলের লেংথ ও লাইন ছিল অসাধারণ। ফলশ্রুতিতে সেই ওভারটি হয় উইকেট মেডেন ওভার।

সেই বোলারের নিজের করা তৃতীয় ওভারে জিম্বাবুয়ে ২ রান স্কোর বোর্ডে যোগ করতে পারলেও চতুর্থ ওভারের দ্বিতীয় বলেই জিম্বাবুয়ের আরেক ওপেনার ট্রেভর গ্রিপারকে রান আউট করতে ভূমিকা রাখেন সেই বোলার। বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ৪ ওভার ৩ মেডেন ২ রান ১ উইকেট। পঞ্চম ওভারের পঞ্চম বলে আউট করেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে। গালি অঞ্চলে ক্যাচ নেন ফাহিম মুনতাসির। বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ৫ ওভারে ৩ রানের খরচায় ২ উইকেট। ৩টি মেডেন ওভার। ক্রেইগ উইশার্টের ৭৮ রানে বাংলাদেশকে জিম্বাবুয়ে সেই ম্যাচে ৫ উইকেটে হারায়। কিন্তু হারলেও এই ম্যাচটিই জানান দেয় বাংলাদেশের ওয়ানডে ফরম্যাটেও এক দুরন্ত গতির বোলারের আগমনী বার্তা। বিশ্ব ক্রিকেটে রাওয়াল পিন্ডি এক্সপ্রেস বা এমন কিছু দুরন্ত গতির বোলারের মতো বাংলাদেশেরও নড়াইল এক্সপ্রেসের আগমনী বার্তা।

বিজ্ঞাপন

নড়াইল এক্সপ্রেস হিসেবে পরিচিত মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের কথাই বলছিলাম। যাকে অনেকে কৌশিক নামেও ডাকতেন। সময়ের পালাবদলের সেদিনের সেই নড়াইল এক্সপ্রেসই এখন বাংলাদেশের টাইগারদের ‘দ্য লিডার’ নামে বিশ্বে পরিচিত।

ক্যারিয়ারের শুরুটা দুর্দান্ত হলেও খুব অল্প সময়েই নড়াইল এক্সপ্রেসকে হার মানতে হয় ইনজুরির কাছে। অস্ত্রোপাচারও হয় আটবার। চিকিৎসকরা খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধই করেছিলেন একপ্রকার। কিন্তু তাতেও দমে যাননি মাশরাফি। এগিয়ে গেছেন নতুন উদ্যমে।

২০১৯ এর ৮ জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে ২১২তম ওয়ানডে খেলেন মাশরাফি। সেই ম্যাচে তিনি বেয়ারেস্টাকে আউট করেন। এটি ছিল মাশরাফির ক্যারিয়ারের ২৬৬তম উইকেট। এই সময়ে মাশরাফি বোলিং করেছেন ১৭৫৯.১ ওভার। রান দিয়েছেন ৮৫৩৭। উইকেট গড় হিসেব করলে সংখ্যাটি হবে ৩২.০৯। ওভারপ্রতি রানগড় হিসেব করলে যে সংখ্যাটি হয় ৪.৮৫। বলে রাখা ভালো, এই ২১২টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে আছে এশিয়া একাদশের হয়ে মাশরাফির খেলা ২টি ম্যাচও। ২০০৭ সালে ব্যাঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আফ্রিকা একাদশের বিপক্ষে দুইটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে এশিয়া একাদশ। দুই ম্যাচে ১৫.৫ ওভারে ১ মেডেন ওভার সহ ১০৮ রান দিয়ে মাশরাফি নেন শন পোলকের উইকেট।

মাশরাফির প্রাপ্ত উইকেট বিবেচনা করলে দেখা যায় টপ অর্ডারের উইকেটই সবচাইতে বেশি পেয়েছেন। ২৬৬টি উইকেটের মধ্যে ১২৯ উইকেট পেয়েছেন টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের আউট করে। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের উইকেট পেয়েছেন ৯৩টি এবং লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের উইকেট পেয়েছে ৪৪ বার।


ক্যারিয়ার সেরা বোলিং কেনিয়ার বিপক্ষে, ১০ ওভারে ২৬ রান এর বিনিময়ে ৬ উইকেট। এই দলটির বিপক্ষে ৭ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি। সর্বোচ্চ ৪২ ম্যাচ খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ৩৫৪.৩ ওভার বল করে ১৪১৬ রানের বিনিময়ে নিয়েছে ৬৩ উইকেট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছেন ২২ ম্যাচ। ১৮৪.৫ ওভারে ৯৬৬ রান দিয়ে নিয়েছেন ২৬ উইকেট। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২১ ম্যাচ খেলে ১৬২ ওভার বোলিং করে ৮৮৪ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। ভারতের বিপক্ষে ১৯ ম্যাচে ১৬২.১ ওভারে ৮১৬ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ২৩ উইকেট। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৮ ম্যাচে ১৪১ ওভার বোলিং করে ৭৮৭ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ২০ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও খেলেছেন ১৮টি ম্যাচ। ১৬০ ওভার বোলিং করে ৭৫৩ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ৩০ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৫ ম্যাচে ১১৯.১ ওভারে ৬৩০ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ ম্যাচে ১২৪.৩ ওভার বোলিং করে ৬২৪ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১২ ম্যাচে ৯১.৫ ওভারে ৫২৮ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ৬ উইকেট। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মাশরাফি খেলেছেন ৮ ম্যাচ। ৬৫.৩ ওভারে ৯ উইকেট নিয়েছেন ২৫২ রানের বিনিময়ে।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে ৫৩ ওভার বোলিং করে ২৩৭ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ৯ উইকেট। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ খেলে ২৭ ওভারে ১৪৮ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ৫ উইকেট। কানাডার বিপক্ষে ২ ম্যাচে ১৭ ওভার বোলিং করে ৮০ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। বারমুডার বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপের একমাত্র ম্যাচে ৪ ওভার বোলিং করে ৮ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। আরব আমিরাতের বিপক্ষে একমাত্র ম্যাচে ৭ ওভারে ৪৬ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ১ উইকেট। নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা একমাত্র ম্যাচে ৬ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি মাশরাফি।

মাশরাফির ২৬৬ উইকেটের মাঝে সবচাইতে বেশি ১০ বার আউট করেছেন জিম্বাবুয়ের হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে। সর্বমোট ১০ বার আউট করেছেন এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে। জিম্বাবুয়ের এল্টন চিগুম্বুরাকে ৬ বার এবং শ্রীলঙ্কার উপল থারাঙ্গা ও জিম্বাবুয়ের প্রসপার উতসায়েকে আউট করেছেন ৫ বার করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শাই হোপ, ক্রিস গেইল এবং জিম্বাবুয়ের সিকন্দার রাজা, টাডেন্টা টাইবু, ভুসি সিবান্দা, চিবাবাকে আউট করেছেন ৪ বার করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভিন লুইস, লেন্ডন সিমন্স, জেসন হোল্ডার, ভারতের বিরেন্দার সেওয়াগ, মহেন্দ্র সিং ধোনি, শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়সুরিয়া, পাকিস্তানের মিসবাহ-উল-হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, নিউজিল্যান্ডের কলিন মুনরোকে আউট করেছেন ৩ বার করে। এছাড়াও ভারতের শচীন টেন্ডুলকার, গৌতম গাম্ভীর, দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবস, অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং, মাইকেল বেভান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কায়রন পোলার্ড, পাকিস্তানের ইনজামাম উল হকদের মতো টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের উইকেটও আছে মাশরাফির শিকারের তালিকায়।

মাশরাফির শিকার করা ২৬৬ উইকেটের মাঝে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করেছেন ৫৪ বার, এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেছেন ৩৯ বার। ১১৮ বার ক্যাচ আউট এবং ৫২ বার কট বিহাইন্ড আউট করেছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে। এছাড়াও জিম্বাবুয়ের পিয়েট রিংকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেছেন। স্ট্যাম্পিংটি করেন খালেদ মাসুদ মাইলট। আর স্কটল্যান্ডের ওয়াটসন হিট উইকেট আউট হয়েছেন মাশরাফির বলে।

এভাবেই ইনজুরি আক্রান্ত ক্যারিয়ারে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা মাশরাফির। সেই দুরন্ত গতির বল এখন তিনি করতে পারেন না। অবশ্য এটার জন্যে নিজেকে কিছুটা দুর্ভাগাও ভাবতে পারেন তিনি। এমন এক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফির আবির্ভাব, যখন একজন জেনুইন পেস বোলারের জন্য হাহাকার বাংলাদেশের। আর সেই থেকে ছুটে চলা বিরামহীন। অল্প বয়সে একজন দ্রুতগতির বোলারের যে পরিমান যত্ন দরকার তার সিকিভাগও পাননি মাশরাফি। যখনই ফিট তখনই দলের হয়ে খেলতে হয়েছে। আর সেখান থেকেই একের পর এক ইনজুরি। নিউজিল্যান্ডের শেন বন্ড তো এমন ইনজুরির আঘাত সইতে না পেরে খেলা থেকে অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ছুটে চলছেন মাশরাফি। ইনজুরিতে পড়ে পায়ে অপারেশনের এখন আর কোনো জায়গা বাকি নেই, তবুও তিনি মাঠে ফিরে চেষ্টা করে যান নিজের সর্বোচ্চটা উজার করে দিতে। খেলার শুরুতেই চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষের মূল্যবান উইকেট শিকার করে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতে। আর এ কারণে বলাই যায় মাশরাফি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন প্রতিপক্ষের টপ অর্ডারের উইকেট শিকার করতেই।


বাংলাদেশের দর্শকরা বিশ্বকাপের সব ম্যাচ অনলাইনে কোনো ধরনের সাবস্ক্রিপশন ফি বা চার্জ ছাড়াই দেখতে পারবেন র‍্যাবিটহোলের ওয়েবসাইট www.rabbitholebd.com-এ। এছাড়া র‍্যাবিটহোলের অ্যাপেও দেখা যাবে প্রতিটি ম্যাচ। অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা ডাউনলোড করতে পারবেন https://goo.gl/UNCWS2 (শুধুমাত্র বাংলাদেশ) এই লিংকে ক্লিক করে। তাছাড়া আইওএস ব্যবহারকারীরা ডাউনলোড করতে পারবেন https://goo.gl/vJjyyL (শুধুমাত্র বাংলাদেশ) এই লিংকে ক্লিক করে।

সারাবাংলা/এসবি/এমআরপি

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ টাইগার নড়াইল এক্সপ্রেস বিশ্বকাপ স্পেশাল মাশরাফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর