গ্রুপ দুইয়ে কী সুবিধা পাবে বাংলাদেশ?
২২ অক্টোবর ২০২১ ২২:০২
ঢাকা: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে জানানো হয়েছিল, প্রথম পর্ব পেরিয়ে সুপার টুয়েলভে গেলেই বাংলাদেশ গিয়ে পড়বে গ্রুপ-২ তথা ভারত-পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড-আফগানিস্তানের গ্রুপে। তবে টুর্নামেন্ট শুরুর তিন দিন পর সে নিয়ম বদলে যায়। আইসিসি জানায়, গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হলে দ্বিতীয় পর্বে গ্রুপ-২ এবং গ্রুপ পর্বে রানার-আপ হলে গ্রুপ-১ তথা ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রুপ জায়গা হবে বাংলাদেশের। প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হেরে বসে সুপার টুয়েলভে ওঠা নিয়েই খানিকটা শঙ্কা তৈরি হলেও তা কেটে গেছে। বাংলাদেশ সুপার টুয়েলভে জায়গা করে নিয়েছে গ্রুপ পর্বে রানার্স-আপ হয়ে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপার টুয়েলভের হিসাব-নিকাশ পালটে গেছে টাইগারদের। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সুপার টুয়েলভে ভারত-পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড-আফিগানিস্তানকে প্রতিপক্ষ ধরেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি ছিল বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের। কিন্তু গ্রুপে রানার-আপ হয়ে বাংলাদেশের স্থান হয়েছে গ্রুপ-১-এ, যেখানে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই গ্রুপ বদলে সুপার টুয়েলভে কি বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কঠিন হয়ে পড়ল? নাকি প্রতিপক্ষ হিসেবে পশ্চিমা এই দলগুলোই বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ হবে?
টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স বিবেচনায় আগে থেকেই সুপার টুয়েলভে জায়গা করে নেওয়া আট দলের কাউকেই পিছিয়ে রাখার সুযোগ নেই। ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ— এই চারটি দলের ঝুলিতেই রয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তো শিরোপা রয়েছে দুইটি। শিরোপা না থাকলেও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আর আফগানিস্তানও যোগ্য দাবিদার হিসেবেই টি-২০ বিশ্বকাপের মূল পর্বে সরাসরি খেলছে— তা নিয়েও দ্বিমত নেই কারও। তাহলে সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যাওয়া টাইগারদের প্রতিপক্ষ বদলের ঘটনাটি কেমন প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে?
গ্রুপ-১-এর দলগুলোর হালচাল
শুরুতেই দেখে নেওয়া যাক, বাংলাদেশের এখনকার গ্রুপের দলগুলোর বর্তমান অবস্থা কী। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর খোলনলচে বদলে যাওয়া ইংলিশ ক্রিকেট দল ওয়ানডেতেই এখন খেলে টি-টোয়েন্টি মেজাজে। টি-টোয়েন্টি ম্যাচের কথা তো বলাই বাহুল্য। জ্যাসন রয়, ডেভিড মালান, বাটলার, বেয়ারস্টোর মতো তুখোড় হিটারের সঙ্গে মার্ক উড, ডেভিড উইলির মতো পেসার নিয়ে ইংল্যান্ড নিঃসন্দেহে টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী দল। রয়েছেন আদিল রশিদ, মঈন খানের মতো কার্যকর স্পিনার। ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের রেকর্ডও খুব সুবিধার নয়। এদিকে, অ্যারন ফিঞ্চ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারের মতো ব্যাটারের সঙ্গে মিচেল মার্শ, প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজেলউডের পেস আক্রমণ সম্ভবত টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা। অ্যাস্টন অ্যাগার, অ্যাডাম জাম্পার মতো স্পিনাররা রয়েছেন সঙ্গী।
আরও পড়ুন
- রেকর্ড জয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশ
- সুপার টুয়েলভের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ
- সুপার টুয়েলভে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার গ্রুপে বাংলাদেশ
অন্যদিকে, টি-টোয়েন্টির জন্য বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিজে এখনো খেলে যাচ্ছেন ক্রিস গেইল, কাইরন পোলার্ড, সিমরন হেটমেয়ারের মতো সব হার্ড হিটার। ওশেন থমাসের মতো পেসার যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন টি-টোয়েন্টি ভীষণ কার্যকর আন্দ্রে রাসেলের মতো অলরাউন্ডার। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও রেজা হেনড্রিকস, কুইন্টন ডি কক, ডেভিড মিলারের মতো মারকুটে ব্যাটাররা আছেন। কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিদি, এনরিক নরজের মতো পেসাররা তো আছেনই। তাবারেজ শামসিও রয়েছেন লেগ স্পিনার হিসেবে।
গ্রুপ-২-এর দলগুলোর অবস্থা
আইপিএলের মাধ্যমে টি-টোয়েন্টিতে নতুন রসায়নের সূচনা করা ভারত রয়েছে এই গ্রুপে। একদিকে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, রিশভ পন্তের মতো ব্যাটার; অন্যদিকে জাসপ্রিত বুমরাহ, ভুবনেশ্বর কুমার, মোহাম্মদ শামির মতো পেসার। তার সঙ্গে হার্দিক পান্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজার মতো কার্যকর অলরাউন্ডার আর অভিজ্ঞ রবিচন্দন আশ্বিনের মতো স্পিনার ভারতকে টুর্নামেন্টের শিরোপার অন্যতম দাবিদার করে তুলেছে।
উপমহাদেশের আরেক দল পাকিস্তানে বাবর আজম, ফখর জামানের মতো ব্যাটাররা আছেন এই দলে। শাহিন শাহ আফ্রিদি, হাসান আলীর মতো পেসাররা আছেন। ফ্রন্টলাইন স্পিনার হিসেবে আছেন শাদাব খান। এছাড়া মোহাম্মদ হাফিজ ও শোয়েব মালিকের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও পাকিস্তানকে শক্তিশালী দলে পরিণত করেছে।
‘কুল ক্যাপ্টেন’ কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে মার্টিন গাপটিল যেমন রয়েছেন ব্যাটার হিসেবে, তেমনি টিম সাউদি-ট্রেন্ট বোল্টের বিখ্যাত পেস জুটিও রয়েছে নিউজিল্যান্ড দলে। ইশ সোধি, মিচেল স্যান্টনারের মতো স্পিনার আর জিমি নিশামের মতো অলরাউন্ডারের এই দলটিকে পিছিয়ে রাখার সুযোগ কম।
গ্রুপে আরেক দল আফগানিস্তানে রয়েছে হজরতুল্লাহ জাজাই, রহমতুল্লাহ গুরবাজ, মোহাম্মদ শাহজাদের মতো ব্যাটারদের সঙ্গে রয়েছেন হামিদ হাসান, ফরিদ আহমেদ মালিকের মতো পেসার। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের তারকা স্পিনার রশিদ খান আর মুজিব উর রহমানও রয়েছেন দলে। রয়েছেন মোহাম্মদ নবির মতো অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা আফগানিস্তানকেও কোনো দলই দুর্বল হিসেবে দেখবে না নিশ্চয়।
প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে পিচ আর কন্ডিশন
বিশ্বকাপে মতো টুর্নামেন্টে কোনো দলকেই ছোট করে দেখার কিছু নেই— কথাটি তাত্ত্বিক মনে হলেও ওপরের দলগুলোর বিশ্বকাপ স্কোয়াড দেখলে সেটিকে বাস্তব ধরে নিতেই হবে। তবে টাইগারদের প্রতিপক্ষ হিসাব করলে দুই গ্রুপের মধ্যে কোন গ্রুপের প্রতিপক্ষ বেশি কঠিন, সেটিরও আন্দাজ করা যেতে পারে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে সুপার টুয়েলভের ভেন্যু আরব আমিরাতের দুবাইয়ের পিচ-কন্ডিশনকে হিসাবে নিলে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা বিবেচনায় নিতে বলছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।
পিচ আর কন্ডিশনের দিক থেকে দুবাইয়ের মাঠগুলোর সঙ্গে উপমহাদেশের মাঠগুলোর কিছুটা হলেও মিল রয়েছে। এখানকার পিচ অবশ্য মিরপুরের মতো একেবারে স্পিননির্ভর না। তবে উইকেটে প্রচুর রানের পাশাপাশি স্পিনারদের জন্য কিছুটা সুবিধা দুবাইয়ের পিচে থাকছেই। সবশেষ আইপিএলেও দেখা গেছে, স্পিনাররা যথেষ্টই ভালো করছেন এখানকার মাঠে। ফলে দুবাইয়ের পিচ টাইগারদের কাছে একেবারেই অচেনা হবে— বিষয়টি তেমন নয়। তবে এই কন্ডিশনের কারণেই দুবাইকে বলা যায় ভারতের সেকেন্ড হোম গ্রাউন্ড। আইপিএলের কল্যাণে ভারতীয় ক্রিকেটারদেরও এসব গ্রাউন্ড সুপরিচিত।
এদিকে, আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবেই পাকিস্তানের হোম গ্রাউন্ড। ফলে দুবাইয়ের মাঠগুলো পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের হাতের তালুর মতোই চেনা। দুবাইয়ে পাকিস্তানের খেলা তাই মানে নিজেদের মাঠে খেলা। কন্ডিশনের দিক থেকে দুবাই আফগানিস্তানের জন্যও অনেকটাই অনুকূল। কন্ডিশনের ফায়দা লুটতে এই দলের ক্রিকেটাররা মুখিয়ে রয়েছেন নিশ্চয়। গ্রুপ-২-এর দলগুলোর মধ্যে কেবল নিউজিল্যান্ডের জন্যই এই কন্ডিশন কিছুটা অপরিচিত। তারপরও দলে একাধিক স্পিনার রেখে কিউইরাও নিশ্চয় কন্ডিশনের ফায়দা লুটতে চেষ্টা করবে। তারপরও হয়তো তারা বাকি দলগুলোর মতো সুবিধা আদায় করতে পারবে না।
এদিকে, আরেক গ্রুপের দলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনভীতির কথা কেউই অস্বীকার করবে না। উপমহাদেশের উইকেটে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও স্পিনে নাকানি-চুবানি খাওয়ার নজিম কম নেই। তিনটি দলেরই বাংলাদেশ সফরের সবশেষ অভিজ্ঞতাগুলো একেবারেই সুখকর নয়। বিপরীতে আরব আমিরাতের পিচে মিরপুরের মতো পূর্ণ সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশের কাছে এই কন্ডিশন একেবারে অপরিচিত নয়। এই দুই বিবেচনায় কেউ কেউ মনে করছেন, বাংলাদেশ কন্ডিশনের দিক থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে মনস্তাতাত্ত্বিক দিক থেকে।
আবার কিছুদিন আগেই এই আরব আমিরাতের মাঠেই আইপিএল খেলে গেছেন দলের প্রধান সেবার মোস্তাফিজুর রহমান এবং বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ফলে এই দু’জনের কন্ডিশনের সঙ্গে অভ্যস্ততাও বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও সুবিধা দেবে— এমন ধারণাতেও দ্বিমত নেই অনেকের। সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো প্রতিপক্ষের তুলনায় অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-দক্ষিণ আফিকাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলে সেটি মানসিক দিক থেকে টাইগারদের এগিয়ে রাখতে পারে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী দলও
বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হেরে যাওয়া দর্শকদের ক্ষুব্ধ করেছে। তাতে দুয়ো পড়েছে ক্রিকেটারদের নামে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং— তিনটি নিয়েই অভিযোগ ছিল প্রথম ম্যাচে। তবে দ্বিতীয় ম্যাচেই ওমানের বিরুদ্ধে বোলিং-ব্যাটিং দুই বিভাগেই পারফরম্যান্সে ফিরে আগে টাইগাররা। এ ম্যাচের ফিল্ডিং নিয়ে অবশ্য বড় প্রশ্ন থেকেই গেছিল। শেষ পর্যন্ত শেষ ম্যাচে এসে তিন বিভাগেই ব্যর্থতার ধারাবাহিকতার পরও উন্নতির ছাপ ছিল স্পষ্ট। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব নিয়মিত রান করছেন, উইকেট পাচ্ছেন। নাঈম, মাহমুদুল্লাহ রান পেয়েছেন। মুস্তাফিজের বোলিং আর সাইফুদ্দিনেরও ব্যাট-বলের পারফরম্যান্সও আশা জাগানিয়া। উন্নতির এই ধারাটা অব্যাহত থাকলে সুপার টুয়েলভে টাইগারদের টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় দেখা যাবে— এমন আশাবাদ টাইগার ভক্তদের।
আগের দুই ম্যাচের ধরারাবাহিতায় সুপার টুয়েলভে ব্যাটে-বলে মন ভরানো পারফরম্যান্স টাইগাররা দেখাতে পারবেন কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। সাকিব যখন ওমানের বিপক্ষের ম্যাচ শেষে বলেন— ‘স্বপ্ন কখনো বদলে যেতে পারে না’, তখন টাইগারদের কাছ থেকে স্বপ্নের পারফরম্যান্সের আশাটা জাগিয়ে রাখাটাও অলীক মনে হয় না।
ভারতের আয়োজনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপের সবকটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করবে দেশের জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল জিটিভি। এছাড়াও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম র্যাবিটহোলের ওয়েবসাইটে দেখা যাবে বিশ্বকাপের খেলা। অনলাইনে র্যাবিটহোলে খেলা দেখতে ব্রাউজ করুন https://www.rabbitholebd.com/
সারাবাংলা/টিআর