ফাঁকা মাঠে ফুটবল: করোনাকালের নতুন বাস্তবতা
১৭ মে ২০২০ ১৯:৩৩
মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্ব প্রায় স্থগিত। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে খেলাধুলাও বন্ধ প্রায় দুই মাস ধরে। তবে কিছু কিছু দেশে ভাইরাসের প্রকোপ হ্রাস পাওয়ায় খেলাধুলাও ফিরছে। ফুটবলে বড় লিগগুলোর মধ্যে একমাত্র জার্মান বুন্দেসলিগা মাঠে ফিরেছে। করোনাকালে ফুটবল মাঠে ফেরায় সবারই কৌতূহল ছিলো শনিবারের ম্যাচগুলো নিয়ে। এদিনে লিগের ছয়টি ম্যাচ মাঠে গড়ায়।
করোনাকালে এই ছয় ম্যাচ ভক্ত ও দর্শকদের জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। মাঠের খেলার বাইরে শুরু থেকে শেষ অবধি যে চিরচেনা দৃশ্যগুলো দেখা যায়, যে সুনিশ্চিত ছকে সবকিছু চলে, এবারে তা পুরোপুরি ব্যতিক্রম।
ইউরোপে ফুটবল ম্যাচের আগে সাধারণত হোটেল থেকে মাঠে পুরো দল একটি বাসেই ভ্রমণ করে থাকে। তবে এবার হলো তার ব্যতিক্রম। প্রত্যেকটি মাঠে কয়েকটি আলাদা আলাদা বাসে আসেন খেলোয়াড়রা। এর একটাই কারণ— যাতে রাস্তায় খেলোয়াড়ে খেলোয়াড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। এর আগে খেলোয়াড় ও স্টাফরা সপ্তাহখানেক বিভিন্ন হোটেলে কোয়ারেনটাইনে ছিলেন। তাদের শরীরে করোনার জীবাণু আছে কি না তা নিশ্চিত হতে বারবার পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের।
বাস থেকে নেমে মাঠ পর্যন্ত প্রত্যেক খেলোয়াড় ও স্টাফের মুখে ছিল মাস্ক। খেলোয়াড় ছাড়া বাকি যারা মাঠে না ঢুকলেই নয়— যেমন কোচিং স্টাফ, নিরাপত্তারক্ষী, সাংবাদিক তাদের প্রত্যেকের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে তবেই মিলেছে প্রবেশাধিকার।
তবে এদিনের প্রত্যেকটি ম্যাচ হয়েছে দর্শকশূন্য মাঠে। কোন দলের ভক্তরা গ্যালারিতেই শুধু নয়, স্টেডিয়ামের ত্রিসীমানায় ভিড়তে পারেননি। পুলিশের কড়া পাহারায় ওদিকে পা মাড়ানোর নাম করেননি কেউই।
পুরো স্টেডিয়ামজুড়ে উপস্থিত ছিলেন মাত্র গোনে গোনে ২১৩ জন মানুষ। এর মধ্যে মাঠেই ছিলেন ৯৮ জন। এদের সবাই খেলোয়াড়, কোচ, বল বয় ইত্যাদি। আর বাকি ১১৫ জন যারা ছিলেন তারাও শুধু শুধু খেলা দেখতে আসেননি। এদের কেউ নিরাপত্তাকর্মী, কেউ মেডিকেল টিমের সদস্য আর হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক। স্টেডিয়ামের ভিতরে জনবলের হিসাব এই।
আর স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়ানোর অনুমতি ছিলো আরও কম। সেখানে ছিলেন মোটে ১০৯ জন। তাদের বেশিরভাগই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। আর বাকিরা ভিডিও অ্যাসিসটেনস রেফারি বা ভার এর অপারেটর।
খেলা মাঠে গড়ানোর ঠিক আগে অর্থাৎ কিক অফের আগে আগে বল-বয়রা প্রত্যেকটি বল জীবাণুমুক্ত করেন। একই কাজ করা হয় হাফটাইমেও।
বদলি খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সদস্যরা ডাগআউটে বসেছিলেন করোনাকালীন শৃঙ্খলা মেনে। সবার পরনেই ছিলো ফেস মাস্ক। তাদের বসার চেয়ার আর আগের মত গাদাগাদি করে নয় মোটেও- এবার তারা বসেছেন দূরে দূরে।
এদিন আরবি লেইপজিগ ও ফ্রেইবার্গের মধ্যকার ম্যাচটিতে ঘটলো আরেক কাণ্ড। ওই ম্যাচে আরবি লেইপজিগ বিমান উঠার সিঁড়ি মাঠে এনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগের কারণ— যাতে গ্যালারির স্ট্যান্ড থেকে বদলি খেলোয়াড়রা নিরাপদে কারো সঙ্গে স্পর্শ ছাড়াই মাঠে অবতরণ করতে পারেন।
তবে মাঠে মাস্ক পরার ক্ষেত্রে হেড কোচদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেহেতু ৯০ মিনিটজুড়ে তারা তাদের শীষ্যদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নানা নির্দেশনা দিতে হবে, তাই তারা মাস্ক পরেননি। মাস্ক পরে চিৎকার করলে যে পাশের জনও ঠিকমত শুনবেন না, তাই তাদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরায় শিথিলতা।
এছাড়া বদলি খেলোয়াড়রা ওয়ার্ম আপের সময় মাস্ক খুলে রাখতে পেরেছেন। তবে কোন খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে উঠিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতে একটি নতুন মাস্ক তুলে দেওয়া হয়েছে।
তবে যত কড়াকড়ি তা কেবল মাঠের বাইরে। মাঠে খেলা হলো আগের মতই। এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসতে পারে, তবে কি একজন আরেকজনকে ট্যাকেল করবেন না, ধাক্কা দিবেন না? বল দখলের লড়াইয়ে আরেকজনের কাছে যাবেন না ? না, ততটুকু না হলে আর খেলাই বা হবে কিভাবে।
মাঠের খেলা হয়েছে আগের মতই। ট্যাকেল হয়েছে, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে, বাতাসে বল দখল করতে দু’জন একসঙ্গে লাফিয়েও উঠেছেন। সবচেয়ে বড় কথা ম্যাচে গোলও হয়েছে। শনিবারের ৬ খেলায় মোট গোল হয়েছে ১৬টি। অর্থাৎ ১৬ বার এমন পরিস্থিতি হয়েছে যেখানে খেলোয়াড়রা বাধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে বাধ্য। তবে এই উদযাপনটুকু হয়েছে আবার নির্দেশনা মেনে। প্রায় সব গোলের পরই একে অন্যের কনুই এর সঙ্গে কুনই মিলিয়ে উদযাপন করেছেন।
কিন্তু ওই যে বলা হল ‘বাধভাঙা’ উচ্ছ্বাস! ‘বাধভাঙা’ বলেই কিছু কিছু ম্যাচে এতটুকু শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেননি কেউ কেউ। যেমন হের্থা বার্লিনের খেলোয়াড়রা হফেনহেইমের সঙ্গে ম্যাচে গোল উদযাপন করেছেন আগের মতই। খুশিতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছেন। তবে তাতে কাউকে জরিমানা গুনতে হবে না। কেননা মাঠে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কোন বাধ্যবাধকতা দেয়নি বুন্দেসলিগা কর্তৃপক্ষ। এসব কেবলই পরামর্শ।
এছাড়া করোনাকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে খেলাটির নিয়মে। দলগুলো পাঁচ জন খেলোয়াড় বদলি হিসেবে নামানোর সুযোগ পেয়েছে। ফলে ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে শালকে প্রথমার্ধেই দু’জন বদলি খেলোয়াড় নামানোর বিলাসিতা দেখাতে পেরেছে। বাকি তিনজন বদলি নেমেছেন দ্বিতীয়ার্ধে।
এদিকে উলফসবার্গের খেলোয়াড়রা রেফারিদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে মিলিয়েছেন পায়ে পায়ে। ফিচার ছবিতেই দেখুন তা। তবে বাকিরা মিলিয়েছেন কনুইয়ে কুনই।
ম্যাচ শেষে সাংবাদিকরাও খেলোয়াড় এবং কোচদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই। স্টিকে মাইক্রোফোন লাগিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত খেলোয়াড় বা কোচের দিকে। এছাড়া ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সে।
– বিবিসি অবলম্বনে