ইউরোপের বিলাস ছেড়ে বাংলাদেশি ফুটবলার হতে আসা এক তরুণের গল্প
২০ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১৪
বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে এখনো অভিষেক হয়নি তারিক রায়হান কাজীর। বাংলাদেশের ঘরোয়া পর্যায়ে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দু’টি। তাতেই সদ্য বিশে পা দেওয়া এই তরুণকে নিয়ে ফুটবলপাড়ায় হইচই। তবে সেই হইচই-ও যে অকারণ, তা কিন্তু নয়। তারিক আগ্রহের কেন্দ্রে থাকার মতোই একজন।
জন্ম ফিনল্যান্ডে। ফুটবল জনপ্রিয় দেশটিতে বেড়ে উঠেছেন ফুটলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে তারিকের স্বপ্ন এগুচ্ছিলও দারুণভাবে। তারিক খেলে থাকেন রাইট ব্যাক পজিশনে, ফিনল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৮ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন তিনি। যেভাবে এগুচ্ছিলেন তাতে ফিনল্যান্ডের জাতীয় দলের জার্সিও ডাকছিল তাকে। সেক্ষেত্রে চাকচিক্যময় জীবন, অর্থের ঝনকানি— সবই ছিল তারিকের নাগালের মধ্যেই। সেই তারিকই কি না সবকিছু ছেড়েছুড়ে বাংলাদেশে এসেছেন এ দেশের ফুটবলার হবেন বলে!
তারিক ছুটে এসেছেন পিতৃভূমির টানে। তারিকের মা ফিনল্যান্ডের নাগরিক, কাজ করেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে। আর তারিকের বাবা কাজী শহিদুল আালমের বাড়ি নওগাঁয়। এই মুহূর্তে ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পেরে শহরের ‘ট্যাম্পের ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করছেন। বাংলাদেশে কাজী শহিদুল আলমের নিয়মিত যাতায়াত থাকলেও তারিক সেই ছোটবেলায় বাংলাদেশে এসেছিলেন মাত্র একবার। তবে বাবার মুখে বাংলাদেশের কথা শুনেছেন নিয়মিতই। তাতেই মনে মনে স্বপ্ন বুনেছিলেন, বাবার দেশের হয়েই খেলবেন জাতীয় পর্যায়ে। ফিনল্যান্ডের মতো দেশের জীবনযাপন ছেড়ে তারিক বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন সে কারণেই।
বাংলাদেশের এসে ক্লাব পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন অনেক আগে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ফুটবল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ক্লাবটির হয়ে মাত্র দু’টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। সেই ম্যাচ দু’টি যারা দেখেছেন, তারা সবাই কিন্তু দারুণ সন্তুষ্ট। বাংলাদেশ ‘এমন’ একজন ফুটবলার পেতে যাচ্ছে, তা ভেবে তারা আনন্দিত।
দুই ম্যাচের পারফরম্যান্সের পেছনের গল্পটা অবশ্য গড়ে উঠেছে ফিনল্যান্ডে। সেখানে চারটি বয়সভিত্তিক দলে নিয়মিত খেলা ফুটবলারটির পারফরম্যান্স নিয়ে আসলে সংশয় ছিল না আগে থেকেই। ক্লাব পর্যায়ে ফিনল্যান্ডের অন্যতম সেরা ক্লাব ইলভেস টেম্পেরের হয়ে খেলতেন তারিক। ২০১৯ সালেও যে ক্লাবটি ফিনিশ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ক্লাবটি নিয়মিতই খেলে থাকে ইউরোপা লিগে। ইলভেস টেম্পেরের হয়ে তারিক নিজেও ইউরোপা লিগের বাছাই পর্ব খেলেছেন।
এতদিনে বাবার দেশের জার্সিতে মাঠে নামার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার কথাও ছিল তারিকের। বাংলাদেশ-নেপাল আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের প্রাথমিক দলে ছিল তার নাম। অনুশীলনও করলেন ক’দিন। তবে অনুশীলনে পুরনো চোটের জায়গায় নতুন করে চোট পেলেন বলে স্বপ্ন পুরণের আগ মুহূর্তে বাদ পড়তে হয়েছে। চোটের কারণে দল থেকে বাদ পড়ার পর তারিক সংবাদমাধ্যমকে বলছিলেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমাকে এখন জাতীয় দলের ক্যাম্প ছাড়তে হচ্ছে। তবে হতাশ হচ্ছি না, শিগগিরই দেখা হবে।’
জাতীয় দলের হয়ে এখনো মাঠে নামার সুযোগ না পেলেও বাংলাদেশে কাটানো সময় যথষ্টই উপভোগ করছেন তারিক। এরইমধ্যে নাগরিকত্বও পেয়েছেন। তবে বাংলাদেশের আবাহওয়াটাই এখন পর্যন্ত তার সামনে প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে। ইউরোপের ফিনল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়ার পার্থক্য যে আকাশ-পাতাল। সবুজে ঘেরা নান্দনিক প্রকৃতির হিম-শীতল ফিনল্যান্ড যখন বরফে আচ্ছাদিত থাকে, তখন ঢাকার তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করে। শিশুকাল থেকেই বরফের মধ্যে বেড়ে উঠে এই তারুণ্যে এসে ভ্যাপসা গরমের বাংলাদেশে মানিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সেই মানিয়ে নিতে কতটুকু সময় লাগবে— প্রশ্ন সেটিই। তারিক অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘এসব কোনো সমস্যা নয় আমার কাছে।’
প্রবাসী তারকা ফুটবলারদের বাংলাদেশে খেলতে আসার ঘটনা কম নয়। সবাইকেই পড়তে হয়েছে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জে। এই চ্যালেঞ্জ জয় করে সফল হতে পেরেছেন কেবল জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। ২০১৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের নজরে পড়ে জাতীয় দলে আসেন ডেনমার্কে বেড়ে উঠা বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত জামাল। সেই জামাল আজ বাংলাদেশ ফুটবলের পোস্টারবয়। তারিককে ভাবা হচ্ছে জামালের চেয়েও প্রতিভাবান। ৫ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সুঠাম শরীরের অধিকারী তরুণ এই ফুটলার নিজেও চাইছেন বাংলাদেশ ফুটবলের অংশ হতে। তারিক একবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ফিনল্যান্ড এখন আমার কাছে অতীত। বর্তমান হচ্ছে শুধুই বাংলাদেশ।’’
বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা তরুণ তারিককে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারেন!
জামাল ভুঁইয়া তারিক রায়হান কাজী ফিনল্যান্ড প্রবাসী ফুটবলার তারিক বাংলাদেশ ফুটবল বাংলাদেশ ফুটবল দল