ডাগআউটের এক ‘জাদুকরে’র গল্প
১৮ জুলাই ২০২০ ০০:১৪
জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান- জিনেদিন জিদানের পূর্ণ নাম এটি। গণমাধ্যমে আহ্লাদ করে ‘জিজু’ নামে সম্মধোন করা হয় মাঝে মধ্যে। এবার কী জাদুকর বলে ডাকা হবে জিদানকে? হবে হয়তো। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ফরাসি কিংবদন্তি যা করে চলেছেন সেটা জাদুবিদ্যার চেয়ে কম কিসে! ফুটবলার জিদান অধ্যায় শেষ হয়েছে ২০০৬ সালে। তার অনেক আগেই ফরাসি মিডফিল্ডারের নামের পাশে ‘কিংবদন্তি’ শব্দটা জুড়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ২০০০ সালে ইউরো জিতেছেন। ফরাসি ফুটবলের একটা প্রজন্মের নায়ক তিনি। ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা জিতেছেন, জুভেন্টাসের হয়ে সিরি ‘আ’ জিতেছেন। ফুটবলার জিদানের অর্জন যে কারো জন্যই ঈর্ষণীয়। আর কোচ হয়ে যা করছেন সেটাকে হয়তো ‘জাদু’ই বলতে হবে!
বছর পাঁচেক আগে মাঠের ফুটবলে ধুঁকছিল রিয়াল মাদ্রিদ। একদিকে লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ ও নেইমারে উড়ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনা অন্যদিকে ধারাবাহিকতার অভাবে রিয়াল মাদ্রিদ দিশেহারা। জিদান তখন রিয়ালের ‘বি’ দলের ম্যানেজার। রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাই তখন সম্বল জিদানের। সেটা নিয়েই দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সার্জিও রামোস, করিম বেনজেমাদের।
মুখ বাঁকিয়ে হেসেছিলেন অনেকেই। অনভিজ্ঞ জিদান ভণ্ডুর রিয়ালকে নিয়ে আর কী-ই বা করবেন! রিয়ালের মূল দলের দায়িত্ব নেওয়াকে জিদানের খেলোয়াড়ি জীবনের অর্জনগুলোকে খাটো করার মাধ্যমও মনে করছিলেন অনেকে। কিন্তু তার মাত্র আড়াই বছরে কোচিংয়ে ৯টি শিরোপা জিতল রিয়াল মাদ্রিদ! তার মধ্যে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ তিনটি, লা লিগা দুটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টানা তিনবার- ভাবা যায়! আধুনিক ফুটবলে আর কোন কোচ এমন সাফল্য পাবেন কিনা সন্দেহ।
দেওয়ার আর কিছু বাকি নেই-বলে ২০১৮ সালের মে মাসে রিয়াল মাদ্রিদের কোচের পদ থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেছিলেন সর্বজয়ী জিদান। রিয়াল কর্তাদের বহু অনুরোধের ফলে ১০ মাস পর যখন আবারও কোচ হয়ে ফিরলেন তখনও ক্লাবটির ভণ্ডুর দশা। জিদান ফেরার আগেই লিগ শিরোপার দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছিল মাদ্রিদের ক্লাবটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে পিএসজির বিপক্ষে উড়ে গিয়ে রিয়াল দেখিয়েছিল কতোটা নাজুক অবস্থা তাদের। জিদান কোচ বলেছিলেন, আবারও গোছাতে সময় লাগবে তার।
প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। দ্বিতীয় মেয়াদে কোচ হয়ে ফিরে থিতু না হতেই ক্লাব ছাড়লেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো ফুটবলার, যিনি কিনা গত দশ বছর ধরে টানছিলেন রিয়ালকে। রোনালদো ক্লাব ছাড়ার পর আক্রমণভাগ ভোতা হয়ে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদের। ডিফেন্ডার সার্জিও রামোসকে পেনাল্টি নেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। ফ্রি-কিক নেওয়ার মতো ফুটবলার খুঁজে পাচ্ছিল না রিয়াল। চেলসি থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এডেন হ্যাজার্ডকে কিনলেও মৌসুমের বেশিরভাগ সময়ই চোটের কারণে বাইরে ছিলেন বেলজিয়াম তারকা। জিদান বেছে নিয়েছিলেন ভিন্ন রাস্তা।
রোনালদো যাওয়ার পর দলের গোল সংখ্যা কমে যাবে ধরে নিয়েই কম গোল হজম করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ফেরলাঁ মেন্দিকে কিনে এনে দলের রক্ষণভাগের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন জিদান। দুই অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার মার্সেলো ও সার্জিও রামোসের আক্রমণে উঠার অভ্যাস অনেক পুরনো। ফলে মাঝে মধ্যেই রিয়ালের রক্ষণ অরক্ষিত হয়ে পড়ত। প্রতিপক্ষ সেই সুযোগ নিত সহজেই। মেন্দিকে কিনে এনে এই শূন্যতা পূরণ করতে চেয়েছেন জিদান। বুদ্ধিটা কাজেও দিয়েছে বেশ। পুরো মৌসুমে মাদ্রিদের ক্লাবটি গোল হজম করেছে মাত্র ২২টি!
আগের মৌসুমের ব্যর্থতার পর সমালোচকরা বলছিলেন লুকা মডরিচ, টনি ক্রুস. মার্সেলো. সার্জিও রামোসদের বুড়িয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে বড় কিছু জয়ের ক্ষুধাটা আর অবশিষ্ট নেই। সেই ‘বয়স্ক’দের নিয়েই নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন জিদান। কোন নির্দিষ্ট ফুটবলারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দল হিসেবে পারফর্ম করার ওপর জোড় দিয়েছেন। বারবার একাদশ পাল্টেছেন, নতুন নতুন ফরমেশন সাজিয়েছেন। ভণ্ডুর একটা দল শিরোপার স্বাদ পেলো এভাবেই।
দ্বিতীয় দফায় কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর ইতোমধ্যেই দুই শিরোপা জেতা হয়ে গেল জিদানের। লা লিগার আগে জিতেছেন সুপার কোপা। সব মিলিয়ে কোচ হিসেবে রিয়ালের হয়ে জিতলেন ১১তম শিরোপা। এখন পর্যন্ত তার অধিনে ২০৯ ম্যাচ খেলেছে মাদ্রিদের ক্লাবটি। অর্থাৎ প্রতি ১৯ ম্যাচে একটি করে শিরোপা পেয়েছেন জিদান। এই পরিসংখ্যানও ‘জাদুকর’ বলবে জিদানকে।