ভ্যালেন্সিয়া: শীর্ষ থেকে শূন্যে
১৮ আগস্ট ২০২০ ১২:০৪
দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ক্লাবের খেলোয়াড়দের বেতন দিতে পারছে না সাবেক স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন ভ্যালেন্সিয়া। আর দেনার ভার এমনই যে ক্লাবের অধিনায়ক এবং সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে সেই ঋণ মেটাতে হচ্ছে তাদের। বলছিলাম ২০০৩/০৪ মৌসুমে স্প্যানিশ লা লিগা জয়ী ভ্যলেন্সিয়া ফুটবল ক্লাবের কথা। তবে শুরু থেকেই শুরু করা যাক-
একাবিংশ শতাব্দির শুরুতে বেশ সাফল্য পেতে শুরু করে ভ্যালেন্সিয়া। আর এই সাফল্যই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেন? আসছি সে বিষয়ে তবে তার আগে ভ্যালেন্সিয়ার সাফল্যের সিঁড়ির দেখা আগে দেখি। ১৯৯৯/২০০০ মৌসুমে বার্সেলনাকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতে ভ্যালেন্সিয়া, আর এই সে মৌসুমেই লিগ চ্যাম্পিয়ন দেপোর্তিভো লা করুনার থেকে মাত্র চার পয়েন্ট কম নিয়ে মৌসুম শেষ করে ভ্যালেন্সিয়া। সেবার বার্সেলোনার সমান পয়েন্ট নিয়েই মৌসুমের ইতি টানে তারা।
তবে এটিই এই মৌসুমে তাদের সেরা সাফল্য নয়। তাদের সেরা সাফল্য আসে ইউরোপের সর্বোচ্চ সম্মানজনক টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে। ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠে যায় দলটি, তবে ফাইনালে চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হেরে বসে ভ্যালেন্সিয়া। এরপরের মৌসুমে আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলে ভ্যালেন্সিয়া। সেবারও শিরোপা হাতছাড়া।
২০০০/০১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লিডস ইউনাইটেডকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে ভ্যালেন্সিয়া। তবে ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়েও ১-১ সমতায় শেষ হলে ম্যাচ গড়ায় টাই ব্রেকারে। আর টাই ব্রেকারে ৫-৪ ব্যবধানে হেরে হাতছাড়া হয় শিরোপা। চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা দুই মৌসুম ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১/০২ মৌসুমে এসে লা লিগার শিরোপা ধরা দেয় ভ্যালেন্সিয়ার হাতে। এরপর এক মৌসুমে অর্থাৎ ২০০২/০৩’র ব্যর্থ হলেও আবারও ২০০৩/০৪ মৌসুমে লা লিগার শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ভ্যালেন্সিয়া। আর তখনই বড় ক্লাব হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে ক্লাবটি।
দলকে ঢেলে সাজাতে অর্থ ব্যয় করা শুরু করে, ক্লাবের যুব একাডেমির খেলোয়াড়দের উন্নীত করার বদলে। আর এখানেই বড় ভুল করে বসে ক্লাবটি। এর মধ্যে আবার ২০০৩/০৪ মৌসুমে উয়েফা কাপ জেতে ভ্যালেন্সিয়া এবং ২০০৪ সালে উয়েফা সুপার কাপও জয় করে দলটি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একাবিংশ শতাব্দিত প্রথম দশকটা বেশ ভালোই কাটছিল তাদের। আর এই ভালো কাঁটাটাই যেন পরবর্তী সময়ে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্লাবটির জন্য।
কীভাবে এই সাফল্য তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল? নিয়মিত সাফল্য পেতে শুরু করায় ক্লাবটির নজর যায় বড় প্রজেক্টের দিকে। ধীরে ধীরে ক্লাবের জৌলুস বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নেয় ভ্যালেন্সিয়া। যার প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লরেন্তে ঘোষণা দেন এই মুহূর্তে ক্লাবের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩৯ মিলিয়ন ইউরো। আর এই কারণেই ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্লাবের নতুন স্টেডিয়ামের কাজ স্থগিত করে দেওয়া হয়। সে সময় এই স্টেডিয়ামের পেছনে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু ক্লাবের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল দলের সেরা তারকাদের ধরে রাখার মতো ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে ক্লাবটি।
সে সময় জানা যায় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ক্লাবটি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইউরো লোকসান গুনেছে যা সে সময় অনেক বড় একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর ২০০৯ সালের জুন আসতে আসতে ভ্যালেন্সিয়ার ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ৫৪৭ মিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও ক্লাবের ক্ষেত্রে ঋণ কোনো বড় ব্যাপার না যদি ক্লাবে অর্থের প্রভাব ঠিক থাকে এবং ব্যাংককে ঋণের মুনাফা সঠিকভাবে প্রদান করা সক্ষমতা থাকে। তবে এখানেই মুশকিলে পড়ে যায় ভ্যালেন্সিয়া। ব্যাংককে মুনাফা প্রদানের অর্থই উপার্জনে ব্যর্থ হতে থাকে ক্লাবটি। আর ব্যাংকও তখন ঋণ শোধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে।
আর তখনই ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়দের ধরে রাখায় বাধা আসে। আর রাউল আলবিওল, ডেভিড ভিয়া, ডেভিড সিলভা, হুয়ান মাতা, জর্দি আলবার মতো সম্ভবনাময় খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে বাধ্য হয় ভ্যালেন্সিয়া। সে সময় আলবিওলকে রিয়াল মাদ্রিদে, ডেভিড ভিয়াকে বার্সেলোনায়, ডেভিড সিলভাকে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে শুরু করে ভ্যালেন্সিয়া। তবে কেবল খেলোয়াড়দের বিক্রি করেই এত বড় ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আবার ক্লাবের খেলাও পরিচালনা করে যেতে হবে। খেলা বন্ধ করে দিলে ক্লাব নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ভালো খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ক্লাব। কারণ ক্লাবকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালো খেলোয়াড়দের বিক্রি করাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এরপর ২০১৪ সালে পিটার লিম ভ্যালেন্সিয়ার সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেয়, সে সময় ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ইউরোর বেতন বকেয়া ছিল এবং ক্লাবের তহবিলেও ছিল না কোনো অর্থ। এরপর ২০১৯/২০ সালে আবারও ক্লাব তাদের ঋণের অর্থ ফেরত দিতে শুরু করে এবং নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থও উপার্জন করে ক্লাবটি। এর পেছনে কারণ ছিল ২০১৮/১৯ মৌসুমের কোপা দেল রে’র ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে ১১ বছর পর শিরোপা উল্লাস করে ভ্যালেন্সিয়া। আর সেই সঙ্গে ক্লাবের অ্যাকাউন্টে আসতে শুরু করে অর্থ।
তবে মড়ার ওপর খড়ার ঘা হিসেবে আরোপিত হয় করোনাভাইরাস। করোনার কারণে আবারও ভ্যালেন্সিয়ার অর্থ আসা বন্ধ হয়ে যায়। এবং ক্লাব খেলোয়াড়দের বেতন দিয়ে অপরাগতা প্রকাশ করে, সেই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করা বন্ধ হয়ে যায়। তাই তো আবারও ক্লাবের তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় লাটো, কাঞ্জিন এবং ফাররান তোরেসের মতো খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে বাধ্য হয় ভ্যালেন্সিয়া।
২০১৯/২০ মৌসুমে লা লিগায় ৯ম স্থানে থেকে শেষ করে ভ্যালেন্সিয়া। আর তাই তো ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টেও খেলতে পারবে না ক্লাবটি আর তার কারণেই অর্থ আসা কমে যাবে ক্লাবটিতে। আর তাই তো ক্লাবের শেয়ারধারীরা জানিয়েছে ক্লাবের খেলোয়াড় সংখ্যা কমিয়ে খরচ কমানোর কথা।
করোনার প্রভাবে ভ্যালেন্সিয়া প্রায় ৩০ শতাংশ কম অর্থ পাবে টিভি স্বত্ব থেকে। আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণও কমে যাবে ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ক্লাবের মোট উপার্জন কমে যাবে ৫০ শতাংশ। আর এমন পরিস্থিতিতে ক্লাবে বেশি উপার্জন করা খেলোয়াড়দের আর রাখতে পারছে না ভ্যালেন্সিয়া। সেই সঙ্গে ৩০ জনের স্কোয়াড কমিয়ে ছোট করে আনছে ক্লাবটি। কেননা সামনের মৌসুমে কেবল লা লিগায়ই লড়াই করবে তারা। আর এ কারণেই বাড়তি খেলোয়াড়দের কোনো প্রয়োজনই নেই তাদের।
এর আগে ভ্যালেন্সিয়ার অধিনায়করা এবং কিছু খেলোয়াড় ক্লাব প্রেসিডেন্ট অনিল মুর্থির সঙ্গে আলোচনায় বসে। গত জুন থেকেই বেতন ঠিকমত পাচ্ছেন না তারা। এমনটাই জানিয়েছে স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যম কাদেনা কোপ। একই রিপোর্টে আরও জানানো হয় ক্লাবের খেলোয়াড় রদ্রিগো মোরেনো, হোসে লুইস গায়া, জাউমা কস্টা মুর্থির সঙ্গে দেখা করেন। এবং তারা তাদের অখুশির কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রস্তাব দেওয়া হয় বেতনের ব্যাপারে। এই প্রস্তাবে জানানো হয় আগামী জুন পর্যন্ত খেলোয়াড়দের বেতন প্রদানে বিলম্ব ঘটে পারে। তবে এতে করে কোনো প্রকার নিশ্চয়তা থাকছে না যে ক্লাবের খেলোয়াড়রা আদৌ বেতন পাবেন কিনা। আর এ কারণেই ক্লাবের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন খেলোয়াড়রা।
আর ক্লাবের এমন পরিস্থিতিতেই অর্থের জন্য ভ্যালেন্সিয়ার সেরা খেলোয়াড় ড্যানি পারেহো, ফ্রান্সিস কুইলেনকে ভিয়ারিয়ালের কাছে বিক্রি করেছে। এবং তরুণ প্রতিভাবান ফাররান তোরেস নাম লিখিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। সব মিলিয়ে যেন শীর্ষ থেকে শূন্যে নেমে এসেছে স্প্যানিশ এই ক্লাবটি। এক সময় লা লিগা জয়ের জন্য জায়ান্ট ক্লাবদের বিরুদ্ধে লড়ত আর আজ তারাই ঋণের বোঝা টানতে ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দিচ্ছে।
ঋণের বোঝায় ক্লাবের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আগামী মৌসুমে খেলোয়াড়দের ৪০ শতাংশ বেতন কম দেওয়ার কথাও ভাবছে ক্লাবটি এবং প্রথম দলের ১২ ফুটবলারকেই বিক্রির জন্য প্রস্তুত ক্লাবটি।
স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে। দলের সেরা খেলোয়াড়দের প্রতিপক্ষের ডেরায় পাঠিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নেমেছে তারা। ঠিক কীভাবে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে তারা তার নেই কোনো সঠিক সময় কিংবা সঠিক পন্থা।
ঋণে জর্জরিত ঋণের বোঝা ভ্যালেন্সিয়া ফুটবল ক্লাব স্পোর্টস স্পেশাল স্প্যানিশ ক্লাব