‘ম্যারাডোনা’ নামটা বেঁচে থাকবে চিরকাল…
২৬ নভেম্বর ২০২০ ০৩:৩৪
দিয়াগো ম্যারাডোনা বল পায়ে বিশ্বজয় করেছিলেন— কথাটা ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি ফুটবলার রোমারিওর। কত বড় একটি কথা! একভাবে চিন্তা করলে খেলাধুলা চিত্তবিনোদনের একটি অংশমাত্র। তা দিয়েই বিশ্বজয়! বিশ্বজয়ী সেই মানুষটা আর নেই।
মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পর গত মাসে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতেই ছিলেন ম্যারাডোনা। তবে মাদকাসক্তি নিয়ে সারাটা জীবনই ভোগা আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির শারীরিক সমস্যার অন্ত ছিল না। স্থানীয় সময় বুধবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ম্যারাডোনা। খবর পেয়ে মুহূর্তেই তার বাড়িতে পৌঁছে যায় ৯টি অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু একটুও সময় দিলেন না চোখের পলকে কত শত গোলরক্ষককে বোকা বানানো ম্যারাডোনা। চিরবিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। দেহত্যাগ করলেও ম্যারাডোনা নামটা নিশ্চয় ফুটবলে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
আর্জেন্টিনা ফুটবলে হতাশা বাড়লে ম্যারাডোনার নাম নিয়ে নিশ্চয় আফসোস হবে। সাফল্য পেলে উল্লাসেও নিশ্চয় ম্যারাডোনার নাম থাকবে। সবুজ মাঠে বাঁ-পায়ে কোনো ফুটবলার জাদু দেখালে নিশ্চয় দূর থেকে কেউ বলে উঠবেন— ‘ম্যারাডোনার মতো খেলছে’! বিশ্বকাপে কেউ তাক লাগানো ফুটবল খেললেও নিশ্চয় ম্যারাডোনার নামে তুলনা হবে। শুধু মাঠের ফুটবলে নয়, ম্যারাডোনা নামটা বেঁচে থাকবে মাঠের বাইরের আবেগেও। একটি শ্রেণির মানুষের মনে ফুটবলপ্রেম সৃষ্টি করেছেন যে এই ম্যারাডোনাই।
বিশ্বে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যখন সরাসরি রঙিন টিভিতে খেলা দেখা শুরু করে, ম্যারাডোনা বল পায়ে জাদু দেখিয়েছেন তখনই। ফুটবলের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের সখ্য আদিকাল থেকেই। তবে সেটার পালে জোরালো হাওয়া লাগিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দেওয়া এবং ইতালির মাঝারি মানের ক্লাব নাপোলিকে সেরাদের কাতারে তুলে আনা ‘বীর’ ম্যারাডোনা এ দেশের ফুটবল জনপ্রিয়তায় ভালো ভূমিকাই রেখেছেন। এমন একজনের নাম কি আর সবাই ভুলে যেতে পারে! ম্যারাডোনা অমরত্ব পেয়েছেন সেই ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ শেষেই। একজন খেলোয়াড় কীভাবে কোনো দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন, তা দেখিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টিনা দলে সেবার সের্হিও বাতিস্তা, দানিয়েল পাসারেলা, হোর্হে লুইস বুরোচাগা, হোর্হে ভালদানোর মতো খেলোয়াড় থাকলেও দলটিকে ফেভারিট ধরেনি কেউ। ম্যারাডোনা একক নৈপুণ্যে এই ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন। ওই বিশ্বকাপে মোট ১৪ গোল করেছিল আর্জেন্টিনা, যার ১০টিতেই সরাসরি অবদান ম্যারাডোনার! পাঁচটি নিজে করেছেন, পাঁচটি অন্যদের দিয়ে করিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার পারফরম্যান্স ফুটবলের বড় বিস্ময়গুলোর একটি।
আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে ম্যাচটিকে ঘিরে আগে থেকেই উত্তেজনা ছিল। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের ৫১ মিনিটে রেফারির চোখকে ফাঁকি দিয়ে হাত দিয়ে গোল করেন ম্যারাডোনা। পরে ইচ্ছা করে হাত দিয়ে গোল করার বিষয়টি স্বীকার করে সেটাকে ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ নাম দিয়েছেন ম্যারাডোনা। ওই গোলের চার মিনিট পর আর্জেন্টিনা কিংবদন্তি যে গোলটা করেছিলেন, পরে সেটা বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা গোল নির্বাচিত হয়। মাঠে নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে ইংল্যান্ডের পাঁচ ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষককে কাটিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামকে. ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে সতীর্থের কাঁধে চড়ে শোনালি ট্রফিতে যেভাবে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা, সেই ছবি কোনো দিনই ভোলার মতো নয়।
আর্জেন্টিনার হয়ে টানা চার বিশ্বকাপ খেলা ম্যারাডোনা জাতীয় দলের হয়ে মোট ম্যাচ খেলেছেন ৯১টি, যাতে গোল করেছেন ৩৪টি। ক্লাব ফুটবলে ৫৮৯ ম্যাচ খেলে ৩১১ গোল করেছেন। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স হয়ে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি’তে বার্সেলোনায় এসেছিলেন ১৯৮২ সালে। বার্সার তৎকালিন সভাপতি ইয়োসেপ লুইস নুনেজের সঙ্গে বারবার ঝামেলায় জড়িয়ে দুই বছর পরই স্পেনের ক্লাবটি ছেড়ে আরেকটা ট্রান্সফার রেকর্ড গড়ে নাপোলিতে যান ম্যারাডোনা।
সেই সময়কার ইতালির মাঝারি মানের দল নাপোলিকে একক নৈপুণ্যে একাধিক সিরি ‘আ’ লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়েছেন আর্জেন্টিনা কিংবদন্তি। অনেকে বলেন, আর্জেন্টিনা থেকে ইউরোপে আসার পরপরই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন ম্যারাডোনা। বার্সেলোনায় থাকতে টুকটাক মাদক নিতেন, নাপোলিতে গিয়ে নাকি সেটা বেড়ে যায়। মাদক আর ছাড়তে পারেননি। ম্যারাডোনার ব্যাক্তি জীবন ও ফুটবল ক্যারিয়ারের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে মাদক। ১৯৯১ সালে ইতালিতে কোকেইন টেস্টে ধরা পড়াতে ফুটবল থেকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই ধাক্কার কারণেই স্বপ্নের নাপোলি ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তবে ইতালির ক্লাবটির অনেকে এখনো পুজা করে ম্যারাডোনাকে। আর্জেন্টিনা কিংবদন্তির সম্মানার্থে তাদের ১০ নম্বর জার্সিটি চিরদিনের জন্য তুলে রেখেছে নাপোলি।
মাদক ক্যারিয়ারের শেষভাগেও ভুগিয়েছে ম্যারাডোনাকে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ইফিড্রিন টেস্টে পজেটিভ হওয়ার কারণে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। আর্জেন্টিনাও সেবার সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে জাতীয় দল ও ১৯৯৮ সালে ক্লাব ফুটবল ছাড়া ম্যারাডোনা পরে কোচিংয়ে মন দিয়েছিলেন। অল্প অভিজ্ঞতায় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচও হয়েছিলেন। তার অধীনেই ২০১০ সালের বিশ্বকাপ খেলেছিল লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। কিন্তু কোচিংয়ে একদমই সফল হতে পারেননি ম্যারাডোনা। কিছুদিন আগে আর্জেন্টিনার ক্লাব জিমনাসিয়ার কোচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন এই দায়িত্ব ছাড়ার আগেই।
কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার?— এই প্রশ্নে ম্যারাডোনার সঙ্গে যার নাম নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে, সেই পেলে মৃত্যুর খবর শুনে টুইট করেছেন, ‘আশা করি, আমরা একদিন স্বর্গে ফুটবল খেলব।’ সেই ম্যাচে কে জিতবেন!
আর্জেন্টিনা কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যু পেলে বিশ্বকাপ ফুটবল