Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জালাল আহমেদ চৌধুরী—আমাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

সাইদুর রহমান শামিম
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:০১

ঢাকা: প্রায় পাঁচটি নির্ঘুম রাতের পর গভীর ঘুমে কাটল গত রজনী। আহ! টেনশনমুক্ত গভীর ঘুম। কোনো অলৌকিক সু-সংবাদের আশা নেই। সেলফোনের রিংটোনের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙিয়ে কেউ শোনাবে না হৃদয় দুমড়েমুচড়ে দেওয়া সংবাদ। চোখ যা দেখেছে তাই সত্য। কোনো আশা নেই, মিরাকল নামের প্রিয় শব্দটা নিয়েছে ছুটি। জালাল আহমেদ চৌধুরী এখন শুধুই স্মৃতি।

মঙ্গলবার শেষ বিকেলে শীতল কাঁচের ঘরে তার নিষ্প্রাণ মুখ আর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ দুটো দেখছিলাম প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তার আশেপাশে ঘুরেছি, এমন কোনোদিন ঘটেনি তিনি আমার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেছেন। এমনকি হাসপাতালের আইসিইউ’তে শয্যা নিয়েও তার পরিবারের এক সদস্যকে আমার টেলিফোন নম্বর দিয়ে জানাতে বলেছেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তার উপর নির্ভর করে, আস্থা রেখে অভ্যস্ত আমি বেমালুম তা বিশ্বাস করেছি। শেষ পর্যন্ত কোনোকিছুই ঠিক হয়নি, হবেও না।

বিজ্ঞাপন

তাকে শেষ শয্যায় শুইয়ে রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছি, আমার আর উৎকণ্ঠা রইল না, জালাল চৌধুরীকেও বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হবে না। বছর কয়েক ধরে নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা, ছোটখাটো শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস দেখে অনুভব করতাম গেল রাতটা কতটা যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন তিনি। ফোন করে অনুযোগের সুরে বলতাম, ‘জালাল ভাই, রাত জাগবেন না। সিগারেট ছাড়ছেন তো ?’ আশ্বস্ত করতেন। তার কাছের লোকেরা জানেন, সিগারেট ত্যাগ সংক্রান্ত কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে তিনি পুরো বাক্য শেষ করতেন না, কিছু একটা আওড়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতেন।

আট ও নয়ের দশকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ও বিদগ্ধ কোচ হয়েও অন্যান্যদের চেয়ে তার কোচিং মেথড ছিল আলাদা, অবশ্যই আধুনিক এবং মানবিক। শীষ্যদের শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মনস্তাত্বিক শক্তি বা দুর্বলতার খবরটাও তিনি রাখতেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। বিশ্বাস করতেন একজন খেলোয়াড় মানসিকভাবে ক্লান্ত থাকলে তার কাছ থেকে অনুশীলন কিংবা ম্যাচ, কোথাও প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স পাওয়া যাবে না। জোর করে আদায় করার চেষ্টা করলে দলের ক্ষতি হবে, ওই খেলোয়াড়ের শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে। ক্রিকেট দলগত খেলা, দলের সবাই একাট্টা না হলে সাফল্য আসবে না, এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। পাশাপাশি প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বাতন্ত্র্যবোধ, ব্যক্তিত্ব-রুচি এবং মানসিক গঠন পর্যবেক্ষণ করে সেই অনুযায়ী উজ্জীবিত করার চেষ্টা ছিল তার। এজন্যই দলের সব খেলোয়াড় ভাবতে পছন্দ করত—জালাল চৌধুরী তাকে, তার অনুভূতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এভাবেই ব্যক্তি খেলোয়াড়কে দলের সঙ্গে একাত্ম করতেন। পাশাপাশি খেলা কিংবা অনুশীলন সেশনকে উপভোগ্য করার চেষ্টাটাও ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিজ্ঞাপন

নতুনত্ব, অভিনবত্ব ছিল তার ট্রেনিং শিডিউলে অন্যতম অলংকার। একটি ঘটনার কথা আজও মনে আছে। পেস কিংবা স্পিন—দিনের পর দিন টানা বোলিং অনুশীলন ছিল বোলারদের জন্য কঠোর পরিশ্রম আর একঘেয়ে সেশন। বোলারদের চাঙ্গা করতে একবার দলের অনুশীলনে কংক্রিট উইকেটে বোলিংয়ের বিভিন্ন স্পটে ২০, ৫০, ১০০ ও পাঁচশো টাকার নোট স্কচটেপ দিয়ে আটকে দিলেন। এরপর ঘোষণা করলেন বোলিংয়ে যে যে নোটে বল লাগাতে পারবে সেই নোটটি তার। বোলাররা প্রবল উৎসাহ নিজেদের লেংথ লাইন নির্ভুল করতে ঘণ্টা দুয়েক বল করল। অনুশীলন হলো চমৎকার, নোট প্রাপ্তির সম্ভাবনা বোলারদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো, সফল হলো কোচের উদ্দেশ্য।

নিজের পকেটের টাকা অবলীলায় খরচ করে উপভোগ্য অনুশীলন সেশনের আয়োজন করা মোটেই হেলাফেলার ব্যাপার নয়। মনে রাখা দরকার, সে সময় কোচ বা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক আকাশছোঁয়া ছিল না, ক্রিকেট মাঠে লাখ বা কোটি টাকার উড়াউড়ি তখনো শুরু হয়নি। নিজের ক্লাবের ক্রিকেটারদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের তরুণ ক্রিকেটারটির জন্যও পরামর্শের দরজা খোলা রাখতেন। ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে আমাদের পাশের নেটে অনুশীলন করতো আজাদ বয়েজ। সেই দলের তরুণ ব্যাটসম্যান আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে কতদিন আমাদের নেটে ডেকে নিয়ে এসেছেন ব্যাট করার জন্য, প্রয়োজনে পরামর্শও দিয়েছেন। শুধু খেলার মাঠে নয়, শিষ্যদের জীবনের পথচলা মসৃণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল তার।

আটের দশকের শুরুতে পাতিয়ালা থেকে কোচিংয়ে ডিপ্লোমা নিয়ে ফিরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক্ত কোচ হিসেবে নিয়োগ নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কোচের পদে যোগ দেন জালাল চৌধুরী। সেই চাকরি ছেড়েছেন কিছুদিন যেতে না যেতেই। এক প্রিয় সহকর্মী ও সাবেক ক্রিকেটারের বেকারত্ব ও পারিবারিক দুরবস্থা দুর করতে ক্রীড়া পরিষদের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে দিয়ে শূণ্যপদে দুরবস্থায় পড়া সেই সহকর্মীকে নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। জালাল চৌধুরীর অতুলনীয় সহমর্মিতায় পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়াত সেই কোচ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, জাতীয় দলকে উপহার দিয়েছেন বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার।

যেকোনো খেলায় দুই মতবাদে বিশ্বাসী কোচের দেখা মেলে। একদল মনে করেন, চাপ দিয়ে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরা পারফরম্যান্স পাওয়া সম্ভব। আরেক দলের আস্থা, খেলোয়াড়দের মানসিক উদ্দীপনার মাধ্যমে বন্ধু হয়ে সেরা পারফরম্যান্স আদায় করার মতবাদে। কোচ জালাল ভাই সরাজীবন ছিলেন দ্বিতীয় ঘরানার অনুসারী।

জালাল ভাইয়ের ক্রিকেট মাঠে ২৪ ঘণ্টার আত্মনিবেদনের পেছনে তার প্রয়াত স্ত্রী কফতিয়া চৌধুরীর অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সালে স্ত্রীকে অকস্মাৎ হারানো জালাল ভাইয়ের জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। প্রবল মানসিক শক্তি আর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসায় সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে টিকে ছিলেন। ভাবীর মৃত্যুর আগে ও পরে যোগ্য দুই সন্তান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জালাল ভাইকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। ক্রিকেট প্রেম, বন্ধু, আড্ডা আর পরিচিত ঢাকা শহরের টানই শেষ পর্যন্ত এদেশের ক্রিকেটের অন্যতম বিদগ্ধ, সর্বজনপ্রিয় মেধাবী মানুষটি নিদারুণ একাকীত্ব আর অসময়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন।

সাতশো বছর আগে জার্মানির হ্যানোভারের ছোট্ট শহর হ্যামিলনের একদল শিশু-কিশোর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে চিরতরে অজানায় হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা জালাল আহমেদ চৌধুরী। তিনি তার শিষ্যদের জীবন থেকে হারাতে দেননি বরং দেখিয়েছেন ক্রিকেটানন্দে শ্বেতশুভ্র হয়ে বেঁচে থাকার পথ। যে জীবনের ঠিকানা দিয়েছিলেন তাতে অর্থ প্রাচুর্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিত্তানন্দ, আত্মমর্যাদাবোধ। আমাদের বেঁচে থাকার পথ দেখিয়ে প্রিয় বাঁশিওয়ালাই হারিয়ে গেলেন অকালে, আচমকা।

প্রিয় আজিমপুরের বিখ্যাত কবরখানার এক বৃক্ষছায়াশোভিত কোণে প্রিয় জননী আর স্ত্রীর কবরের উপর শেষশয্যা পেতেছেন বাঁশিওয়ালা। মা-স্ত্রীর ভালোবাসার আঁচলে অনন্ত শয়ান শান্তিময় হোক তার। উপযুক্ত সম্মান, ভালোবাসা দিতে আমাদের অক্ষমতা তিনি কি ক্ষমা করতে পেরেছেন? নাকি একবুক অভিমান নিয়ে শেষ শয্যা নিলেন আমাদের প্রিয় সবার প্রিয় জালাল ভাই !

লেখক:
সাইদুর রহমান শামিম
ক্রীড়া সাংবাদিক এবং সাবেক ক্রিকেটার

সারাবাংলা/এসএইচএস/আইই

জালাল আহমেদ চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর