Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদায় হে অধিনায়ক


৫ মার্চ ২০২০ ১৭:৫৫

সিলেট থেকে: গুঞ্জনটি আগেই উঠেছিল, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চলতি ওয়ানডে সিরিজটিই হতে যাচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি মুর্ত্তজার শেষ। কিন্তু প্রথম ওয়ানডে শেষে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সিলেটে এসে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে যখন আবার মনে করিয়ে দিলেন ‘মাশরাফির মত অধিনায়ক হয় না। আর সাকিবের মত পারফর্মার হয় না। এই সময় আপনাদের উচিত ওর পাশে থাকা। আপনারা ওকে একটু বেশিই খোঁচান।’

সেই হিসেবে সংশ্লিষ্ট অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এখানেই নয়, হয়ত আরো কিছু সময় লাল সবুজের ব্যাটন হাতে দেখা যাবে মাশারাফিকে। তাছাড়া গেল কয়েকদিন সিলেটে এমন কোন খবরও চাউর হয়নি। টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকমন্ডলী কিংবা তার সতীর্থদের মুখ থেকেও তার ‘শেষ’ শব্দটি নিঃসৃত হয়নি। বলা নেই কওয়া নেই সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে অপ্রিয় ঘোষণাটি দিয়ে দিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিন বদলের এই মহানায়ক।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সম্মেলন কক্ষে এসে অধিনায়কের চেয়ারের বসে একটু দম নিলেন। এরপর কাঁপা কাঁপা স্বরে মাশরাফি বললেন, ‘ধন্যবাদ সবাইকে। আমি আপনাদের ‍উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই। অধিনায়ক হিসেবে কালই আমার শেষ ম্যাচ। দীর্ঘসময় আমার ‍ওপর আস্থা রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ আমার নেতৃত্বে যত ক্রিকেটার খেলেছে বাংলাদেশ দলে। আমি নিশ্চিত এই প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না। ৫-৬ বছর যে যাত্রা ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাই টিম ম্যানেজমেন্টে যারা ছিল, যাদের অধীনে আমি খেলেছি, অধিনায়কত্ব করেছি, সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে। আমার শেষ অধিনায়কত্ব শুরু হয়েছিল হাথুরুসিংহেকে দিয়ে। তার আগেও হয়েছিল কিন্তু ইনজুরির কারণে করতে পারিনি। হেড কোচ হাথুরুসিংহের সঙ্গে খালেদ মাহমুদ সুজন, স্টিভ রোডস এবং ডমিঙ্গকে দিয়ে শেষ হচ্ছে। নির্বাচক এবং বোর্ডেরর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যেসব স্টাফ আছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমি ধন্যবাদ জানাই মিডিয়ায় আপনারা যারা আছেন সবাই সহযোগিতা করেছেন। সবশেষে অবশ্যই সমর্থকদের। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হতো না। আমি মাশরাফি বিন মু্র্ত্তজা অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাচ্ছি। আগামি কাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে আমার শেষ ম্যাচ। খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব সেরাটা দেওয়ার। এবং আমার শুভকামনা থাকবে পরবর্তী অধিনায়কের জন্য।

বিজ্ঞাপন

সিলেটে স্টেডিয়ামের সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের তখন রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একে অপরের দিকে চাওয়াচায়ি করছেন। আবার কিয়ৎক্ষণের জন্য আবেগ ভুলে গিয়ে সম্বিত ফিরে পেয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের সামলাতে মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামের ঘাম ছুটে যাওয়ার দশা। টানা ৩৭ মিনিট চলল প্রশ্নোত্তর পর্ব। শেষ করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন সংবাদমাধ্যম কর্মীরা ছুটে গেলেন সেলফি তুলতে। তাদের সেই আবদারও মেটালেন ম্যাশ। সেলফি পর্ব শেষে মাঠের ডান দিক ধরে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেলেন ড্রেসিংরুমের দিকে।

তার এই চলে যাওয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হলো একটি অধ্যায়ের। অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি বিন মুর্ত্তজার শেষ সংবাদ সম্মেলন। আর কোনো দিন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সদা হাসিখুশিতে ভরা এই মুখটি দেখা যাবে না। সংবাদ সম্মেলন আর কোনো দিন কৌতুক করে কিছু বলবেন না বলবেন না নড়াইল এক্সপ্রেস। শুক্রবারের (৬ মার্চ) ম্যাচটির পর অধিনায়ক হিসেবে আর তাকে দেখা যাবে না। উন্নত শিরে সতীর্থদের দিক নির্দেশনা দেবন না, জিতে গেলে সব কৃতিত্ব ভাগ করে দেবেন না, কিংবা হেরে গেলে সব দায় একা মাথা পেতে নেবেন না। কিংবদন্তী অধিনায়কের শেষ দেখতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

২০১৪ সালের কথা, বছরটা মোটেও ভালো যাচ্ছিল না বাংলাদেশের। টানা হারে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল মুশফিক অ্যান্ড কোং। ঠিক তখন মুশফিকের কাছ থেকে ব্যাটন খুলে নিয়ে ওয়ানডে ও টি টোয়েন্টির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল মাশরাফির কাঁধে। তৃতীয় দফায় অধিনায়কত্বের ব্যাটন তুলে নিলেন মাশরাফি। ব্যাটন হাতে নিয়েই দলকে এনে দিলেন ইউ টার্ন। একের পর এক অভাবনীয় সাফল্য ধরা দিতে লাগল বাংলাদেশ দলে। নভেম্বরে জিম্বাবুয়ে হোয়াটওয়াশ হল ৫-০ তে।

পরের বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড বিশ্বকাপে গিয়ে তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে খেললো বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফিরেও আরো ধারালো টিম মাশরাফি অ্যান্ড কোং। এপ্রিলে আসলো পাকিস্তান প্রথমবারের মত ৩-০ তে হোয়াটওয়াশ হল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটের যে কোনো ফরম্যাটেই যে দলটির বিপক্ষে টাইগাররা পেরে উঠেনি! মাশরাফির নিপুণ নেতৃত্বে তারাই হল হোয়াইটওয়াশ! মে মাসে খেলতে আসা পরাশক্তি ভারত ও জুলাইয়ে আসা সব সময়ের শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকেও একই ব্যবধানে হারিয়ে পুরো ক্রিকেটর বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন মাশরাফি। অবাক বিস্ময়ে মাশরফি কারিশমা দেখলো বিশ্ব।

২০১৬ সালে ঘরের মাঠে আয়োজিত এশিয়া কাপে নেতা হিসেবে দলকে ফাইনালে তুললেন। ২০১৭ সালে প্রথমবারে মত বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনালে। এরপর হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে টি টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন। জনশ্রুতি আছে, সিদ্ধান্তটি মাশরাফি নেননি। হেড কোচ হাথুরুসিংহে তাকে নিতে বাধ্য করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার নেতৃত্বে ৮৭ ম্যাচের ৪৯টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। যা তাকে দিয়েছে দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়কের মুকুট।

তার ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়ার প্রশ্নই উঠত না, যদি না ২০১৯ বিশ্বকাপে বল হাতে অতটা ম্লান না থাকতেন। ২২ গজের বিশ্বযুদ্ধে ৮ ম্যাচে তার উইকেট ছিল মাত্র ১টি। এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। সংবাদ মাধ্যমগুলো হেড লাইন করতে লাগল- ‘অধিনায়ক কোটায় খেলেন মাশরাফি’ / প্রিয় মাশরাফি, এখন নয় তো আর কখন?’ এমন কত শত হেড লাইন! বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সংবাদ সম্মেলনে এলেই তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে – অধিনায়ত্ব কবে ছাড়ছেন?

মাশরাফি এমনিতেই আমুদে মানুষ। মানুষের কল্যানই যার একমাত্র ব্রত সেই মানুষটিকে যখন ক্রমাগত এমন প্রশ্ন করে যাওয়া হল, তখন হয়ত তিনি নিজেই ভেবে নিয়েছেন, আর নয়। দেশের ক্রিকেটের স্বার্থেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত। অবেশেষে তাই করলেন ম্যাশ। জিম্বাবুয়ে সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে জানিয়ে দিলেন আগামি কালের ম্যাচটিই তার শেষ!

আর এরমধ্য দিয়েই শেষ হতে যাচ্ছে লাল সবুজের ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফির অধ্যায়।

বিদায় হে অধিনায়ক! যতদিন এদেশ থাকবে, এদেশের ক্রিকেট থাকবে আপনার কীর্তিগুলো লাল সবুজের আকাশের তারা হয়েই জ্বলবে।

অধিনায়ক বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাশরাফি বিন মুর্ত্তজা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর