দেশের ফুটবলে চলছে ‘সালসা-বটিকা চিকিৎসা’
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:০২
ঢাকা: ‘যখন ব্যথা তখন চিকিৎসা’— এই পদ্ধতিতে চলছে দেশের ফুটবল চিকিৎসা। সাময়িক সংকট উত্তরণে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিচ্ছে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ অভিভাবক। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে দেশের ভবিষ্যৎ ফুটবল পড়তে পারে মহা সংকটে। দেশের ঘরোয়া ফুটবল ব্যবস্থাসহ আন্তর্জাতিক ফুটবলে ধেয়ে আসতে পারে প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুর্যোগ সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে খোদ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফের অপরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের ভবিষ্যৎ ফুটবল।
বাফুফের প্রত্যেক নির্বাচনে ইশতেহারে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও আদৌতে তার পরিকল্পনার ছাপ মিলেনি এত বছরেও। নির্দিষ্ট করে বলা যায় জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে। মাঝে ভুটান বিপর্যয়ের সময় প্রায় দু’বছর তো নির্বাসনেই ছিল দেশের আন্তর্জাতিক ফুটবল। এর আগের ও পরে সবমিলিয়ে পাঁচ বছরের বাফুফের কার্যক্রম বলছে, জাতীয় দল নিয়ে সেভাবে কােনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই ফেডারেশনের।
গত পাঁচ বছরে জাতীয় দলের প্রস্তুতির জন্য বিদেশ ট্যুর বাবদ খরচ করতে হয়েছে প্রায় ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা। যেখানে এই টাকায় খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক মানের আবাসনসহ উন্নত জিমনেশিয়ামের ব্যবস্থা ফেডারেশন করতে পারত বলে মনে করেন ফেডারেশনেরই কোনো কোনো কর্মকর্তা। তারা বলছেন, সেই সুযোগ-সুবিধাগুলো দেশের মাটিতে নিশ্চিত না করতে পারায় প্রস্তুতি নিতে ফুটবলারদের অন্য দেশে দ্বারস্থ হতে হয়।
দেশে প্রস্তুতির সুযোগ-সুবিধা নেই বলেই কাতার-থাইল্যান্ডে প্রস্তুতি নিতে অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় বলে জানান জাতীয় দলের প্রধান কোচ জেমি ডে। এই ইংলিশ কোচের কথায় আক্ষেপের সুর, ‘কোনো দেশই আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রস্তুতি বাইরের দেশে নিতে চায় না। কারণ সব দেশেই ফুটবল ফ্যাসিলিটিগুলো নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে সেই ফ্যাসিলিটিগুলো থাকলে অন্য দেশে যাওয়ার কথা হয়তো ভাবতে হতো না।’
সারাবাংলার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে জাতীয় দলের প্রস্তুতির জন্য কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, তাজিকিস্তান, হংকংয়ে পাঠানো হয়েছে এমিলি-জামাল ভূঁইয়াদের। বিশ্বকাপ প্রস্তুতি বা এশিয়ান গেমস চ্যালেঞ্জের প্রস্তুতি নিতে ফুটবলারদের পাঠানো হয়েছে এসব দেশে। তাতে মোটা অঙ্কের টাকাই খোসাতে হয়েছে বাফুফেকে। প্রতি বিদেশ ট্যুরে প্রায় ১৫-২০ লাখ খরচ করতে হয়েছে ফেডারেশনকে।
পরিকল্পনার ছাপ থাকলে সুযোগ-সুবিধাগুলো দেশেই নিশ্চিত করা যেত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বাফুফেতে দেড় যুগের ওপর কাজ করা এক শীর্ষ কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইশতেহারে অনেক কিছুই থাকে। সেটা রাজনীতির মঞ্চের মতোই। কখনও বাস্তবায়ন হয় না। খেলোয়াড়দের আবাসনসহ একটা জিমনেশিয়াম তৈরি করতে বহুবার বলা হয়েছে সভাপতিকে (কাজী সালাউদ্দীন)। কিন্তু টাকার অভাব বলে বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই।’
যার ফলে স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও একটা জিমনেশিয়াম তৈরি করতে পারেনি বাফুফে। গত বাফুফে নির্বাচনেও জিম নির্মাণের আশ্বাস দেওয়া হলেও আরেকটি নির্বাচন আসন্ন এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। বড় কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট এলেই খেলোয়াড়দের দ্বারস্থ হতে হয় প্রাইভেট কোনো জিমনেশিয়ামের। সেই আক্ষেপটাও সাবেক বাফুফে কর্মকর্তার কণ্ঠে, ‘ফুটবলারদের সবসময় জিমে সময় বের করতে হয়। ফিট থাকতে হয়। অফ সময়ও ঘাম ঝরাতে হয়। কিন্তু এতদিনও সেটা নির্মাণ করা হয়নি। যদিও একটা জিম তৈরি করার জায়গা পড়ে আছে বাফুফে ভবনে। টাকা নেই এই অজুহাতে জিম নির্মাণ করা হয়নি।’
বাফুফের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবেই পিছিয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ এই কর্মকর্তার। এ বিষয়ে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের আঙুল যেন ক্লাব ফুটবলের দিকেই, ‘ফ্যাসিলিটি তো অবশ্যই নিশ্চিত করা উচিত। আমরা একটা জিম করব। আমরা টিমকে একটা ভালো জায়গায় রাখি। এক মাস আগে আমাদের খাবারের মেন্যু দিয়ে দেওয়া হয়। দেশে যতই ফ্যাসিলিটি থাকুক, আমার ফোন কল আসবে— আমার ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি থাকবে। আমি একটু চিন্তা করব রুটিন লাইফের বাইরে আমি একটু আড্ডা দেই। কিন্তু ওখানে গেলে হয় কী, সবসময় ফুটবলের মধ্যে থাকে ফুটবলাররা। ১০-১৫ দিন ফুটবলে পূর্ণ মনোযোগ রাখা।’
শুধু জাতীয় দল নয় দেশের ঘরোয়া ফুটবলেও কার্যত পেশাদারিত্বের ছাপ কম। বেশিরভাগ সময় ক্যালেন্ডার চূড়ান্ত নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। দফায় দফায় পেছাতে হয় লিগ। পাইপলাইন তৈরির মঞ্চ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ও পাইওনিয়ার লিগের আয়োজন নিয়ে প্রায়ই খেয়ালিপনা লক্ষ করা গেছে। ক্যারিয়ার শঙ্কায় পড়তে হয়েছে অসংখ্য খেলোয়াড়কে।
‘শুধু যখন ব্যথা তখন চিকিৎসা’ নীতিতে চলছে ফেডারেশন। কিছু দায় ক্লাবগুলোর ওপরেও বর্তায়। দেশের ক্লাবগুলোর পেশাদারিত্বও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। এর মাঝেও কয়েকটি ক্লাবের মধ্যে সম্প্রতি দুই একবছরে উন্নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্লাবের উন্নয়ন ছাড়া দেশের ফুটবল উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন সোহাগ। তিনি বলেন. ‘একটা ক্লাবের মাঠ থাকবে, জিমনেশিয়াম থাকবে, গোলকিপার কোচ থাকবে। বয়সভিত্তিক দল থাকবে। এভাবেই তো একটা সময় ভালো জায়গায় যাবে দেশের ফুটবল।’
বেশিরভাগ ক্লাব বা বাফুফে কারোরই সে অর্থে পেশাদারিত্ব বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। অবশ্য সম্প্রতি জিমের বরাদ্দ চেয়ে ফিফার কাছে আবেদন করেছে ফেডারেশন। সোহাগ জানান, ‘আমরা ফিফার কাছে জিমের অর্থ বরাদ্দ বাবদ আবেদন করেছি। ফিফা-এএফসি’র কিছু কর্মকর্তা এই বছরের শেষের দিকে যেকোনো সময় আসবে। পর্যবেক্ষণ করবে। ফান্ড আসলেই আমরা কাজ শুরু করে দেবো।’
এই তো আবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। তার প্রস্তুতি নিতে আবারও তাজিকিস্তানের দুশানবেতে বাংলাদেশ জাতীয় দল। যাওয়ার আগে কোচ জেমির কথাগুলো যেন দেশের ফুটবল অদূরদর্শিতাকেই আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, এ দেশে ফুটবল উন্নয়ন হবে যখন ফুটবলারদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে। সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা যাবে। সেগুলো কী হবে?