দর্শকহীন বিপিএলেও টিকিট ‘কালোবাজারি’, স্বাস্থ্যবিধি নিয়েও প্রশ্ন
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:১৪
ঢাকা: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সরকার জারি করেছে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ। সংক্রমণ পরিস্থিতি বেসামাল থাকার কারণেই টি-টোয়েন্টির দেশীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর বিপিএলও ফাঁকা গ্যালারিতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কিন্তু শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সরজমিনে দেখা গেল— বিপিএলের ম্যাচ চলাকালে গ্যালারিতে উপস্থিত সাধারণ দর্শক!
অনুসন্ধানে জানা গেল, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে গ্যালারিতে ম্যাচের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক যে টিকিট সরবরাহ করা হয় বোর্ডের পক্ষ থেকে, সেগুলোই কোনো না কোনোভাবে চলে আসছে বাইরে। আর ‘কালোবাজার’ ঘুরে সেই টিকিট চলে যাচ্ছে সাধারণ দর্শকদের হাতে। কেবল টিকিট কালোবাজারিই নয়, দর্শকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের ব্যত্যয় ঘটছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আর সুরক্ষা বলয়ের কারণে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে করোনা ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ছেন বিপিএলের ম্যাচ চলাকালে!
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিসিবি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি ম্যাচেই ফ্র্যাঞ্চাইজি সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি গ্যালারিতে প্রবেশের সুযোগ পান। এর জন্যই ম্যাচের আগে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে নির্দিষ্টসংখ্যক টিকিট সরবরাহ করা হয়। সেই টিকিটই শেষ পর্যন্ত চলে আসে ‘কালোবাজারে’। বিপিএলের ঢাকার দ্বিতীয় পর্বের শেষ যেদিন খেলা হয়েছে, সেই বৃহস্পতিবারও (৩ ফেব্রুয়ারি) স্টেডিয়ামের গেটের সামনে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেল ম্যাচের টিকিট।
স্টেডিয়ামের ৩ নম্বর গেটের সামনে কালোবাজারি করে টিকিট বিক্রি করতে দেখা গেল মোহাম্মদ মহিনকে। বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই তিনি টিকিট বিক্রি করছিলেন তিনি। সারাবাংলার এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় না দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। মহিন বলেন, ‘আমরা ভেতর থেকেই টিকিট পাই। দলের (ফ্র্যাঞ্চাইজি) লোকজনের সঙ্গে লিংক (যোগাযোগ) আছে। তারা টিকিট বের করে দেয়। সব দলের টিকিটই পাই আমরা।’
একেকটি টিকিট কত টাকায় কিনতে হয় এবং কত টাকা বিক্রি করতে পারেন— এমন প্রশ্ন করতে মহিনের জবাব দেওয়ার আগেই পাশ থেকে ওহেদুল নামে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘‘খুব বেশি লাভ থাকে না। এই যেমন দুই-আড়াই হাজার করে বিক্রি করি। কেনাও পরে অনেক দামেই।’
কথায় কথায় মহিনই জানালেন, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দুই ডোজ না নেওয়া থাকলেও স্টেডিয়ামে ঢোকা যাবে খেলা চলাকালেও! মাহিন বলেন, ‘দুইটা ভ্যাকসিন না নিলে সমস্যা নাই। একটা নিলেই হবে। গেটে যারা থাকে, আমরা তাদের বলে দিলেই ঢুকিয়ে দেয়। তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ভ্যাকসিন না নিলেও সমস্যা নাই। আমাদের লোক আছে, আমরা কার্ড বানায়ে দেই। গেটে অত সব চেক করে না!’
মাহিনের দাবি যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও। গেটে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী ফকির মো. আনোয়ার হোসেন রাজার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন। বললেন, কখনো কখনো অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটি করা হয়।
আনোয়ার বলেন, ‘বাঙালি তো ক্রিকেট পাগল। সবাই খেলা দেখতে চায়। অনেকে এসে অনুরোধ করে। দেখা গেল, একটা ভ্যাকসিন নেওয়া কোনো শিক্ষার্থী আসছে, অনেক অনুরোধ করছে। সেসব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক নিরাপত্তাকর্মী সারাবাংলাকে জানালেন, কেবল শিক্ষার্থী নয়, এক ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া অনেককেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামে। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে বিসিবির পক্ষ থেকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন ছাড়া স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে না দেওয়ার বিষয়ে কড়া বার্তা দেওয়া আছে— এমনটি জানিয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, নির্দেশ আছে। কিন্তু সবাই মানে না। এই যেমন দর্শকদেরই তো ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু টিকিটগুলো ঠিকই চলে যাচ্ছে দর্শকদের কাছে। টিকিট নিয়ে এসে ঢুকে যাচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দুই ডোজ করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কড়া নির্দেশনাও দেওয়া আছে। আমরা স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি— দুই ডোজ ভ্যাকসিন ছাড়া যেন কাউকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে না দেওয়া হয়। তারপরও যদি এমনটি ঘটে থাকে, আমরা বিষয়টি দেখব।
ফ্র্যাঞ্চাইজিদের জন্য বরাদ্দ করা টিকিট কালোবাজারের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে চলে যাচ্ছে— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘এমনটি ঘটে থাকলে আমি বলব— এটি অত্যান্ত লজ্জাজনক। এটি অপরাধমূলক কাজও। দেখুন, আমরা টিকিটটা দিচ্ছি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে। তারা এত টাকা খরচ করে টিম করে, তাছাড়া তাদের স্পন্সর থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা টিকিটটা তাদের দিচ্ছি। সেখান থেকে যদি টিকিট ব্ল্যাক মার্কেটে চলে যায়…। আমার মনে হয় না ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এ কাজ (কালোবাজারি) করে। হতে পারে তারা (ফ্র্যাঞ্চাইজি) স্টাফ বা বয়দের টিকিট দিচ্ছে, সেখান থেকে হয়তো চলে যাচ্ছে ব্ল্যাকিংয়ে।’
এসব ক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মনে করছেন শেখ সোহেল। তিনি বলেন, ‘কালোবাজারি যেকোনো পরিবেই নষ্ট করে দেয়। আমরা এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এটি আমরা মনিটরিংও করি। কিন্তু আমরা আসলে টিকিটগুলো দেই ফ্র্যাঞ্চাইজিকে। সেখান থেকে কোনো স্টাফ যদি সেটি ব্ল্যাক করে কাউকে দিয়ে দেয়, সেটি আমাদের জন্য দেখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একে তো আমরা খুব কম সময়ের মধ্যে এবারের বিপিএল আয়োজন করছি, নানা জটিলতাও আছে। তবু আমরা বিষয়টি দেখব।’
কোভিড সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গতবারের মতো এবারের বিপিএলও বাতিলের শঙ্কা ছিল। বিপিএল শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে দেশে করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হলে টুর্নামেন্ট বাতিলের শঙ্কা বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সব দিক বিবেচনা করে টুর্নামেন্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবি। তবে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই অনুপস্থিত এবারের বিপিএলে।
এখনো ডিআরএস নেই। আগের টুর্নামেন্টগুলোর তুলনায় এবার বিদেশি আম্পায়ার, ধারাভাষ্যকার এবং খেলোয়াড় মানের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। টুর্নামেন্টের জৌলুস, প্রাইজমানিও তুলনামূলক কম। বিসিবি ও বিপিএল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড পরিস্থিতির কারণে অল্প সময়ে টুর্নামেন্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে তৈরি হয়েছে এসব শূন্যতা। তাছাড়া টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে দেশে করোনা সংক্রমনের উর্ধ্বমূখী হওয়াটাও বড় বাধা তৈরি করেছে।
এত প্রতিবন্ধকতার বিপিএলে এবার ফ্র্যাঞ্চাইজিদের জন্য বরাদ্দ টিকেট নিয়েও কালোবাজারির খবর মিলল। চারদিকে করোনা পজিটিভ বাড়লেও বিপিএলের ‘নেগেটিভ রান’ যেন কাটছেই না।
সারাবাংলা/এসএইচএস/টিআর