Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিস্ময়ের নাম রাকিম কর্নওয়াল

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৭ জানুয়ারি ২০২১ ১২:৪৩

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অনুশীলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে একটি দৃশ্য খুব চোখে পড়ে- জনৈক এক ক্রিকেটারের দিকে উপস্থিত ক্যামেরাপারসন ও ফটো সাংবাদিকেরা লেন্স তাক করে আছেন। কীভাবে তিনি বল করছেন, ব্যাট করছেন, দৌঁড়াচ্ছেন সেটাই তাদের সংবাদের প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। বিস্মিত হই যখন দেখি তার হাঁটাও ক্যামেরার চোখ খুঁজে নিচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে তাদের অনুসরণ করি। এবং এক পর্যায়ে আবিষ্কার করি, আর কেউ নয় ক্যারিবিয়ান ‘বিগ ম্যান’ ও বিগ মাউন্টেন খ্যাত রাকিম কর্নওয়ালকেই দেশের তাবৎ গণ মাধ্যমের ক্যামেরা খুঁজে ফিরছে। এবং এই বিস্ময় স্রেফ তাকে ঘিরেই।

অবশ্য শুধু ক্যামেরাপারসন কিংবা ফটো সাংবাদিকরাই নন, সংবাদ প্রতিবেদকেরাও শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ১নং প্লাজার ও গ্রিলে শরীর লাগিয়ে লম্বা সময় ব্যাপী তাকে অবলোকন করেন।

কেনই বা করবে না বলুন? রাকিম কর্নওয়ালের যে শারীরিক গঠন তা আধুনা ক্রিকেটের সঙ্গে যে একেবারেই বেমানান। বিশেষ করে তার ওজন। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই অ্যান্টিগান অফস্পিনিং অলরাউন্ডারের ওজন ১৪০ কেজি! আধুনিক ক্রিকেটে লিকলিকে শরীর সর্বস্ব ফিটনেসের জন্য ক্রিকেটাররা যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে ব্যয় করেন, খোলা মাঠে রানিং করেন রাকিম সেখানে ১৪০ কেজি ওজন নিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের স্কোয়াডে জায়গা করে নেন! তাও বেশ দাপটের সাথে। তাছাড়া তার অনুশীলনের ধরণটাও ভিন্ন। আধুনিক যুগে ক্ষিপ্রতা যেখনে ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ সেখানে রাকিন যেন ভিন্ন পুরোদস্তুর ভিন গ্রহের। ভীষণ ধীর তার চলার গতি। পায়ের সামনে দিয়ে বল চলে যাচ্ছে অথচ তিনি তা তাকিয়ে দেখছেন। ভাবখানা এমন কেউ একজন বলটি ধরে তাকে দিলে তিনি বেঁচে যান। রাকিমের হালচাল দেখে মনে হবে এমন অলস ক্রিকেটার বুঝি ধরাধামে আর দুটি নেই। হয়তবা সেটা বুঝেই কোচ ফিল সিমন্স তাকে নিয়ে আলাদা গা গরমের সেশন করেন।

তাকে দেখে বিস্ময়ের কারণ অবশ্য আরও একটি আছে। সেটা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কোনো ক্রিকেট দলেই একই সাথে এমন ভারী ও দীর্ঘকায় ক্রিকেটার দেখা যায় না। ৯০ এর দশক ও এরপরে পাকিস্তানের ইনজামাম-উল-হক, দক্ষিণ আফ্রিকার প্যাট সিমকক্স ও ইংল্যান্ডের ড্যারেন গফের পরে সম্ভবত এমন দীর্ঘ ও ভারীদেহী ক্রিকেটার আর আসেনি। যদিও রাকিম তাদের সবাইকেই ছাড়িয়ে গেছেন।

রাকিম কর্নওয়ালের জন্ম ১৯৯৩ সালে ক্যারিবিয় দ্বীপ অ্যান্টিগায়। ডানহাতি এই অফস্পিনার ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড একাদশে ডাক পান। ওই প্রথম তার জাতীয় দলের চৌহর্দেতে পা রাখা। এসেই ব্যাটে-বলে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে সেই যে টিম ম্যানেজমেন্টের মন জয় করেন এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেবার শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে খেলেন সর্বোচ্চ ৪১ রান, সঙ্গে ৫টি উইকেটও আদায় কের নেন।

একই দলের হয়ে ২০১৭ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস খেলেন। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই, ইংলিশ বোলিং তোপে ৫৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড একাদশ। সেখান থেকে ব্যক্তিগত ৫৯ ও দলীয় ১২৩ রানের জুটিতে এক রকম একাই দলকে টেনে তোলেন এই ‘বিগ ম্যান।’ শুধু ব্যাটেই নয় বোলিংয়েও নামের পাশে ১ উইকেট যোগ করেছিলেন। এবং তার এই পারফরম্যান্সে ছোট খাট পরাজয়ে মান বাঁচে স্বাগতিকদের। ওই বছরই আবার সেই দলের হয়ে খেলেন সফরকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে।

তার আগে ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের হয়ে লঙ্কা সফরে ডাক পান এবং সেখানে তিনটি আনঅফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচ খেলেন রাকিম। সফরে ব্যাট হাতে হতাশ হলেও ২৩ উইকেট নিয়ে সিরিজ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের খেতাব জেতেন। ২০১৭ সালে গায়নার বিপক্ষে চার দিনের আঞ্চলিক ক্রিকেটে কাইরন পাওয়েল এর অনুপস্থিতিতে লিওয়ার্ড আইল্যান্ডসের অধিনায়কত্ব করেন রাকিন। প্রতিযোগিতায় তিনি যুগ্মভাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেন, যা ছিল তার দলের হয়ে সর্বোচ্চ।

ছোট্ট ক্যারিয়ারে থেমস ডিটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ইংল্যান্ডে ও তার বেশ কয়েক মাস কেটেছে। ক্লাবটির বিপজ্জনক বোলার এবং বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হিসেবে বেশ পরিচিতও হয়ে উঠেছিলেন রাাকিম।

২০১৭ সালে সেইন্ট লুসিয়া স্টারসের হয়ে প্রথমবারের মতো ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় রাকিম কর্নওয়ালের। সেইন্ট লুসিয়ার ভরাডুবি মৌসুমেও সেবার সেরা ব্যাটিং গড় ও সবচেয়ে খরুচে বোলিংয়ে দলের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল প্লেয়ারের মুকুট জেতেন এই ডানহাতি অফ স্পিনার।

২০১৮-১৯ রিজিওনাল সুপার-৫০ টুর্নামেন্টে লিওয়ার্ড আইল্যান্ডসের জার্সি গায়ে ১৪ ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা বোলার বিবেচিত হন। একই বছর চারদিনের আঞ্চলিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ৯ ম্যাচে ৫৪ উইকেট নিয়ে হন টুর্নামেন্ট টপার। এবং তার এই ঝলমলে পারফরম্যান্সেই তার দলকে টেবিলের তিনে জায়গা করে দেয়।

এরপরেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৯ সালের আগস্টে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট স্কোয়াডে ডাক পান কর্নওয়াল। এবং অবিশ্বাস্যভাবে ১৪০ কেজি ওজন নিয়ে খেলতে নেমেও অভিষেক টেস্টে ভারতের তিন ব্যাটসম্যানকে ড্রেসিংরুমের পথ দেখিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের নজর কাড়েন।

ঠিক তিন মাস পরে আবার ডাক আসে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে। নভেম্বরে ভারতের লক্ষ্ণৌয়ে কাবুলিওয়ালাদের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত একমাত্র টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে সাদা পোশাকে উইন্ডিজ দলে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নেন। তবে গেল বছরের জুলাইয়ে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করোনাকালে গড়ানো টেস্ট সিরিজে নামে সুবিচার করতে পারেননি ‘বিগ মাউন্টেন।’ কেননা বল হাতে নামের পাশে কোনো উইকেট যোগ না করেই ফিরতে হয় দেশে।

এই পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তিন টেস্টে শিকার করেছেন ১৩ উইকেট। সেরা বোলিং ইনিংস ৭৫ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট। প্রতিটি উইকেটের পেছনে খরচ করছেন ৩৫ দশমিক ২৩ রান।

ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার পারফরম্যান্স দারুণ জ্বলজ্বলে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৬৫ ম্যাচ থেকে সংগ্রহ করেছেন ৩১০ উইকেট। সেরা বোলিং ইনিংস ৫১ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট। ২৪ দশমিক ০৯ রান গড়ে তিনি উইকেটগুলো থলিতে পুরেছেন।

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ৫০টি ম্যাচ থেকে সংগ্রহ করেছেন ৬২ উইকেট। সেরা বোলিং ইনিংস ২১ রনের বিনিময়ে ৪ উইকেট। প্রতিটি উইকেটের পেছনে তার খরচ ২৫ দশমিক ৬১ রান।

সেই রাকিম এবার এসেছেন বাংলাদেশ সফরে। দেখা যাক সাদা পোষাকে সাকিব-তামিমদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে তিনি কতটা সফল হতে পারেন।

সারাবাংলা/এমআরএফ/এসএস

উইন্ডিজ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ টপ নিউজ বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ রাকিম কর্নওয়াল রাকিম কর্নওয়েল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর