ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক মাশরাফি
৫ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৩
মাশরাফি বিন মুর্ত্তজা। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার অন্যতম নায়কও তিনি। যার নেতৃত্বেই টাইগাররা শিখেছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কখন হুঙ্কার ছুড়তে হয়। শিখেছে কিভাবে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে খেলতে হয়, চোখ রাঙাতে হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের চেঞ্জমেকারের নাম মাশরাফি, যিনি দলকে এক সুঁতোয় গেথে রাখার কাজটা ভালোভাবেই করতে পেরেছেন। তার নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লাল-সবুজের সফল একজন অধিনায়ক তিনি। মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম স্পিড স্টার, হয়তো তিনিই প্রথম কোনো পেসার যিনি পেস বোলিংয়ে স্ট্যান্ডার্ড বা ক্রেজ তৈরি করেছিলেন।
আজ ৫ অক্টোবর, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক, নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফির জন্মদিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনেই সবুজ শ্যামল নড়াইল শহরের মহিষখোলায় নানাবাড়িতে তিনি মায়ের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে এসেছিলেন। পেরিয়ে গেছে ৩৬টি বছর। টাইগারদের সফল এই অধিনায়ক ৩৭ বছরে পা দিয়েছেন। ২০১৪ সালের এই দিনেই পৃথিবীতে এসেছে মাশরাফি-সুমনা হক সুমির দ্বিতীয় সন্তান, পুত্র সাহেল মুর্ত্তজা। সারাবাংলা.নেটের পক্ষ থেকে মাশরাফি ও তার ছেলেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
বাবার নাম গোলাম মুর্ত্তজা স্বপন। মায়ের নাম হামিদা বেগম বলাকা। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাশরাফি বড়। ছোট ভাই সিজার মাহমুদও ক্রিকেট নিয়েই সময় কাটান। মাশরাফি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়ই শুধু নয়, মানুষও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মাশরাফি। তার উপর আস্থা রেখেই ম্যাশের জন্মস্থান নড়াইল থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়াইয়ের সুযোগ করে দেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মাশরাফি।
মাশরাফি নামটাই যেন একটা আলাদা অনুভূতি, আবেগের জায়গা। তার খুব কাছের মানুষও বোধহয় আশা করেন না প্রতি ম্যাচেই তিনি ৫ উইকেট নেবেন, প্রতি ম্যাচেই ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি করবেন। তারপরও কিন্তু মাশরাফিকে মাঠে নামতে দেখে গ্যালারির দর্শক আলাদা কোনো উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন, দাঁড়িয়ে পড়েন, হাততালি দেন। এটা প্রমাণ করে ম্যাশের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটার এমন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কখনো পেয়েছেন কিনা জানা নেই। এমনও ম্যাচ দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব, যেখানে মাশরাফি বল ধরলেই হাততালি বেজে ওঠে, টিভি স্ক্রিনের ক্যামেরা তাকে ধরলেই হাততালি বেজে ওঠে আবার ব্যাটের কানায় লাগিয়ে একটা সিঙ্গেল রান নিলেও মনের অজান্তে হাতজোড়া এক হয়। এমনও ম্যাচ হয়েছে যেখানে মাশরাফি কিছুই করেননি, শুধু মাঠে থেকেছেন জন্যই হাততালি বেজে উঠেছে। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা শিহরণ জেগে উঠে।
ক্রিকেটার মাশরাফির অধিনায়কত্বে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটে অবশ্য মাশরাফির অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে । সাফল্যের পথ কখনো মসৃণ, কখনো ছিল বন্ধুর। বেশ কয়েকবার ইনজুরির কারণে তাকে ছিটকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু অনমনীয় অদম্য শক্তিতে ফিরে এসেছেন প্রতিবারই। চোটের কারণে ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। মিরপুরের একাডেমি মাঠে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন। নিরবে কেঁদেছিলেন ম্যাশ ভক্তরা। কিন্তু তার চার বছর পর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বেই অসাধারণ সাফল্যে আনন্দে কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশের মানুষ। সবশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও ম্যাশের নেতৃত্বে খেলতে গিয়েছিল টাইগাররা। শুধু বিশ্বকাপে সাফল্য নয়, ম্যাশের নেতৃত্বে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোকে হারিয়েছে টাইগাররা। টি-টোয়েন্টিতেও তার হাত ধরেই এসেছে বহু সাফল্য। যদিও মাশরাফি এই ফরম্যাটে অবসর নিয়েছেন।
মাশরাফি নামে পরিচিত নড়াইলের সেই দুরন্ত কিশোরটি ছোটবেলা থেকে কৌশিক নামেই এলাকার সবার কাছে পরিচিত। ক্রিকেটটাকে এক মুহূর্তের জন্যও দূরে ঠেলে দিতে হয়নি তাকে। নড়াইলের চিত্রা নদীতে সাঁতরে বেড়ানো সেই দুরন্ত কিশোর কৌশিক এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আইকন। সময়ের সাথে মাশরাফির নাম ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার পেছনের কারিগর এই মাশরাফি। বীরদর্পে সামনে এগিয়ে গেছেন দলকে নিয়ে। নিজে যেমন সফল হয়েছেন, অন্যদেরও সফলতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও টাইগার ক্যাপ্টেন উজ্জীবিত করেছেন সতীর্থদের, এই জাতিকে সম্মানিত করেছেন, মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন বহুবার। মাঠে নিজেকে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। চোখে চোখ রেখে প্রতিপক্ষকে কড়া জবাব দিতে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ভিন্ন এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি।
গতিময় বোলিং দিয়ে অনূর্ধ-১৯ দলে থাকতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের নজর কেড়েছিলেন, তিনি সে সময় অস্থায়ী বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন। রবার্টসের পরামর্শে মাশরাফিকে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেই মাশরাফি জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর টেস্ট ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয়। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাদা পোশাকে খেলতে নামেন তিনি। দেশের হয়ে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার ছিলেন, যিনি কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ না খেলেই টেস্টে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেটি মাশরাফির প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ ছিল। ম্যাশ এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ৩১তম খেলোয়াড় এবং ১৮৯৯ সালের পর তৃতীয়। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৩২ ওভার বল করে ১০৬ রান দিয়ে তুলে নেন চারটি উইকেট। জিম্বাবুয়ের সাবেক কিংবদন্তি গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার ছিলেন তার প্রথম শিকার। আর দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং আসার আগেই ম্যাচটি ড্র হয়। ২০০৯ সালে সবশেষ টেস্ট খেলেছেন কিংসটনে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ৩৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে তিনি নিয়েছেন ৭৮ উইকেট।
২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাশরাফির। সেই ম্যাচে ৮.২ ওভার বল করে ২৬ রান খরচায় তুলে নেন দুটি উইকেট। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ২১৭ ওয়ানডে খেলে ম্যাশ নিয়েছেন ২৬৬ উইকেট। ২০০৬ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিরুদ্ধে ২৬ রানে ৬ উইকেট তার সেরা সাফল্য। ৫৪ টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ারে তিনি নিয়েছেন ৪২ উইকেট। ২০০৬ সালে এক পঞ্জিকাবর্ষে মাশরাফি ছিলেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বের সর্বাধিক উইকেট শিকারি বোলার। তিনি ওই বছর নিয়েছিলেন ৪৯ উইকেট।
২০০৯ সালের শুরুতে অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের সহকারী ছিলেন মাশরাফি। পরবর্তীতে ওই বছরেরই জুন মাসে তিনি আশরাফুলের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পান সাকিব আল হাসান। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচেই হাঁটুতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল মাশরাফিকে। সেই চোটের কারণে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠের বাইরে ছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করেন সাকিব আল হাসান। ২০১৪ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজে মাশরাফি পুনরায় অধিনায়কত্ব পান।
শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও এক অনুকরণীয় ব্যক্তি ম্যাশ। পেয়েছেন কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। মাশরাফির মতো একজন অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক হয়তো সহজেই পাওয়া যাবে না। কয়েক প্যারাগ্রাফ লিখেও হয়তো মাশরাফিকে প্রকাশ করা যাবে না। যখন ক্রিকেটে এসেছিলেন তখন থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন লাল-সবুজের জার্সিতে নুয়ে পড়ার জন্য আসেননি। ক্রিকেটের টানে, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার টানে এতোবার ডাক্তারের ছুরির নিচে গিয়েও যে আবার মাঠে ফিরেছেন, পা হারানোর ঝুঁকি নিয়ে খেলেছেন, বিশ্বের আর কোনো ক্রিকেটার বোধহয় এমনটা করেননি। নিষিদ্ধ ঘোষিত আইসিএল আর বাজিকরদের থেকে কাড়ি কাড়ি টাকার লোভ যিনি এক নিমিষেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাজারো ক্রিকেট ভক্তের ভালোবাসা নিয়ে, হাজারো তরুণ ক্রিকেটারের অনুপ্রেরণা হয়ে শত বছর বেঁচে থাকুক আমাদের মাশরাফি।