মোস্তাফিজের কিছু জিজ্ঞাসা
১৫ জুন ২০২০ ১৪:০৯
মোস্তাফিজুর রহমানকে যখন ফোন দেই তখন ভর দুপুর। দুই কি তিনবার রিং হতেই ওপ্রান্ত থেকে ধরে প্রথমেই জানতে চান, ‘ভাই ভালো আছেন তো?’ প্রতিবেদক তাকে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে পাল্টা জানতে চান, তিনি কেমন আছেন এবং কি করছেন? বেশ শান্ত গলায় বললেন, ‘বাড়িতে তো ভালোই থাকি। এখন কবুতরকে খাওয়াচ্ছি।’ সাতক্ষীরার তেতুলিয়ার আকাশ তখন আষাঢ়ের ঘন মেঘে আচ্ছন্ন যে কোনো সময়ই ঝুম বৃষ্টি শুরু হবে, তখন কবুতরকে খাওয়ানো বন্ধ করে রুমে ঢুকে যেতে হবে সেই তাগিদও তার কণ্ঠে স্পষ্ট। ‘আকাশে মেঘ করেছে ভাই যে কোনো সময় বৃষ্টি আসবে। কবুতরকে খাওয়ানো শেষ করেই ঘরে ঢুকব।’ আপনাদের ঢাকার কি অবস্থা? প্রতিবেদক উত্তর দেন, ‘না, মেঘ নেই তবে প্রচন্ড গরম।’
টিপ্পনি কেটে দেশ সেরা এই পেসার বলেন, ‘কেন যে মানুষ ঢাকায় থাকে? এর চাইতে গ্রামই ভালো। এখানে গরম বেশি হলেও গাছপালা আছে। তাছাড়া ওখানে করোনায় যেভাবে মানুষ মরছে! আপনি এক কাজ করেন হয় আপনার গ্রামে চলে যান না হয় আমার গ্রামে চলে আসেন। আমি ছোট মানুষ, আপনাকে অত টাকা বেতনের চাকরি দিতে পারব না। আামার ঘের আছে (চিংড়ির ঘের) সেগুলো দেখাশোনা করবেন, থাকা খাওয়া বাদে মাসে ছয় হাজার টাকা পাবেন (হাসি)।’ প্রতিবেদক হাসেন, সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়া গ্রামের দামাল ছেলেটিও হেসে কুটিকুটি। না দেখেও স্পষ্ট বোঝা যায় সেই হাসিতে কোনো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নেই। বরং মহামারিকালে কারো জন্য কিছু একটা করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রবলভাবেই বিদ্যমান।
হঠাৎই প্রসঙ্গ বদলে বলেন, ভাই বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) কি কিছু বলেছে? আমাদের খেলা নিয়ে, অনুশীলন নিয়ে।’ প্রতিবেদক জানতে চান, ‘কেন? খেলতে ইচ্ছে করছে?’ তাতে অবাক হন না ২০১৯ বিশ্বকাপে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে জায়গা করে নেওয়া লাল সবুজের এই তুর্কি তরুণ পেসার। বরং বেশ সপ্রতিভ হয়েই বলেন, ‘খেলতে তো ইচ্ছে করেই। কিন্তু করোনায় তো প্রতিদিনই ৪০ জনের ওপরে মরছে! আমি অবশ্য বাড়িতে টেনিস বলে খেলছি। কিন্তু…’ উৎসাহ নিয়ে জানতে চাই কিন্তু কি? কিছুটা ম্লান কণ্ঠে ফিজ জানান, ‘গত কয়েক দিন টাানা বৃষ্টি। বাইরে খেলাও বন্ধ হয়ে গেল।’
বুঝতে বাকি রইল না, করোনায় টানা তিন মাস ক্রিকেট থেকে দূরে থাকায় মাঠে ফিরতে কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সবশেষ খেলেছেন মার্চে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। কিন্তু ওই সময় করোনাভাইরাস দেশে সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করলে প্রথম রাউন্ড শেষে লিগের আর কোনো ম্যাচই গড়ায়নি। উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্রিকেট বন্ধ ঘোষণা করে বিসিবি। এরপর একে একে স্থগিত হয়েছে পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। এতে করে মোস্তাফিজরা হয়েছেন খেলা বঞ্চিত।
ফলে যৌক্তিক দৃষ্টি কোণ থেকেই তাকে বিসিবি’র অবস্থান জানাই, ‘দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিসিবি ক্রিকেট ফেরাবে। আপনাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এই মুহুর্তে অনুশীলন ফেরাতে চাইছে না। পরিস্থিতি ভালো হলে তবেই।’ তিনিও তাতে সম্মতি দেন। ‘ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ঘর থেকেই তো বের হওয়া মুশকিল। এর মধ্যে আবার খেলা কিসের?’
কথা শেষ হতেই তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দেই- ‘আচ্ছা এই মুহুর্তে বিসিবি যদি বলে শ্রীলঙ্কা সিরিজ হবে এবং সেজন্য আপনাদের অনুশীলনে ফিরতে বলে, অবাক হবেন? কেননা বিসিবি এখনো লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডকে তিন ম্যাচ টেস্টের জন্য না বলেনি। দুই বোর্ডের মধ্যে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জুলাইয়ে জানা যাবে।’ ফিজ পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন-‘ভারত, পাকিস্তান কি খেলছে? ওদের অবস্থা তো আমাদের মতোই। অকাট্য যুক্তি বলে খন্ডাতে মন সায় দেয় না। তবে কয়েকটি দেশের উদাহারণ টেনে বলি- ইংল্যান্ড সিরিজ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এই মুহুর্তে ক্যারিবীয়রা ইংল্যান্ডে। ম্যানচেস্টারে কোয়ারেনটাইনে আছে। শেষ হলে ৮ জুলাই থেকে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলতে সাউদাম্পটনে যাবে। এদিকে শ্রীলঙ্কা অনুশীলন শুরু করেছে। পাকিস্তানের আগামি মাসে ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা রয়েছে, আফগানিস্তান অনুশীলন শুরু করেছে, অস্ট্রেলিয়ায় ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু হয়েছে।’
কাটার স্পেশালিস্ট বেশ মনোযোগ দিয়েই কথাগুলো শুনলেন। এরপর প্রতিবেদকে এক নিশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন- আপনিই বলেন, আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থা কি ওদের মতো? ধরেন বিসিবি বলল অনুশীলনে ফিরতে হবে এবং আমিসহ অন্যান্য ক্রিকেটাররাও ঢাকায় গেলাম। আমার কথাই বলি। ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটে যারা থাকে তারা সবাই যে করোনামুক্ত এই গ্যারান্টি কে দেবে? মনে করেন আমার বাসা ছয় তলায়। সেখানে তো আমি বা আমার পরিবার হেঁটে উঠতে পারব না। লিফট লাগবে। ওই লিফট জীবাণুমুক্ত কিনা সেটা কেউ বলতে পারবে? ধরেই নিচ্ছি বিসিবি মিরপুরে আমাদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুশীলনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু মাঠে আসা-যাওয়ার সময় কী হবে? আচ্ছা ঠিক আছে আমার গাড়ি আছে। কিন্তু মাঠে যেতে আসতে আমি যে গাড়ি ব্যবহার করব এবং সেটা যে চালাবে মানে ড্রাইভার করোনায় আক্রান্ত নন এর নিশ্চয়তা কি? ধরেই নিচ্ছি উনি সুস্থ আছেন। ভবিষ্যতে যে হবে না এই নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারবেন? ওনাকে সুস্থ রাখতে হলে আমার বাসায় রাখতে হবে। সেই অবস্থা আমার আছে কিনা সেটা কেউ ভেবেছেন?’
প্রশ্নগুলো শেষ হতেই সাতক্ষীরার আকাশের বুক চিড়ে শত সহস্র ধারায় নেমে আসে বৃষ্টি। তাতে নিজ বাড়ির তিন তলার ছাদের ওপর থেকে অনর্গল ছুড়তে থাকা মোস্তিাফিজের প্রশ্নভান্ডারও শেষ হয়ে আসে। ‘ভাই, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রুমে ঢুকে যাই। আপনি ভালো থাকবেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল মোস্তাফিজুর রহমান