আহামরি কিছু করেছি বলে মনে করছি না: তাসকিন
১৪ মে ২০২১ ১২:১৪
সদ্যই শেষ হওয়া শ্রীলংকা সফরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি? যে কেউ একবাক্য বলবেন, তাসকিন আহমেদের ফেরা। দুই টেস্টেই তার বোলিং দেখে মনে হয়েছে যেন ক্যারিয়ারের ঊষা লগ্নের সেই তাসকিন, যার গতিময় বলে হরহামেশাই লণ্ডভণ্ড হতো প্রতিপক্ষের সুসজ্জিত ব্যাটিং লাইনআইপ। এখানে বরং তার চেয়েও রুদ্র তিনি! বলে গতি যেমন বেড়েছে, তেমনি মুহুর্মুহু আদায় করে নিয়েছেন বাউন্সার ও মুভমেন্ট। এখানেই শেষ নয়। তার এক্সপ্রেস বলের চোখ রাঙানিও দেখেছে সিংহের রাজ্য।
প্রথম টেস্টে পাল্লেকেলের নিস্প্রাণ ওই পিচে লংকানদের একটি উইকেট যখন বাংলাদেশের বোলারদের জন্য সোনার হরিণ হয়ে উঠেছিল তখন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বাগতিকদের রানের চাকা থামিয়ে ম্যাচ ড্র’য়ে অবদান রেখেছেন তাসকিন। রানের পাহাড় গড়ে ম্যাচ জয়ের লক্ষ্যে যে উইকেটে স্বাগতিকরা বোলারদের জন্য হুল বিছিয়ে রেখেছিলেন সেখানেই ফুল ফুটিয়েছেন লাল সবুজের এই গতি তারকা। অমন কন্ডিশনে এমন বোলিং এদেশের হয়ে কে করেছে, কে-ই বা দেখেছে কোন কালে?
তো কী করে সম্ভব হল? সারাবাংলার সঙ্গে আড্ডায় পেছনের সেই গল্প শুনিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী এই পেসার। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেছেন বোলিং নিয়ে নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও শ্রীলংকা সিরিজের লক্ষ্যসহ আরো নানান বিষয়ে। সারাবাংলার পাঠকদের উদ্দেশে তা তুলে ধরা হল-
সারাবাংলা: শ্রীলংকার ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে অমন বল করে দেশে ফেরার পর থেকেই সংবাদমাধ্যম আপনার সঙ্গে কথা বলতে, আপনার একটি সাক্ষাৎকার পেতে মুখিয়ে আছে। এই ব্যাপারটি কেমন উপভোগ করছেন? কতটা মধুর এই যন্ত্রণা?
তাসকিন: সত্যি বলতে মিডিয়ার সঙ্গে এত কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। তাছাড়া বিষয়টি যে খুব মধুর তাও না। কারণ আমি চেয়েছিলাম আরও ভাল কিছু অর্জন করার পরে সাক্ষাৎকার দিব। যদি ওখানে আরেকটু ভাল করতাম সাক্ষাৎকার দিতেও ভাল লাগত। কারণ আমি আমার লক্ষ্য অনুযায়ী কিছুই করিনি। এটা স্রেফ একটা ম্যাচ ছিল। ক্যারিয়ারের একটা খেলা ছিল। হয়ত মোটামুটি ভাল হয়েছে, মরা উইকেটে কিন্তু আহামরি কিছু করেছি বলে মনে করছি না।
সারাবাংলা: পাল্লেকেলের ওমন নিস্প্রাণ উইকেট, যেখানে প্রথম টেস্টে বোলারদের জন্য কিছুই ছিল না। সেখানে আপনি অমন বৈচিত্র্যময় বোলিং করলেন এবং সাফল্যও পেলেন! এটা কী করে সম্ভব হল?
তাসকিন: সত্যি বলতে গত দেড় বছর আমি আমার প্রক্রিয়ায় অটল ছিলাম। আর হচ্ছে আমি ফোকাস করছিলাম এক একটা বল একেক রকম করে করতে। এটাও ঠিক করেছিলাম যাই হোক ৩০-৩৫ ওভার বল করবই। একটা পর্যায়ে গিয়ে ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু আমি চেষ্টা মানিসিকভাবে শক্ত থেকে এক একটা বল করার।
সারাবাংলা: ঠিক এক বছর আগের কথা। দেশে তখন কঠোর লকডাউন চলছে। ভর দুপুরে বসিলার মাঠে তপ্ত বালুতে কোমরে টায়ার বেঁধে দৌঁড়িয়েছেন। বাসার গ্যারেজে বোলিং অনুশীলন করেছেন দিনের পর দিন। সেই কষ্ট আজ স্বার্থক মনে হচ্ছে?
তাসকিন: জ্বি, অবশ্যই। মাঝখানে আমার পেস পড়ে গিয়ে ১২৮-১৩০ কিলোমিটারে নেমে এসেছিল। সেখানে এখন গড়ে ১৩৯-১৪০ কিলোমিটারে বল করতে পারছি। এক্সপ্রেস ডেলিভারি ১৪৪-১৪৫ কিলোমিটার বেগে হচ্ছে। এর কারণ শুধুই কঠোর পরিশ্রম ও আল্লাহর রহমত। এছাড়া আর কিছুই না।
সারাবাংলা: ভবিষ্যতে সর্বোচ্চ কত গতিতে আপনি বল করতে চান?
তসকি[ন: আসলে শীর্ষ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমি যদি ভাল এরিয়ায় ১৪০ কিলোমিটার বেগে বল করতে পারি, সিমে হিট করতে পারি ভাল কিছুই হবে। হ্যাঁ, ১৫০ কিলোমিটারে বল করার ইচ্ছেটা আমার সবসময়ের।
সারাবাংলা: প্রথম টেস্টে অমন ব্যাটিং বান্ধব উইকেটেও আপনি বলে বেশ ভাল মুভমেন্ট আদায় করে নিয়েছেন। বিশেষ কোন টেকনিক কী ওখানে প্রয়োগ করতে হয়েছিল নাকি উইকেটের সহায়তাও ছিল?
তাসকিন: আসলে উইকেটা অবশ্যই ফ্ল্যাট ছিল। কিন্তু আমার ভাল লাগছিল একারণেই যে বল হিট করলে যাচ্ছিল। এফোর্ট বলটা আমার চাওয়া মতই যাচ্ছিল। উইকেটে কোন মুভমেন্ট ছিল না।
সারাবাংলা: সতীর্থরা আপনার বেশ কয়েকটি ক্যাচ ফেলেছে। আফসোস হচ্ছিল নিশ্চয়ই?
তাসকিন: কখনো কখনো অবশ্যই খারাপ লাগে। বিশেষ করে মাঠের বাইরে। কিন্তু আমি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পছন্দ করি না। যেহেতু এটা দলের খেলা।
সারাবাংলা: টপ লেভেলের ক্রিকেটে এমন ক্যাচ মিস কতটা হতাশাব্যঞ্জক?
তাসকিন: ভাল লাগে না কিন্তু কিছু করারও নেই। খেলার অংশ।
সারাবাংলা: কোচ হিসেবে আপনি কোর্টনি ওয়ালশ, শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ডট এবং ওটিস গিবসনকে পেয়েছেন। এর মধ্যে কার সঙ্গে কাজ করাটা বেশি উপভোগ্য?
তাসকিন: সত্যি কথা বলতে স্থানীয় কোচদের মধ্যে সুজন স্যার (খালেদ মাহমুদ) আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এবং তার কথা আমি শুনি। বিদেশি ও দেশি সব কোচদের বেসিক থিওরি কিন্ত একই। তবে বলার ধরণ ও বুঝানোর ধরণ ভিন্ন। আপনি যাদের কথা বললেন এদের মধ্যে ওটিস গিবসনের সঙ্গে আমি বেশি কাজ করেছি। ওয়ালশ তার আগে লম্বা সময় ছিল। তবে গিবসনের সঙ্গে কাজ করাটা বেশি উপভোগ করি, ওনার সঙ্গে আমি স্বাচ্ছন্দ।
সাারাবাংলা: শ্রীলংকার অমন গরমে এত জোরে এতগুলো ওভার বল করা কেমন কঠিন ছিল?
তাসকিন: অবশ্যই কঠিন ছিল। একই সঙ্গে এটা কিন্তু আমার কাজ, আমার চাকুরি, আমার রুজি। যদি মনে করি উফ কী গরম! আমার সেরাটা দিতে পারব না, এটা ঠিক হবে না। আমি ওই চিন্তা একবারও করিনি। আমি এও ভাবিনি ইনজুরিতে পড়তে পারি। আমি একটা কথাই ভেবেছি, দেশের জন্য যখন খেলতে নামব প্রতিটি বলই আমি জান দিয়ে করব।
সারাবাংলা: আপনার অমন বোলিংয়ের পর ড্রেসিংরুমের আবহটা কেমন ছিল?
তাসকিন: সিনিয়র থেকে জুনিয়র প্লেয়ার সবা্ই সাপোর্ট করেছে, টিম ম্যানেজমেন্ট প্রশংসা করেছে যে আমি আমার সেরাটি দিচ্ছি। এমনকি ক্রিকেট বোর্ড থেকেও প্রশংসা পেয়েছি। আসলে আমি এটাই করতে চাই সবসময়। সেরাটি দিয়ে স্মার্টলি হ্যান্ডেল করে ভাল করতে চাই।
সারাবাংলা: শ্রীলংকা সফরে আপনর অতৃপ্তি?
তাসকিন: আমার ইচ্ছে ছিল এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাওয়ার। কিন্তু আমি পাইনি।
সারাবাংলা: সামনেই শ্রীলংকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ। সেখানে আপনার লক্ষ্য কি থাকবে?
তাসকিন: সত্যি কথা বলতে আমি ভাল কিছু করতে চাই, ম্যাচ উইনিং স্পেল করতে চাই। আসলে এইগুলো তো স্বপ্নের জায়গা। তো এখানে ভাল করতে আমি আমার প্রক্রিয়াগুলো অবলম্বন করছি। হয়ত সবসময় বলে বলে উইকেট নেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু আমি বাইরের প্রক্রিয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
সারাবাংলা: ক্যারিয়ার শেষে নামের পাশে কতগুলো উইকেট দেখতে চান?
তাসকিন: অনেকগুলো (হাসি)। আসলে অমন নির্দিস্ষ্ট কোন সংখ্যা নেই। তবে সব ফর্মেটেই ভাল করতে চাই।
সারাবাংলা: দুই বছর আগের তাসকিন ও এই তাসকিনের মধ্যে পার্থক্য কতখানি? এই তাসকিন কতটা পরিপক্ক?
তাসকিন: বাধ্য হয়ে পরিণত (হাসি)।
সারাবাংলা: ঈদে কী করবেন?
তাসকিন: এই মহামারির মধ্যে ঈদ নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া আমার সেই সার্কেলও নেই। আমি আসলে ভাল খেলার জন্য, সুস্থ্য থাকার জন্য অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছি। সেজন্য তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া সামনে অনেক খেলা। দোয়া করবেন।
সারাবাংলা/এমআরএফ/এসএস/এসএইচএস