রোনালদো অনুপ্রেরণা রেকর্ডধারী জহিরের
৭ এপ্রিল ২০২০ ২২:০৯
ঢাকা: মরণব্যাধী করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্বই স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশেও এর ছোবলের দরুণ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে সকল ঘরোয়া ক্রীড়া টুর্নামেন্ট বন্ধ। এমন থমথমে অবস্থায় দেশের ক্রীড়াবিদদের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সারাবাংলাডটনেটের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার আয়োজনে আজকে থাকছেন ট্র্যাকজগতে অল্প বয়সেই আলো কুড়ানো উদীয়মান তারকা স্প্রিন্টার জহির রায়হান।
জহির যেন ট্র্যাক জগতে নক্ষত্রের মতো এসে সব আলো কেড়েছেন। যুব চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণ জিতে পথ চলা শুরু। গেল বছরে ভারতের গুন্টর সিটি, অন্ধ্রপ্রদেশে অনুষ্ঠিত ৩৫তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ জিতেছিলেন। এরপর কেনিয়ায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সেমি ফাইনালিস্ট ছিলেন। তবে দেশের পুরো আলো কেড়েছেন গত বছর ৩২ বছরের একটা রেকর্ড ভেঙে। গত বছর জানুয়ারিতে ৪২তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্সের ১৯৮৬ সালে সিউলে মিলজার হোসেনের ৪০০ মিটারের ৩২ বছরের রের্কড ভেঙেছিলেন বিকেএসপির এই স্প্রিন্টার। জহির মিট শেষ করেছেন ৪৬ দশমিক ৮৬ সেকেন্ডে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই অ্যাথলেট তার চড়াই-উৎরাই, চ্যালেঞ্জ আর স্বপ্নের কথা বিনিময় করেছেন সাক্ষাৎকারে।
সারাবাংলা: কীভাবে সময় কাটছে?
জহির রায়হান: ঘরেই আছি। অলিম্পিক, বাংলাদেশ গেমস সবই তো পিছিয়ে গেছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করছি। ফিটনেসে পিছিয়ে থাকলে তো আরো পিছিয়ে যাবো।
সারাবাংলা: ফিটনেস ধরে রাখার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
জহির রায়হান: নিজেই রুমের ভেতর কোর এক্সারসাইজ বা জিমনেসিয়ামে সময় দেই। দুই বেলা তিন ঘণ্টার মতো সময় দেই। একটা শিডিউল করেছি। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রুটিন অনুযায়ী কোচের নির্দেশনায় কম্বাইন্ডভাবে পরিশ্রম করছি। ট্রেডমিলে দৌড়াই। আর জিমে ফিটনেস এক্সারসাইজগুলো করি। এভাবেই প্রস্তুত রাখছি।
সারাবাংলা: অ্যাথলেটদের নিশ্চয়ই ভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। টাইমিং, স্টার্টিং সব মিলিয়ে স্প্রিন্টারদের প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে?
জহির রায়হান: স্প্রিন্টারদের ট্র্যাক ছাড়া আসলে পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন। ফিটনেসের কাজ করে হয়তো ইন্ডুরেন্স ঠিক রাখা যায়। তবে টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুতিটা সম্পূর্ণ হয় না।
সারাবাংলা: ৪০০ মিটারে ৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছেন গত বছর। কী স্বপ্ন দেখেন আর কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন?
জহির রায়হান: করোনার কারণে অলিম্পিক পিছিয়ে গেছে। ফেডারেশন কাকে নির্বাচন করবে সেটা জানি না। তবে নিজেকে তো প্রস্তুত রাখতে হবে। সেটাই করছি।
সারাবাংলা: গত বছরে ভারতে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণ পেয়েছিলেন পছন্দের মিটে। সেটা নিশ্চয়ই বাড়তি প্রেরণা দিচ্ছে?
জহির রায়হান: অবশ্যই! তাতো দিচ্ছেই। নিজের আত্মবিশ্বাস লেভেলটা বেড়ে গেছে। কেনিয়ার নাইরোবিতে ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১৭ সালে সেমি ফাইনালে যাই। তাছাড়া আমাদের দেশের জাতীয় রেকর্ডটাও ভাঙতে পেরেছি। এগুলো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
সারাবাংলা: কি টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছেন? রেকর্ড আছে একটা জাতীয়?
জহির রায়হান: নিজের রেকর্ডটাই ভাঙতে চাই। বড় স্বপ্ন দেখলেইতো হবে না! তবে আপাতত জাতীয় রেকর্ডটা আবারো ভাঙতে চাই। বাংলাদেশ গেমসেও একটা রেকর্ড গড়তে চাই।
সারাবাংলা: করোনার কারণে পিছিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ গেমস পরে শুরু হলে কীভাবে প্রস্তুতি নিবেন?
জহির রায়হান: করোনাক্রান্তি চলে গেলে অন্তত তিন থেকে চার মাস সময় দরকার বাংলাদেশ গেমসের প্রস্তুতির জন্য। যেহেতু ফিটনেস লেভেলটা ধরে রাখছি। তাহলে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখতে পারবো। অনলাইন বা ইউটিউবে অ্যাথলেটদের কোয়ারেনটাইনের সময়ের ওয়ার্ক আউটগুলো দেখে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সারাবাংলা: অ্যাথলেট হিসেবে কাউকে আদর্শ মানেন বা অনুসরণ করেন?
জহির রায়হান: হ্যা। ৪০০ মিটারের বিশ্বরেকর্ডধারী দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিন্টার ওয়েড ভ্যান নিয়েকার্ককে আদর্শ মনে করি।
সারাবাংলা: নিজেকে কোথায় দেখতে চান আগামী বছরগুলোতে?
জহির রায়হান: অলিম্পিক আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখি। সবারই এটাই স্বপ্ন থাকে। অলিম্পিককে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিলে অন্ততপক্ষে আঞ্চলিক পর্যায়ের টুর্নামেন্ট যেমন সাউথ এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ, এশিয়ান গেমস এগুলোতে ভালো করা যায়।
সারাবাংলা: সবশেষ নেপালে সাউথ এশিয়ান গেমসে ফাইনালে উঠেও একটা আক্ষেপ নিয়ে ফিরেছিলেন সেটা কি?
জহির রায়হান: ফাইনালে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে যাই। ভালো টাইমিং করেছিলাম। কিন্তু ফাইনালটা দেওয়া হলো না। চিকিৎসক ট্র্যাকে দৌড়াতে নিষেধ করেন। তাই রেজাল্ট নিয়ে ফেরা হয়নি।
সারাবাংলা: বিশ্বের অন্যান্য অ্যাথলেটরা যখন প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কি?
জহির রায়হান: আমরা যে অবস্থায় আছি তাতে অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে অ্যাথলেটদের মূল্যায়ন করা হয় না।
সারাবাংলা: অ্যাথলেটদের এই অবস্থা দূর করতে কী করা প্রয়োজন বলে আপনার মনে হয়?
জহির রায়হান: আমি এক নম্বরে বলি ট্রেনিং। প্লেয়ারদের ট্রেনিং থাকবে। ভালো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আর থাকার একটা ভালো জায়াগা। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। দেশে অনেক মেধাবী অ্যাথলেট আছে। তাদের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।
সারাবাংলা: সে ধরনের পরিবেশ কি দেশের অ্যাথলেট ফেডারেশন নিশ্চিত করতে পারছে?
জহির রায়হান: এগুলো ফেডারেশন কীভাবে দিবে? আর্থিক দুর্বলতা আছে ফেডারেশনের। আমাদের সেভাবে সরবরাহ দিলে নিশ্চয়ই আরো অ্যাথলেট উঠে আসতো।
সারাবাংলা: অলিম্পিকে সরাসরি অংশ নেওয়ার স্বপ্ন কতটা বাস্তবিক?
জহির রায়হান: সম্ভব! আমি কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ওয়াইল্ডকার্ড ছাড়াই অংশ নিতে পেরেছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল সামনে যে বাংলাদেশ গেমসটা ছিল যেটাতে এটলিস্ট অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা যেতো। মানুষ পারে না এমন কিছু নাই। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। শুধু ফ্যাসিলিটি দিয়েই সবকিছু হয় না। নিজের তাগিদটাও থাকা জরুরি। শুধু ঘরোয়া না আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করতে চাই।
সারাবাংলা: কাতারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে গিয়েছিলেন। সেখানে তেমন ফল আনতে পারেননি। সেখান থেকে কোনো অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?
জহির রায়হান: বিশ্ব মানের সব অ্যাথলেট ছিলো সেখানে। আমার ট্র্যাকে বিভিন্ন দেশের সেরা স্প্রিন্টাররা এসেছিলেন। তার মধ্যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণধারী কানাডার চ্যাপলিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।
সারাবাংলা: তার সঙ্গে নিশ্চয়ই ট্রেনিং প্রোগ্রামসহ অন্যান্য বিষয়েও কথা হয়েছে?
জহির রায়হান: হ্যা। তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম ও তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কথা হয়েছে।
সারাবাংলা: খাদ্যাভ্যাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ একজন অ্যাথলেটের জন্য?
জহির রায়হান: খাওয়া দাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বড় ফ্যাক্ট। আপনি কি খেলেন, কীভাবে পরিশ্রম করছেন খেয়ে, সেটা অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। চ্যাপলিনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ বিষয়ে। ওরা কিন্তু স্পাইসি বা সুস্বাদু খাবার পছন্দ করে না। আমাদের দেশে সুস্বাদু খাবার বেশি খাই। চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাই। মশলা বেশি খাই। সেগুলো একজন অ্যাথলেটের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। এগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। এগুলো আমি খাই না। ফুড হ্যাভিটটা প্রধান জিনিস খেলোয়াড়দের জন্য।
সারাবাংলা: তরুণ অ্যাথলেটদের জন্য খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কিছু পরামর্শ…
জহির রায়হান: আমি তরুণদের বলবো অ্যাথলেট হতে হলে খাদ্যাভ্যাসে সচেতন থাকতে হবে। কি খাচ্ছি সেটা মাথায় রেখে চলতে হবে। তরল জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। স্যুপ, চিকেন, ব্রুকলি জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। প্রোটিন যতটুকু দরকার ততটুকু নিতে হবে।
সারাবাংলা: অ্যাথলেট হতে হলে কি বিসর্জন দিতে হবে একজনকে?
জহির রায়হান: সময়ের সদ্ব্যবহার করাটা জরুরি। মোবাইলে যত পারি কম সময় দেই। আর ঘুমের অভ্যাসটা খুবই জরুরি। উসাইন বোল্ট কিন্তু দিনে ১২ ঘণ্টা ঘুমায়। সেরকম পরিশ্রম করেন। অ্যাথলেটদের সেটা মেইনটেইন করা উচিৎ। অনুপ্রেরণা নেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর থেকে। সে চার্ট করে পাঁচবার ঘুমান। আমি তো সেভাবে চলতে পারি না। তবে যথেষ্ট ঘুমানোর চেষ্টা করি।
সারাবাংলা: রোনালদোকে কীভাবে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেন?
জহির রায়হান: সে অনেক হার্ড ওয়ার্কার। পরিশ্রমী ভীষণ। সফলতা পেতে গেলে পরিশ্রম করতে হবে প্রচুর। সাফল্যের সবচেয়ে বড় চাবিটাই পরিশ্রম করা। রোনালদোর পরিশ্রম সবসময় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
সারাবাংলা: আপনার জীবনে এমন কোনো অজানা তথ্য যা সাধারণ মানুষ জানে না…
জহির রায়হান: আমি যখন বিকেএসপিতে যোগ দেই তখন আমি মেয়েদের থেকেও কম জোরে দৌঁড়াতাম। কিন্তু পরে প্রচুর পরিশ্রম করেছি। আমার ব্যাচম্যাট যারা ছিল অনেকেই ঝরে গেছে। পরিশ্রম করে লেগেছিলাম দেখেই আজকে কিছুটা হলেও সাফল্য দেখতে পাচ্ছি। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।
সারাবাংলা: উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। ধন্যবাদ আপনাকে।
জহির রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনুপ্রেরণা অ্যাথলেট করোনাভাইরাস ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জহির জহির রায়হান জাতীয় রেকর্ডধারী রেকর্ডধারী