অটোচালক থেকে মুশফিকের পাঁড় সমর্থক, নেপথ্যে মাহমুদউল্লাহ!
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৫৬
চট্টগ্রাম থেকে: শরীরজুড়ে ডোরাকাটা বাঘের অবয়ব আঁকা পোশাক। চেহারাও রাঙানো সেই ডোরাকাটা বাঘের আদলেই। মাথায় জাতীয় পতাকা। যেকোনো ভিড়ের মধ্যেও খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রবিউল ইসলাম রবি।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সামনে টাইগার সমর্থকদের জটলায় রবি ঠিকই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কাছে যেতেই দেখা গেল, বুকে নিচের দিকে মুশফিকুর রহিমের ছবি। জানালেন, জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ মুশফিকুর রহিমের অন্ধ ভক্ত তিনি। যেখানেই জাতীয় দলের খেলা, সেখানেই ছুটে যান মুশফিকের সমর্থনে।
কথা বলে জানা গেল, মুশফিকের এই অন্ধভক্ত রবিউল ইসলাম রবির বাড়ি খুলনার খালিশপুরে। সেখান থেকেই ছুটে এসেছেন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে, বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ওয়ানডে সিরিজ দেখতে। আরও জানালেন, ক্রিকেটের জন্য তার এই ছুটোছুটি একেবারেই নতুন নয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে টাইগারদের খেলা দেখতে গিয়েছেন দেশের বাইরেও।
রবি বললেন, অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের খেলা মানেই গ্যালারিতে তার উপস্থিতি, মুশফিকের সমর্থন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ভারত সফরে প্রতিটি ম্যাচেই ছিলেন গ্যালারিতে। ওই সময় গ্যালারিতে হাজির হতেন খালি গায়ে, শরীরে রঙ দিয়ে আঁকতেন বাঘের অবয়ব। তবে শরীরে মুশফিকের ছবি ফুটিয়ে তোলা সবসময় সম্ভব হয় না বলে এখন বাঘের অবয়ব আঁকা পোশাক পরেন। এরও আগে ছিলেন বল বয়।
রবির সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেল এক অদ্ভুত তথ্য। তিনি একটা সময় ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেক তারকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্ধ ভক্ত! তাহলে মাহমুদউল্লাহ’র বদলে মুশফিকের ভক্ত বনে গেলেন কীভাবে?
গল্পটা শুনুন রবিউল ইসলাম রবির মুখেই— ক্রিকেট আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আগে টিম বয় ছিলাম। ঢাকা লিগে সব দলেই কাজ করেছি। বিসিএলে ওয়ালটনে কাজ করতাম। সে সময় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে খুবই পছন্দ করতাম। লিফলেটে লিখে আনতাম তার নামে। একবার গেলাম হোটেল রোজ ভিউ, সিলেটে। ওখানে উনিই (মাহমুদউল্লাহ) আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুই আমাকে ভালোবেসে থাকলে একটা কথা রাখতে হবে।’ আমি বললাম, ‘আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমাকে নিয়ে লেখার দরকার নাই। মুশফিককে নিয়ে বেশি বেশি লিখবি।’
সতীর্থ মুশফিকুর রহিমের জন্য মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ভালোবাসা ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন রবি। টাইগার ক্রিকেটের এই দুই তারকা পারিবারিক সম্পর্কের যোগসূত্রে আত্মীয়ও। তবে রবি বলছেন, মুশফিকুর রহিমের প্রতি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাপূর্ণ অবস্থান আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই।
রবি বলেন, ‘আমি দেখেছি, রিয়াদ ভাই মুশফিক ভাইকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেনি। আত্মীয়ের (ভায়রা ভাই) দিক থেকে না, এমনিতেও ভালো ক্রিকেটার তিনি। এজন্যই ভায়রা হওয়ার আগে থেকেই তাকে আলাদাভাবে সম্মান করেন। পরে ভারতে গেলাম সারা শরীরে রঙ মেখে টাইগার সেজে। রিয়াদ ভাই দেখেই আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। পরে মুশফিক ভাই দেখেও খুব খুশি। আমি রিয়াদ ভাইয়ের আদেশই পালন করে যাচ্ছি।’
মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে রবির। বিভিন্ন স্থানে তার খেলা দেখতে আসা-যাওয়াসহ যাবতীয় খরচও বহন করেন মুশি। কিন্তু পরিবারের খরচ তো আর এভাবে চলে না। তবে সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তবে পারিবারিক সংকটের কারণে সেই সুযোগও হারিয়েছেন তিনি।
রবিউল ইসলাম রবি বলেন, খেলা না থাকলে আমি অটোরিকশা চালাই। মাহমুদউল্লাহ ভাই পাঁচ ব্যাটারির একটি অটো কিনে দিয়েছিলেন। খেলা থাকলে আমি ভাড়া দিতাম। খেলা না থাকলে আমি নিজেই চালাতাম। খেলোয়াড়রা খুলনা গেলে আমার অটোতে চড়ত। কিন্তু বাবার চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেটি বিক্রি করে দিতে হয়।
ওই সময় ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন রবির বাবা। তাকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়েছিল। প্রয়োজন হচ্ছিল বড় অঙ্কের টাকা। কিন্তু রবির কাছে সম্পদ বলতে ছিল কেবল ওই অটোরিকশা। আবার ওই সময় জাতীয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের অবস্থাও ছিল যাচ্ছেতাই। ফলে ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থাও ভালো ছিল না। ফলে তাদের শরণাপন্নও হতে পারেননি রবি। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত অটোরিকশাটিই বিক্রি করে দিয়ে বাবার চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি।
রবি বলেন, বাবার ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার পর অটো বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ দল তখন দেশের বাইরে ছিল। ভালো খেলছিল না। ফলে তাদের বলতে না পেরে অল্প দামে বিক্রি করে চিকিৎসা চালিয়েছি।
তবে এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই রবির। সব বাস্তবতা মেনেও মুশফিক-মাহমুদউল্লাহসহ টাইগার ক্রিকেটারদের পাশেই থাকতেন চান তিনি।