Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসা ফুটবলার সোহেলের গল্প


২১ জুন ২০২০ ২০:২৬

ঢাকা: লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা, অবহেলা, বিষণ্ণতা, বিষাদ। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এগুলোই মানুষকে ঠেলে দিতে পারে আত্মহত্যার পথে। বিষাদের পাহাড় ঠেলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই বেছে নেন মরণঘাতী এ সিদ্ধান্ত। আবার সেই যন্ত্রণার পাহাড় গুড়িয়ে জীবনের কল্লোলে ফিরে আসেন অনেকে। অন্ধকার সুড়ঙ্গে হারিয়ে যেতে যেতে আলোর শিখা খুঁজে নেয়া এমন এক যোদ্ধার গল্পই বলবো আজকে।

তার নাম সোহেল রানা। দেশের ফুটবলে পরিচিত মুখ। দেশের ক্লাব ইতিহাসের অন্যতম সফল দল ঢাকা আবাহনীর হয়ে খেলছেন ২৮ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার। ফুটবলে নাম, খ্যাতি থাকার পরেও আত্মহত্যার দিকে তিলে তিলে ধাপিত হয়েছিলেন এই ফুটবলার! একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ছোঁ মেরে ফিরিয়ে এনেছেন নিজের জীবন। গল্পটা প্রচণ্ড কষ্টের। তবে আকাশসম অনুপ্রেরণার।

বিষাদে মুষড়ে যেভাবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সোহেলকে:
২০১৮ সালের নভেম্বরের ২৪ তারিখ। সেদিন ফুটবলের জন্য একটা বড় খারাপ লাগা দিন। এই দিনেই ঢাকার সাভার থেকে খবর- বাইক দুর্ঘটনায় আহত ফুটবলার সোহেল (তখন শেখ রাসেলের ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলতেন)। এরপরের খবরটার জন্যও কেউ প্রস্তুত ছিল না। এই দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও সন্তানকে হারিয়েছেন সোহেল। একেবারে নিঃস্ব! যেন অ্যাটম বোমের মতো বিস্ফোরণ হলো। ফেডারেশন কাপের সেমির ম্যাচ খেলে ছুটিতে স্ত্রী ঝুমা খাতুন আফরিন ও তিন বছরের ফুটফুটে সন্তান আব্দুল্লাহ আল আফফানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে ফিরছিলেন সোহেল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে খুশির সেই মুহূর্ত রূপ নিল নিঃসঙ্গতার নীল মৃত্যুপূরিতে! লণ্ডভণ্ড সব।

স্ত্রী ও সন্তানকে হারিয়ে একেবারে একা হয়ে যাওয়ার অতীত বলতে বলতে গলা ধরে এলো সোহেলের, ‘একটা মাস বাসায় ছিলাম। কবরের পাশেই বসে থাকতাম। নামাজ পড়তাম। ওদের জন্য দোয়া করতাম। বেশিরভাগ সময়ই কান্না করতাম।’

এভাবে এক মাস কেটে গেল। নিজের মনটাকে শান্ত করার উপায় নেই। একই দুর্ঘটনায় স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে যেন উপরওয়ালার নিষ্ঠুর শাস্তির দাঁড়ি-পাল্লায় নিজেকে বসালেন সোহেল। ভাবলেন ফুটবলে ব্যস্ত হলে হয়তো কষ্ট লাঘব হবে। এক মাস পর শেখ রাসেলের ক্যাম্পে ফিরলেন। দুই-তিন পর আবার ক্লাব বন্ধ হলো। আবার সেই দুঃখের নগরীতে ফিরতে হলো সোহেলের।

এমন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও বাড়িতে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন, ‘মসজিদে দান, এতিমদের খাবার এসব কাজেই ব্যস্ত ছিলাম। এক দেড়টা মাস। যেখানে যতটুকু পারছি ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছি।’

এদিকে ফেডারেশন কাপের ফাইনালও শেষ। এবার প্রিমিয়ার লিগের ২০১৮-১৯ মৌসুমের প্রস্তুতি জোরেশোরে চলছে। সতীর্থদের কাছেই ফিরলেন সোহেল। ভাবলেন এবার হয়তো শান্তি মিলবে। তার উল্টোই হলো। শান্তির খোঁজে বের হওয়া পথিক ডুবে গেল বিষণ্ণতার সমূদ্রে।

সেই কষ্টের কথাগুলো বলতে বলতে জড়িয়ে আসছিল সোহেলের কণ্ঠ, ‘ক্লাবের পরিবেশটা আসলে ভিন্ন। এখানে যারা সতীর্থ তারা সাহস পায় না হয়তো। বন্ধু বলেন ভাই বলেন কেউ সাহস করে আমার রুমে আসতো না। আমি টোটালি একা একা থাকি। সেসময়গুলো প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকি। যখন প্রাকটিসের সময় হয় আমাকে প্রাকটিসের জন্য কেউই রেডি করতে আসেনি আমার রুমে। ওরা হয়তো ভেবেছে আমাকে এসে কী বলবে। আমি ওদের দোষ দিবো না। তবে এটা আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। ভুগিয়েছে।’

এই সময়টাতে আরো নিঃসঙ্গতার সাগরে তলিয়ে গেলেন সোহেল, ‘পৃথিবীতে একটা মানুষও কি নাই আমাকে একটু কথা বলে নিয়ে যাবে মাঠে! গল্প করবে। শেয়ার করবে। একটা জিনিস চিন্তা করলাম যারা আমার প্রিয় তারাই দূরে চলে গেছে। আসলে পৃথিবীতে আপন বলতে কেউই নাই। এসময়টা আমি খুবই একা থাকতাম। এই একাকীত্বই আমাকে বিষাদে ভুগিয়েছে। বিষণ্নতায় ফেলে দিয়েছে বুঝতেই পারিনি। আমি ভেবেছি কেউই নাই আমাদের পাশে। আমার ভেতরের যন্ত্রণা আসলে শেয়ার করার মতো নয়। যখন কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না বেশ কয়েকবার ভেবেছিও আমার থাকার দরকার নাই।’

শুধু তাই নয় পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও এসময় কোন সাহায্য পাননি সোহেল। উল্টো পেয়েছেন যন্ত্রণা, ‘তাছাড়া আমার ফ্যামিলি বলেন, শ্বশুর বাড়ির ফ্যামিলি বলেন বা আশপাশের বন্ধু-বান্ধব-আপন ছিল তাদের কাছ থেকে অনেক যন্ত্রণা পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। সেই কষ্টের জায়গা থেকেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছিলাম। কোচ (সাইফুল বারী টিটু) আমাকে একবার বলেছিলেন নামাজ পড়ো, কোরআন পড়ো, যে গান ভাল লাগে শোনো। তাছাড়া কেউই এগিয়ে আসেনি এই সময়টাতে।’

যেভাবে অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আলোর পথ বেছে নেন সোহেল:
মৃত্যুর সাগরে ডুব দিয়ে মুক্ত খুঁজে এনেছেন তিনি একসময়। সেই প্রেরণার উৎস হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী-সন্তানই। সোহেলে কথায়, ‘আমিতো তাদের ভালবেসেছি। আমার স্ত্রীকে। আমার সন্তানকে। আমি চিন্তা করলাম আমি যদি মরে যাই তাহলে পরকালে তাকে পাবো না। একালেও পেলাম না পরকালেও পেলাম না। তাহলেতো আমার জীবন বৃথা। তাদের ভালবাসার কথা চিন্তা করে ফিরে এসেছি।’

‘একা একা যখন থাকতাম নিজের লোকরাই ফিরে আসে নাই। কেউ বলে নাই কীরে একা বসে আছিস কেন? তখন চিন্তা করলাম আমার দুঃখের দিনে কেউ আসেনি সুখের দিনে নিশ্চয়ই কাছে আসবে। আবার কদর করবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম আসলে। কষ্টগুলো কেউ ভাগাভাগি করতে চায় না। আনন্দগুলোই সবাই ভাগ করে নেয়। তখন থেকে মানুষ চিনি। প্রকৃত বন্ধুরাই দুর্দিনে থাকে।’-যোগ করেন এই ফুটবলার।

একবার নয় নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করে ফেরার উৎসাহ সোহেল নিয়েছেন এভাবে, ‘আমি না থাকলে আমার পরিবারটার একেবারে নাম শেষ হয়ে যাবে। যতদিন জীবিত আছি তাদের (স্ত্রী-সন্তান) জন্য দোয়া করবো। তারা যেভাবে সোয়াব পাবে সেই চেষ্টা করবো। যাকাত হোক দান হোক করার চেষ্টা করবো। সেজন্য আমার বেঁচে থাকাটা দরকার। যদি চলে যাই তাহলে আমাদের আর অস্তিত্বই থাকলো না।’

ফুটবল মাঠে আরো শক্তিশালী হয়ে প্রত্যাবর্তন:
ফিরলেন যেন আরো দৃঢ় হয়ে। বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে ফেডারেশন কাপের ফাইনাল মিস করা সোহেল প্রিমিয়ার লিগে ফিরলেন আরো দুর্দান্ত হয়ে। লিগে ২৪ ম্যাচের মধ্যে শেখ রাসেলের হয়ে অধিকাংশ ম্যাচেই অনবদ্য পারফর্ম করে গেছেন এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। সেবার বসুন্ধরা কিংস শুধু একটা কালো দাগ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেটা হলো শেখ রাসেলের কাছে লিগের একমাত্র হার। মোহামেডান-সাইফ স্পোর্টিংয়ের মতো হ্যাভিয়েট দলগুলো পেছনে ফেলে শেখ রাসেলকে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় স্থানে রাখতে অসামান্য অবদান রেখেছেন সোহেল।

এই রাজার মতো মাঠে প্রত্যাবর্তনের রহস্যের পেছনে হারানো স্ত্রী-সন্তানরাই অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মত সোহেলের, ‘আমি যখন মাঠে নামি বা নেমেছি বা খেলছি তখনও অনেকসময় তাদের কথা মনে পড়তো। কিন্তু এটাই আমাকে আরো অনুপ্রেরণা দিতো ভাল করার। আমার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা ছিল জাতীয় দলে খেলা। তার ইচ্ছা বা স্বপ্নের জন্যে হলেও আমাকে ফিরতে হয়েছে। একবার হলেও যেন জাতীয় দলে সুযোগ পাই। এই কথাগুলোই আমার কানে কানে প্রতিধ্বনি করতো।’

শেখ রাসেলে দুর্দান্ত পারফর্ম করে নজর কেড়েছেন দেশের সবচেয়ে সফলতম দল ঢাকা আবাহনীর। প্রায় অর্ধকোটিতে তাকে দলে ভেড়িয়েছে আকাশি-নীল জার্সিধারিরা। এখন স্বপ্নপূরণ বাকী। জাতীয় দলের খেলার সেই স্বপ্ন পূরণ করেই মাঠ ছাড়বেন আশ্বাস সোহেলের, ‘আমাকে ভাল কিছু করতে হবে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। ওর স্বপ্নের মধ্যেই আমি বেঁচে আছি।’

বিষণ্ণতায় মুষড়ে যাওয়া মানুষদের জন্য সোহেলের আহ্বান:
এই পথ থেকে ফিরে আসতে হলে সংগ্রামী হয়ে শক্ত মানসিকতা নিয়ে ফিরতে হবে বলে মনে করেন সোহেল, ‘আজকে যারা এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের বলতে চাই আমি যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি সেটা সারাজীবনই আমার ভেতরে বহন করে যেতে হবে। কিন্তু তার জন্য আমার সংগ্রামী হয়ে ফিরে আসতে হবে। দিনের পরেই রাত আসে। রাতের পরেই দিন। আসলে মানুষ কখনই জীবনে পরিপূর্ণ সুখী হয় না। এজন্য এই সুইসাইড কোন সমাধান নয়।’

নিজের জন্য হলেও এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান তার, ‘আমি বেঁচে আছি বলেই তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। আমি না থাকলে কেউ করতো না। জীবনটা আসলে আপনার। আপনি যতি একটু চোখ খুলে দেখেন আপনি বুঝবেন আপনি বেঁচে থাকলে কী কী করে যেতে পারবেন। কাউকে ভালবেসে মরার থেকে বেঁচে প্রমাণ করা হাজার শ্রেয়। নিজেকে বোঝাতে হবে যে কেউ আসেনি, ওকে ফাইন আই ক্যান বিট এভরিথিং। পারবো। পারতে হবে। আমাকে করে দেখাতে হবে। এরকম মানসিকতা দিয়ে সংগ্রামী হয়েই ফিরতে হবে।’

কথাগুলো বলতে বলতে সোহেল একটা সরল সুন্দর কথা বলে ফেললেন অকপটে, ‘ওকে ফাইন, আই ক্যান বিট এভরিথিং’। তুরষ্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নাজিম হিকমত হয়তো তাই বলেছেন, ‘জীবন বড় সুন্দর ব্রাদার’।

আত্মহত্যা গল্প ঢাকা আবাহনী ফিরে আসা শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র সোহেল রানা স্পোর্টস স্পেশাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কুষ্টিয়া থেকে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:২৮

সম্পর্কিত খবর