‘কোচ মাঠে খেলে দেবে না, খেলোয়াড়দেরই মাঠে প্রমাণ করতে হবে’
৪ এপ্রিল ২০২০ ২৩:১৭
ঢাকা: মরণব্যাধী করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্বই স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশেও এর ছোবলের দরুণ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে সকল ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বন্ধ। এমন থমথমে অবস্থায় দেশের ক্রীড়াবিদদের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে সারাবাংলা ডটনেট।
আজকের আয়োজনে আছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের অধিনায়ক ও জাতীয় দলের গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা। তিনি অতীতে মোহামেডান, চট্টগ্রাম আবাহনী, সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের গোলরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় দলের গোল পোস্টের নিচে ২৩টি ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করা মানিকগঞ্জের ৩১ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক সারাবাংলাকে জানালেন করোনাক্রান্তিতে তার অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও দলের পরিকল্পনার কথা।
সারাবাংলা: কোয়ারেনটাইন সময় কেমন কাটছে?
রানা: পরিবারকে সময় দিচ্ছি। বাচ্চাদের সময় দিচ্ছি। বিয়ের পরে স্ত্রী-সন্তানদের সেভাবে সময় দিতে পারতাম না। এখন তাদের সময় দিচ্ছি। সহযোগিতা করছি। ছেলে রোবায়েত হাসিব আর মেয়ে রায়াকে সময় দিতে পারছি।
সারাবাংলা: ঘরোয়া লিগ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও বন্ধ। ফিটনেস নিয়ে কীভাবে কাজ করছেন?
রানা: ঘরে ফিটনেসের কাজ করছি। ঘরের ভেতরে যত ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম আছে করছি। ওয়েট ট্রেনিং করছি। বাসায় ডাম্বেল-টাম্বেল আছে সেগুলো কাজে লাগাচ্ছি।
সারাবাংলা: ফিটনেস তো আছেই। সঙ্গে গোলরক্ষকদের নিশ্চয়ই আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে?
রানা: গোলরক্ষকদের বলের সঙ্গে কাজ করতে হয়। বাসার ভেতরে গোলরক্ষকদের বলের সঙ্গে রিলেশন রাখার জন্য কাজ করতে হয়। প্রায় ৪০-৫০ মিনিট সেশন করি। কোর কিছু ব্যায়াম করি ১০ মিনিট। অ্যাপসের কিছু কিছু ব্যায়াম, কিছু ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম, ওয়েটের কিছু কাজ করছি।
সারাবাংলা: ফিটনেস নিয়ে ক্লাব আর জাতীয় দলের কোচ জেমি ডে কীভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন?
রানা: ক্লাবের কোচরা নির্দেশনা দিচ্ছেন। জেমি ডেও নির্দেশনা দিচ্ছেন। খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে আমাদের। জেমি নিজেই খুলেছেন। জেমি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জেমি বিশেষভাবে কোনো খেলোয়াড়কে কোনো নির্দেশনা দেয় নাই। তবে ঘরে থেকে কীভাবে ফিটনেস ধরে রাখা যায় সেসব ভিডিও দিচ্ছেন। আর খাবারের ব্যাপারে একটা নির্দেশনা আছে। দু’বছর থেকে যেভাবে খাবার বা খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি সেভাবেই মেনে চলতে বলেছেন।
সারাবাংলা: ঘরে থেকে সেভাবে পরিশ্রম করে শতভাগ ফিট থাকা কঠিন। সেখানে ওজন একটা ফ্যাক্টর হতে পারে কিনা?
রানা: বিশেষভাবে ওজন নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন জেমি। কোনোভাবেই যেন ওজন না বাড়ে সেই বিষয়টা খেয়াল রাখতে বলেছেন। যে ওজন নিয়ে ক্যাম্প ছেড়েছি সেটা যাতে ধরে রাখতে পারি। যেটা আসলে গ্রুপ ওয়ার্ক করলে যেভাবে ইম্প্রুভ হয় আমার ব্যক্তিগতভাবে ফিটনেসর কাজটা সেভাবে করা কঠিন।
সারাবাংলা: ক্লাব থেকে কীভাবে সহায়তা পাচ্ছেন…
রানা: শেখ রাসেল ক্লাবের যে গোলরক্ষক কোচ (কেনিয়ার আব্দুল ঈদী সেলিম) ক্লাবের প্রাঙ্গনে গিয়ে তিনি আমাকে আসরের নামাজের পরে ৪০-৪৫ মিনিট অনুশীলন করাতেন। কয়দিন ধরে সরকারের নির্দেশনার কারণে যাওয়া হচ্ছে না।
সারাবাংলা: গত বছর শেখ রাসেল তিনে থেকে লিগ শেষ করেছিল। এবার প্রথম ছয় ম্যাচে ৫ পয়েন্ট টেবিলের দশে অবস্থান করছে। যেখানে ২০১১-১২ সেশনে শেখ রাসেলের ট্রেবল পাওয়ার রেকর্ড আছে। সেই হিসেবে দলের এবারের পারফরম্যান্স কি প্রত্যাশিত?
রানা: গতবছরের তুলনায় হিসেব করলে আসলে অপ্রত্যাশিত ফল করেছি আমরা। গত লিগে আমাদের দলে চার-পাঁচজন জাতীয় দলের ফুটবলার ছিল। অন্যান্য ঘরোয়া ফুটবলাররাও ভালো ছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ফাইট দিয়েছি আমরা। বিপলু-সোহেল-বিশ্বনাথরা চলে গেছে। তাদের ব্যাকআপ হিসেবে যারা এসেছে তারা ওদের জায়গাটা পূরণ করতে পেরেছে কি না সেটা একটা প্রশ্নের বিষয়। ওদের ব্যাকআপ প্লেয়ার যারা আসছে তাদের মধ্যে হেমন্ত, তকলিস, বাবলু, আশরাফুল এসেছে। কিন্তু ওদের জায়গা থেকে শতভাগ দিতে পারতো আর দলের সমন্বয় যদি ভালো হতো তাহলে এরকম অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট হতো না।
সারাবাংলা: কোন জায়গায় সবচেয়ে বড় ঘাটতি মনে হয়েছে আপনার? অধিনায়ক হিসেবে যদি বিশ্লেষণ করেন…
রানা: গত বছর যেমন ধরেন রাফায়েল লিগের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিল। এবার ছয় ম্যাচে মাত্র দু’টি গোল করেছে সে। দল হিসেবে গোল করেছি মাত্র চারটি। তাহলে বোঝায় যায় গোলস্কোরিংয়ে আমরা কেমন ভুগছি।
সারাবাংলা: আপনি গত বছরের সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন লিগের। এবার প্রথম ছয় ম্যাচেই গোল হজম করতে হয়েছে সাতটি। এটা কী দলের পারফরম্যান্সের কারণে?
রানা: দলের ব্যাকআপ প্লেয়ারের মান নিয়ে চিন্তা করতে হবে আমাদের। সাপোর্ট দিতে পারছিনা। ছয় ম্যাচে গোল রিসিভ করেছি সাতটা। আমার ক্যারিয়ারে প্রথম লেগে কখনই এতোগুলো গোল রিসিভ করি নাই। গত লিগেও প্রথম লেগে গোল রিসিভ করেছি দুটা। আমি ডিফেন্ডারদের বলি তোমরা যদি ভালো করতে না পারো তাহলে গোলরক্ষকদের জন্য চ্যালেঞ্জ বেশি হয়। আমি হয়তো দুই একটা বড় সেভ দিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু পুরো দল খারাপ করলে গোলরক্ষকদের একার কিছু করার থাকে না। কিন্তু মানুষ বলবে দেশের এক নম্বর গোলরক্ষক প্রতিদিনই গোল খায়! বিশ্বের সকল গোলরক্ষকের টাফ হবে যদি দলের সমন্বয় খারাপ থাকে।
সারাবাংলা: দলবদলেও তো বলা হয়েছিল ব্যালেন্সড দল হয়েছে। সে হিসেবে খুব খারাপ দল হয়েছে কি?
রানা: নামের হিসেবে যদি ধরেন খুব খারাপ না। এখানে যারা আসছে তারা কিন্তু গত লিগে পারফরম্যান্স করে আসছে। হেমন্ত-তকলিস জাতীয় দলের হয়ে খেলে আসছে। খালেকুজ্জামান গত লিগে ৯০ পার্সেন্ট ম্যাচ খেলে আসছে। নোফেল থেকে আশরাফুল অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলে খেলেছে মাত্র। নামের হিসেবে অবদানটা সেভাবে পাওয়া গেছে কি? নামের হিসেবে সেভাবে পারফরম্যান্স আসেনি বলেই লিগে বেশ বাজে অবস্থানে আমরা।
সারাবাংলা: তাহলে কি বলা যায়, রক্ষণ, মাঝমাঠ কার্যত অকার্যকর ছিলো বলেই এমন পারফরম্যান্স?
রানা: মিডফিল্ড যারা খেলেন তারা চেইন হিসেবে কাজ করে। তারা ডিফেন্সেও ভালো সহায়তা করে। এবার ডিফেন্সের ভুলেই অনেক গোল খেয়েছি। মাঝমাঠেও তেমন সক্রীয় ছিলাম না। বিপলুর কথাই ধরেন। গত লিগে ওর ওয়ার্ক রেট ওর ক্যারিয়ারের বেস্ট ছিল। আর সোহেলের কথাই ধরুন, সে অসাধারণ খেলেছে বা রক্ষণে বিশ্বনাথ ছিল দুর্দান্ত। তাদের জায়গাটা কি ফিলাপ হয়েছে? না আসলে হয়নি। আর তাতেই এমন হয়েছে।
সারাবাংলা: দেশি খেলোয়াড়দের পাশাপাশি এবার দলের বিদেশি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও কি সেভাবে সন্তোষজনক?
রানা: বিশেষ করে বিদেশি খেলোয়াড়রা বড় অবদান রাখে দলে। সব টিমেই চারটা করে খেলতেছে। যে দলগুলো বিদেশি ফুটবলার ভালো করতেছে সেই দলই বেশি ভালো পারফরম্যান্স করছে। ডিফেন্সে এলিসন উদোকা গত চার সেশনে যেভাবে খেলেছে এবার তেমন দেখা যায়নি। শেখ রাসেলের বিদেশি প্লেয়াররা কিন্তু কোনো দলের তুলনায় কম বেতন পায় না। বরংচ কিছু দলের তুলনায় বেশিই পায়। সেখানে তেমন ফল কি পাওয়া যাচ্ছে এবার? এখনো মৌসুমের শুরু থেকে সেটা পাওয়া হয়নি বলেই এমনটা হয়েছে।
সারাবাংলা: যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে আবার লিগ শুরু হয় তাহলে কীভাবে ব্যাক করবেন? কোচ সাইফুল বারী টিটুর সঙ্গে দলের কীভাবে সমন্বয় হচ্ছে?
রানা: ক্লাব অফিসিয়ালদের সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে আমার সবসময় যোগাযোগ আছে। দুঃখের বিষয় কী জানেন? ফেডারেশন কাপে তিন ম্যাচে কোনোটাই কিন্তু আমরা হারিনি। কিন্তু আমরা গ্রুপ পর্ব পেরুতে পারিনি। তাছাড়া লিগের শুরুটা দেখেন ড্র করে পরে হারলাম। এর থেকে এটা ম্যাচে জেতাও ভালো, একটা ম্যাচ হারাও ভালো। আমরা মাত্র ৫ পয়েন্ট পেয়েছি যেটা খুবই হতাশাজনক।
সারাবাংলা: দলের পারফরম্যান্সের পেছনে কোচ হিসেবে সাইফুল বারী টিটুর নিবেদন নিয়ে কী কোনো প্রশ্ন আছে?
রানা: ক্লাব অফিসিয়ালরা সুযোগ-সুবিধা দিবে। কোচ ট্রেনিং করাবে। কৌশল নিয়ে কাজ করবে। মাঠে কিন্তু কোচ খেলে খেলে দিবে না। খেলতে হবে খেলোয়াড়দেরই। মাঠে প্রমাণ করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। কোচ যেভাবে কাজ করছেন সেভাবে মাঠের মধ্যে ফলানো যাচ্ছে না। কাজগুলো করতে হবে ফুটবলারদের। আর একেরপর এক মাচ যখন হারতেছি, মানসিকভাবেও আসলে অনেক নেতিবাচক অবস্থানে চলে গিয়েছে।
সারাবাংলা: দলের পারফরম্যান্সের কারণেই কি তাহলে তিন প্লেয়ারকে শোকজ করা হয়েছিল?
রানা: অফিসিয়াল কৈফিয়ত চাইতে পারে যে দলে সেরা স্কোরার আছে, সেরা ডিফেন্ডার ও গোলকিপার আছে তারপরেও এমন হচ্ছে কেন? কৈফিয়ত চাইতে পারে যে রানা তোমার মতো গোলরক্ষকের তো সাতটা গোল খাওয়ার কথা না! কেন হলো এমন! কি অবস্থায় আমরা গোল খেয়েছি সেটা দেখার বিষয়। সে চিন্তা থেকে হয়তো অফিসিয়ালরা জানতে চাইতে পারে যে কেন এমন হলো। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসেবে সেভাবে পারফরম্যান্স আসেনি। যেখানে মোহামেডান ক্যাসিনো কাণ্ডের পর কোনো মতে দল গড়ে এখন ১২ পয়েন্ট নিয়ে ভালো অবস্থানে আছে! তাদের বিদেশি প্লেয়াররা কেমন খেলছে একটু দেখবেন। বা লোকাল প্লেয়ারদের হঠাৎ করে আপনি হয়তো চিনবেনও না। কিন্তু পারফরম্যান্স দেখুন।
সারাবাংলা: সবকিছু মিলিয়ে শেখ রাসেলের চ্যালেঞ্জটা কীভাবে নিবে সামনে?
রানা: আমাদের সকল ফুটবলারদের আরো নিবেদিত হতে হবে। আরো পরিশ্রম করতে হবে। এত হতাশাজনক কখনই হতো না বা হবে না।
সারাবাংলা: ধন্যবাদ।
রানা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অধিনায়ক আশরাফুল ইসলাম রানা ক্রীড়াবিদ গোলরক্ষক ফুটবলার বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র