নটিংহ্যামের ক্রিকেট লাইব্রেরি ও পিটার ওয়েইন থমাসের গল্প
২১ জুন ২০১৯ ১৭:৫২
বেশ বড় একটি কামরা। ভেতরে আলো আধারি খেলা করছে। ঠিক তার মাঝখানে ৮৫ বছর বয়সী এক শেতাঙ্গ বৃদ্ধ চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে কী যেন পড়ছেন। দরজায় নক করতেই মনোযোগ ভাঙে তার। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলে বললেন, ‘ও কেন নয়? এসো’। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে যাই। শুধু বই আর বই! সামনে, পেছনে, ডানে, বায়ে, এমনকি উপরেও। এ যেন বইয়ের সমুদ্র। নিমেষেই বইয়ের রাজ্যে নিজেকে অতি নগন্য মনে হলো। এখানে বইয়ের সাম্রাজ্য। বইই রাজা।
চেয়ারে বসে মাথার উপরের দিকে সেলফে তাকাইতেই অসংখ্য বইয়ের মাঝেও অতি পুরনো দুটি ব্যাটে চোখ আটকে গেলো। ব্যাটদুটোর মাঝখানে তিনটি উইকেট। তারও উপরে বেশ কিছু অ্যান্টিক শিল্ডস। একই তাকের সবচেয়ে নিচে বেলস বসানো দুটি স্ট্যাম্প, বল। এবার দেখলাম, বইতো শুধু নয়, পুরো কক্ষ জুড়েই আরও নানা জায়গায় এমন সব অ্যান্টিক শিল্ডস আর ক্রিকেট আইটেম। শিল্ডগুলোর কোনটি ছোট, কোনটি বড়। আর কক্ষের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ক্রিকেট গ্রেটদের ছবি।
এটি একটি দোতলা ঘর। একতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পাওয়া গেলো অসংখ্য পুরোনো ছবির সমাহার আর বই, জার্নাল। ক্রিকেট প্রেমীরা শিহরিত হবেন নিশ্চিত। কারণ এসব প্রকাশনার প্রতিটিই আপনাকে নিয়ে যাবে ক্রিকেট যুগের অনেক অতীতে।
এবার দেখা বন্ধ করে ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিতির পালা। নাম পিটার ওয়েইন থমাস। আরে বাইরে তো তার নামটাই দেখে এসেছি। ‘দ্য ওয়েইন থমাস লাইব্রেরি’। তাহলে তিনিই এই কর্ণধার। নটিংহ্যাম ট্রেন্টব্রিজ স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের ঠিক পাশেই গড়ে তুলেছেন এই লাইব্রেরি। ও ভাল কথা, একটু পরেই জানতে পেলাম এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিকেটে লাইব্রেরি। মি. পিটার ওয়েইন থমাসের সেটাই দাবি। তার ভাষ্যে, সবচাইতে বড় লাইব্রেরিটি ইংল্যান্ডে, লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে।
এমন নয় যে খুব হামবড়া করে কথাটি জানালেন তিনি। অশিতিপর বৃদ্ধের চোখে মুখে আচরণে বিনয়েরই প্রকাশ ছিলো সারাক্ষণ। কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। এত বই দেখে সংখ্যাটি জানতে চেয়েছিলাম। ব্যাস, অমনি গড়গড় বলা শুরু করে দিলেন, ‘এখানে ১৭ হাজার বই আছে। এর ৯৫.৫ ভাগ ক্রিকেট নিয়ে। বাকি ৫ ভাগ অন্যান্য খেলাধুলা নিয়ে। ক্রিকেট নিয়ে যারা গবেষণা করে তারাই মূলতঃ এখানে আসে। আসে ক্রিকেটপ্রেমীরাও। প্রতি সপ্তাহে স্কুল শিক্ষার্থীরা এসে এখানে বসে পড়ে। যখন দেখি ওরা ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা করে কী যে ভাল লাগে! এটা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট লাইব্রেরি। সবচাইতে বড়টি লর্ডসে।’
কথা শেষ না হতেই জানতে চাইলাম, ‘লাইব্রেরিতে উল্লেখযোগ্য কী কী বই আছে? এবার একটু যেনো সিরিয়াস দেখা গেলো বুড়োকে। হয়তো ক্রিকেটের সকল উল্লেখযোগ্য বইই তার এখানে রয়েছে। তো প্রশ্নের অবকাশ কোথায়। তবে একই বিনয় উপহার দিয়ে বললেন, ‘উইজডেনের (ক্রিকেট বার্ষিকী। যা ক্রিকেটর বাইবেল নামে খ্যাত) শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো সংখ্যা প্রকাশ হয়েছে এর সব আছে।’ বিষ্ময়ে বলে উঠি ১৫৫ বছরের প্রতিটি সংস্করণ! গর্বমাখা এক চিলতে হাসি ঠোঁটে খেলে যায় বুড়োর।
বলে রাখছি ১৮৬৪ সাল থেকে ক্রিকেটের বীরত্বগাঁথা নিয়ে প্রতিবছর একটি করে সংখ্যা প্রকাশ করে আসছে উইজডেন। যেখানে লেখকের তালিকায় বিশ্বের নামি দামি ক্রিকেটারদেরই কেবল জায়গা হয়।
আর কী আছে? জানতে চাইলে বলেন, ‘একটু বস।’ চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলেন পাশের কক্ষে। শেলফ থেকে বড় একটি লগ বই এনে দেখিয়ে বললেন, এটা স্কোর বই। এর মধ্যে তুমি ১৮শ শতকের নটিংহ্যাম কাউন্টি ক্রিকেটের প্রতিটি ম্যাচের স্কোর পাবে।’ উৎসুক চোখে তাকাই সত্যিই! হ্যাঁ, তাইতো। ১৮৬৪ সালে নটিংহ্যাম কাউন্টি গ্রাউন্ডে কেন্টের বিপক্ষে ম্যাচের স্কোর কার্ড এখনো নতুনের আভা ছাড়াচ্ছে।
এরপর আরেকটি বই তুলে দিয়ে বললেন দেখো, ‘এটি ১৭৭১ সালে প্রকাশিত একটি বই। যেখানে নটিংহ্যাম ক্রিকেটের আদ্যপান্ত লেখা পাবে।’ নিচ তলায় সংরক্ষিত মহামূল্যবান বইগুলো দেখিয়ে নিয়ে যান ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলেন, ‘আমার লাইব্রেরিতে বিশ্বের সব দেশের ক্রিকেট নিয়ে লেখা বই আছে।’ একটু থেমে বলেন, ‘ও দাঁড়াও তোমার বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে লেখা বই দেখাচ্ছি। বলে শেলফে খুঁজতে শুরু করে দিলেন। কিন্তু পাচ্ছিলেন না। বৃদ্ধ মানুষ, কষ্ট হচ্ছে ভেবে বলি। ঠিক আছে। দেখাতে হবে না।’ ‘ও থ্যাংকস’ বলে নিচে নামতে শুরু করলেন।
আমিও নামছি। নামতে নামতে ব্যাট ও উইকেটগুলো দেখিয়ে বলি, লাইব্রেরিতে ব্যাট ও স্ট্যাম্প কেন? প্রশ্ন শুনে অবাক হননি। বরং মনে হল এমন প্রশ্নের জন্য উনি প্রস্তুত ছিলেন। একটি পুরোনো ব্যাট দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে ব্যাটটা দেখতে পাচ্ছ এটা দিয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান খেলতেন।’
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! সে তো অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট কিংবদন্তী। তার ব্যাট তোমরা কেন সংরক্ষণ করছ? প্রত্তুরে বলেন, ‘১৯৩৮ সালে এই মাঠে তিনি এই ব্যাট দিয়েই তিনি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওই সালটি ছিল ট্রেন্ট ব্রিজের শততম প্রতিষ্টা বার্ষিকী। তার সেঞ্চুরির পর এই লাইব্রেরি তৎকালীন ইনচার্জ ব্যাটটি সংরক্ষণ করে।’
আর পাশের ব্যাটটি? ‘ওটা জো হার্ট স্টাফের। জো লম্বা সময় নটিংহ্যাম ও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছে।’ শেলফের একেবারে নিচে দুটি উইকেট দেখিয়ে বলি, এদুটো কতটা পুরোনো? প্রশ্ন ছুঁড়তেই ফিরে যান ১৭৪৪ সালে। এটা ক্রিকেটের প্রথম উইকেট। তখন দুই স্ট্যাম্প দিয়ে খেলা হত। সেটা আমরা সংরক্ষণ করেছি।’
ব্যাট, স্ট্যাম্প নিয়ে বিষ্ময়কর তথ্য শোনা শেষ হতেই পেছনে ফিরে দেখি ইংলিশ কিংবদন্তী ডব্লিউ.জি গ্রেসের ছবি। আবেগপ্রবন হই, ‘ওয়াও গ্রেস!’ পিটার বলেন, ‘হ্যাঁ, গ্রেস। ১৮৭৪ সালে ওর প্রথম কাউন্টি সেঞ্চুরিটি এই মাঠেই হয়েছিল। তাই ছবিটি বাধিয়ে রেখে দিয়েছি।’
এটা তো শুধুই লাইব্রেরি নয়, একটি জাদুঘরও! পিটারের উত্তর,‘বলতে পার।’ বলেই কক্ষের চেয়ারগুলো দেখিয়ে বললেন, এই চেয়ারগুলোর বয়স কত জান? আমি বলি ‘না’। তিনি বললেন, ‘১০০ বছর। আজ থেকে একশ বছর আগে ট্রেন্ট ব্রিজ ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যসরা এই চেয়ারে বসে খেলা দেখতেন। এখন আর দেখে না। তাই আমার এখানে দিয়ে দিয়েছে। একেকটিরর দাম ১০০ পাউন্ড হবে… বলেই হো হো করে হেসে দিলেন।’
এক পর্যায়ে চোখ চলে যায় টেবিলের ওপরে রাখা পত্রিকার দিকে। কত আগের এগুলো? বুড়ো জানালেন এগুলো এই ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ের। কিছু কিছু ১৮ শতকেরও আছে। পড়ে দেখতে পার।’ মুহুর্তেই কথা পাল্টে বললেন, ‘না এখন না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। অন্য কোন সময় এসো, দুজন গল্প করব।
ধন্যবাদ দিয়ে বলি, ‘ক্রিকেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরিতে এসে আমি ধন্য এবং মুগ্ধ। আমাকে মূল্যবান সময় দেওয়ার জন তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
উনি বললেন, ‘তোমাকেও ধন্যবাদ।’
সারবাংলা/এমআরএফ/এমএম
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ ক্রিকেট লাইব্রেরি নটিংহ্যাম বিশ্বকাপ স্পেশাল