প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বকাপেও ছিল সমালোচনার ছোঁয়া
১৬ জুলাই ২০১৯ ১৭:০২
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ হয়ে গেল ইতিহাসের সর্বাধিক প্রচারিত এবং প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বকাপ। ৪৬ দিন ব্যাপী এই আসরের মূল পর্বের ৪৮টি ম্যাচ তো বটেই, সাথে প্রথমবারের মতো ১০টি প্রস্তুতি ম্যাচও সরাসরি সম্প্রচার করেছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি।
এই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে ব্যবহৃত হয় কমপক্ষে ৩২টি ক্যামেরা। যার মধ্যে ছিল ৮টি আল্ট্রা মোশন ‘হক আই ক্যামেরা’ যা দিয়ে বলের সম্ভাব্য গতিবিধি নির্ণয় করা হয়। উইকেটের সামনে এবং পেছন দিকের ছবি নেয়ার জন্য স্টাম্পের সামনে এবং পেছনে দুইটি করে ক্যামেরা ছিল। সাথে ছিল স্পাইডার ক্যামেরা, যা তারের মাধ্যমে বিচরণ করতে দেখা যায় মাঠের চারদিক।
দর্শকদের জন্য চমক হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ছিল ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও রিপ্লের ব্যবস্থা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পিয়েরোর সাহায্যে একাধিক ক্যামেরার ভিডিও একসাথে করে ৩৬০ ডিগ্রি রিপ্লে দেখানো হয়। যা জটিল মুহূর্তগুলোকে বিশ্লেষণে সহযোগিতা করেছে।
ইংল্যান্ড আর ওয়েলসের মাঠগুলো আকাশ ও ভূপৃষ্ঠ থেকে টিভির পর্দায় দেখানোর জন্যও ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। ড্রোন ক্যাম এর মাধ্যমে আকাশ থেকে গোটা স্টেডিয়ামগুলো দেখানো হয়, আর বাগি ক্যাম দিয়ে তোলা হয় গ্রাউন্ডভিউ। এছাড়া স্পোর্টস গ্রাফিক্স বিশেষজ্ঞ অ্যালস্টন এলিওট একটি নতুন গ্রাফিক্স প্যাকেজ তৈরি করেন এবারের বিশ্বকাপ সম্প্রচার উপলক্ষে। যার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্কোর এবং পরিসংখ্যান খেলা চলাকালীন সময়ে তুলে ধরা হয়েছে টিভির পর্দায়। যা ক্রিকেট ভক্তদের কাছে এবারের বিশ্বকাপকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
আইসিসি টিভি মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়েও বিষয়বস্তু তৈরি করে তাদের সম্প্রচার অংশীদারদের সরবরাহ করেছে। এই বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল প্রতিদিনের প্লেয়ার প্রোফাইল, টিম ফিচার, ম্যাচ প্রিভিউ, ভেন্যু ফিচারসহ মাঠের বাইরের আরও অনেক তথ্য।
বিশ্বকাপকে প্রাণবন্ত করে তুলতে শুধু আইসিসি পদক্ষেপ নিয়েছিল তা নয়, খেলোয়াড়দের ফিটনেসের দিকটা খেয়াল রাখতে দলগুলো যুক্ত করেছে নতুন জিপিএস প্রযুক্তি। প্লেয়ার লোড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নামক এই প্রযুক্তি এর আগে ব্যবহার করেছে বিশ্বের নামি দামি ফুটবল ক্লাবগুলো। তবে ক্রিকেটে ভারতই প্রথম এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আসে। খেলোয়াড়দের ফিটনেস সেরা অবস্থায় রাখতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছে।
এই প্রযুক্তির সাহায্যে ১০০ ধরনের শারীরিক ক্ষমতা যেমন গতি, দূরত্ব, কাজের পরিমাণ ইত্যাদি মাপা হয়। এই যন্ত্র হতে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান কাজে লাগানোর মাধ্যমে খেলোয়াড়দের ওপর বাড়তি চাপ কমানোতে কমে আসে ইনজুরির আশঙ্কাও। তারপরও ভারতীয় ওপেনার শিখর ধাওয়ান, অলরাউন্ডার বিজয় শঙ্কররা ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান বিশ্বকাপ আসর চলাকালীন।
ভারতের এই বিশেষ প্রযুক্তিটি ছিল একটি জার্সির মতো, যার কাঁধের কাছে হাই রেজুল্যুশন চিপ বসানো থাকে। এই পোশাকটি ক্রিকেটারদের শরীরে পরানোর পর জিপিএসের সাহায্যে তাদের শারীরিক হালচাল নির্ণয় করা হয়। বিশ্বকাপ খেলতে নামার আগে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক স্ট্যাটস্পোর্টস এর কাছ থেকে এই বিশেষ প্রাযুক্তিক সুবিধা নেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় বিসিসিআই। বিশ্বের শীর্ষ এই স্পোর্টস টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানটি ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং পর্তুগালের মতো ফুটবল দলগুলোকেও সাহায্য করেছিল।
এদিকে, দ্বাদশ বিশ্বকাপে স্টাম্পে যে ‘এলইডি বেইলস’ ব্যবহৃত হয়, সেটি অ্যাডিলেডের জিংস টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এই বেইলসের নাম জিং বেইলস। মিচেল স্টার্কের ১৪০ কিলো মিটারের বেশি গতির বল স্টাম্পে লেগেও যখন সেই জিং বেইলস পড়ে না তখন এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। চলতি বিশ্বকাপে বেশ কয়েকবার বল স্টাম্পে আঘাত করার পরও জিং বেইলস পরেনি।
বিশ্বকাপ চলাকালীন এই জিং বেইলস নিয়ে সমালোচনা করেছেন ভারতের দলপতি বিরাট কোহলি, অস্ট্রেলিয়ার দলপতি অ্যারন ফিঞ্চ, ইংল্যান্ডের সাবেক দলপতি নাসের হুসেইন, পাকিস্তানের গতি স্টার শোয়েব আখতারের মতো বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা।
এদিকে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি এমন সমালোচনার মুখেও জানায়, জিং বেইলসে কোনো সমস্যা নেই। আর এমন মেগা ইভেন্টের মাঝে বেইলস পাল্টানো সম্ভব নয় বলেও গো ধরে বসে থাকে আইসিসি। বিশ্বকাপের স্ট্যান্ডার্ড প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী মাঝপথে প্রযুক্তি বদলের কোনো সুযোগ নেই বলে জানায় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তাই শেষ অবধি জিং বেইলস ছিল।
ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ভারতীয় পেসার জাসপ্রিত বুমরাহর বল অজি ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের স্টাম্পে লাগলেও বেইলস মাটিতে পড়েনি। তার আগে ইংল্যান্ডের স্পিনার আদিল রশিদের একটি ডেলিভারি দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার কুইন্টন ডি ককের স্টাম্পে লেগেছিল। শ্রীলঙ্কা-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে স্টাম্পে বল লাগলেও জীবন পেয়েছিলেন লঙ্কান দলপতি দিমুথ করুনারত্নে, বোলার ছিলেন কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট। অজি পেসার মিচেল স্টার্কের বলে বেঁচে যান ক্রিস গেইল। আর ইংলিশ পেসার বেন স্টোকসের বলে জীবন পান বাংলাদেশের সাইফউদ্দিন।
আগে স্টাম্পের উপরে কাঠের তৈরি বেইলস ব্যবহার করা হতো। বিশ্বকাপে যে জিং বেইলস ব্যবহার করা হয় সেটি ছিল মূলত প্লাস্টিকের তৈরি আর সেটি কাঠের চেয়েও ছিল হালকা। এই বেইলসের সঙ্গে ছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। স্টাম্পে বল আঘাত করলেই বেইলসের এলইডি লাইট জ্বলে উঠবে। অথচ হালকা আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া থাকার পরও এবারের জিং বেইলস নিয়ে সমালোচনার কমতি ছিল না। এমন ঘটনায় টুইটারে সাবেক ক্রিকেটাররাও সমালোচনায় মেতে উঠেছিলেন।
সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন জানিয়েছিলেন, ‘এমন সুযোগে ব্যাট করাটা দারুণ। যখন আপনি বোল্ড হবেন না।’ ভারতের অধিনায়ক কোহলি জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন ভুল কোনোভাবেই আশা করা যায় না। আমি মনে করি প্রযুক্তির ব্যবহার দারুণ। স্টাম্পের সাথে কিছুর আঘাত লাগলেই বেইলসের লাইট জ্বলে উঠার কথা। কিন্তু, পেসার বা মিডিয়াম পেসারদের বল স্টাম্পে আঘাত করলেও তেমনটি হচ্ছে না। উইকেটের পেছনে থাকা ধোনি ভাই স্টাম্পের গর্ত ভালোভাবেই চেক করেছেন। সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমরা জানিনা এমন কেন হয়েছে। আমি কখনোই এরকম ঘটনা বারবার ঘটতে দেখিনি। এটা কোনো দলই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে না।’
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ বলেছিলেন, ‘একটা সময় ব্যাপারটা অনিরপেক্ষ ছিল। আমি জানি ওয়ার্নারের স্টাম্পে বল খুব জোরে আঘাত করলেও বেইলস পড়েনি। যেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল কিংবা ফাইনালে এরকমটা দেখলে আপনি কখনো মানতে পারবেন না, যখন আপনি এত কঠিন পরিশ্রমে বল করেও ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পারেন না।’ পাকিস্তানের সাবেক স্পিডস্টার শোয়েব আখতার লিখেছিলেন, ‘বিশ্বকাপের এক আসরে এতোবার বল স্টাম্পে লেগেও বেইলস পড়েনি। কি হচ্ছে এগুলো। আমার পুরো ক্যারিয়ারেও এমন ঘটনা পাঁচবার দেখিনি। এবার ১০ দিনেই সেটা ঘটেছে।’
সারাবাংলা/এমআরপি