বিশ্বকাপের দল পরিচিতি: ইংল্যান্ড
১২ নভেম্বর ২০২২ ১৭:০৯
এবার কি পারবে গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড দল? কি পারতে হবে তাদেরকে? নিশ্চয়ই বিশ্বকাপে শিরোপা। তারা তো আর চুনোপুঁটি নয় যে দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গেলেই হয়ে গেল।
৫২ বছরের গ্যারেথ সাউথগেটের অধীনে ইংল্যান্ড গত ২০১৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল এবং ইউরো-২০২০ এর ফাইনালে ইতালির কাছে টাইব্রেকারে হেরেছিল। তাহলে কি এবার দানে দানে তিন দান অর্থাৎ তৃতীয় দানে কি ইংল্যান্ড বাজিমাত করতে পারবে? ইংল্যান্ড কি এবার তাহলে ৫৬ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে যাচ্ছে? থ্রি লায়ন্সরা টানা সপ্তম বারের মতো বিশ্বকাপে যাচ্ছে। যাদের সঙ্গী হবে ওয়েলস, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ ‘বি’ থেকে।
ইংল্যান্ডে অত্যন্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সমাহার থাকলেও তাদের সাম্প্রতিক ফর্ম আশাবাদী নয়। তাদের সৃজনশীল বিকল্পগুলো ঈর্ষনীয়। ডেক্লান রাইস এবং জুড বেলিংহামের মতো তরুণ মিডফিল্ডারের সঙ্গে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের একজন হ্যারি কেন।
তবে এবারের বিশ্বকাপের পরই শেষ হয়ে যাবে ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের (কাইল ওয়াকার, কিররিয়েন ট্রিপিয়ার, জর্ডান হ্যান্ডারসনসহ আরও কয়েকজন) আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তার সঙ্গে আরও কিছু বাড়তি চিন্তা যোগ হয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক নেশনস লিগে তাদের অবস্থা ছিল তথৈবচ, হ্যারি ম্যাগুয়েরের গত কয়েক বছর ধরেই বাজে পারফরম্যান্স, রিস জেমসের ইনজুরি, কাইল ওয়াকারের অফ ফর্ম। আর এসব কারণেই গ্যারেথ সাউথগেট চিন্তিত। বিশ্বকাপে যদি ভালো করতে না পারেন তবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তার চুক্তি থাকলেও তার আগেভাগে যে তাকে বিদায় নিতে হবে এই ব্যাপারে তিনি শঙ্কিত। তিনি আরও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই চাপ যদি সামলে উঠতে না পারেন তাহলে তাদের সামনে বিপদ। তাই তিনি দলকে মাঠে ভয়ডরহীন ফুটবল খেলতে বলেছেন এবং আক্রমণাত্মক হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যান্য দলকেও এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে ইংল্যান্ডকে কখনোই হিসাবের বাইরে রাখবেন না। সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানির সঙ্গে ৩-৩ গোলে ড্র করা ম্যাচটি তাদেরকে সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি যোগাবে নিশ্চয়ই।
কোচ গ্যারেথ সাউথগেট আসলে কেমন—
তিনি কি ভীতু কোচ, নাকি সাহসী? আসলে বলা যায় মধ্যবর্তী কোচ। কারণ ইংল্যান্ড ফ্যানরা তাকে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকার প্রবণতাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাছাড়া এই ইংল্যান্ডের খেলা খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তবে দলের উপর এখনো তার কর্তৃত্ব রয়েছে এবং ড্রেসিংরুমের সবাই তার নির্দেশ মেনে চলেন। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে তিনি কি ‘স্পেশাল ওয়ান’ হতে পারবেন? আর সেটা করতে গেলে তার দলকে নিশ্চয়ই দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলে বিশ্বকাপ জয় করতে হবে।
ইংল্যান্ডের ম্যাচ গুলো কবে হবে—
টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনে তাদের অভিযান শুরু করবে, সোমবার ২১শে নভেম্বর ইরানের বিপক্ষে। দ্বিতীয় ম্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে শুক্রবার ২৫ নভেম্বর। তৃতীয় ও শেষ গ্রুপ ম্যাচ খেলবে প্রতিবেশী ওয়েলসের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার ২৯শে নভেম্বর।
যাদের দিকে চোখ থাকবে—
তারকা খেলোয়াড়—
শুধু ইংল্যান্ড নয় এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন হচ্ছেন হ্যারি কেন। তিনি শারীরিকভাবে এখন ভালো অবস্থায় রয়েছেন এবং ইনজুরিমুক্ত আছেন। ২৯ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের জন্য একজন ফিজিও কাজ করছেন সার্বক্ষণিকভাবে। টটেনহ্যামের হয়েও বেশ ভালো ফর্মে আছেন। তার জন্য সবচেয়ে অনুপ্রেরণা হবে জাতীয় দলের হয়ে ৫৩ গোল করা ওয়েন রুনিকে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করার জন্য আর মাত্র দুটি গোল করতে হবে। কাতারে হ্যারি কেন রুনিকে ছাড়িয়ে না গেলে নিশ্চয়ই সেটা অবাক করবে সকলকে। ইউরো ২০২০’এ পেনাল্টি ব্যতীত গোলের জন্য যুগ্ম-শীর্ষ সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন (চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক শিকের সঙ্গে ৪টি)। এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন (নেদারল্যান্ডসের মেমফিস ডিপাইয়ের সঙ্গে ১২টি)।
নেপথ্য তারকা—
২৩ বছর বয়সী ওয়েস্টহ্যাম অধিনায়ক, ডেক্লান রাইস বর্তমান ইংল্যান্ড দলের নিয়মিত সদস্য। তিনি অন্যদের খেলতে দেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকার দক্ষতা ইংল্যান্ডের জন্য একটি অমূল্য রক্ষণাত্মক সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই প্রতিরক্ষা রাইস ছাড়া আর কেউ দিতে পারেন না গ্যারেথ সাউথগেটকে। তার বল জয়ের ক্ষমতা এবং অবস্থানগত শৃঙ্খলা বেলিংহামকে আক্রমণ ভাগে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবে। ইংল্যান্ডের আক্রমণ ভাগ সবসময়ই তার সুদক্ষ পাসিংয়ের আশায় থাকবে, তাই তার সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকাংশেই ইংল্যান্ড দলের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে।
তরুণ তারকা—
আর্সেনালে খেলা ২৫ বছরের বেন হোয়াইট, সেন্টারব্যাক, রাইটব্যাক এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড তিন পজিশনেই খেলতে পারেন। তবে এবারের বিশ্বকাপে এমনও হতে পারে ইনজুরির কারণে লেফটব্যাকে খেলতে হতে পারে। কেননা দলের নিয়মিত লেফটব্যাক চেলসির বেন চিলওয়াল ইনজুরির কারণে বাদ পড়েছেন। আর দলে একমাত্র স্বীকৃত লেফটব্যাক হিসেবে লুক শ কে নেওয়া হয়েছে। তিনি শান্ত এবং ধীর-স্থির তবে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে আক্রমণ রচনার ক্ষেত্রেও তার পারদর্শিতা রয়েছে।
জুড বেলিংহাম ইংল্যান্ড দলের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ইংলিশ লিগের বাইরে থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ১৯ বছরের মিডফিল্ডার খেলছেন বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। দলের সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডারের অভাব পূরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবেন তিনি। বল নিয়ে সামনে এগুনো এবং পেনাল্টি বক্সের ভিতরে ফাইনাল পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে দল তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মিডফিল্ডের উইং পজিশন। বুকায়ো সাকা সেই দলের একটি অংশ। খেলছেন আর্সেনালে। বাম পায়ে খেলা ২২ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় একজন প্রথাগত উইংগার।
ম্যানচেস্টার সিটির ২২ বছর বয়সী, ফিল ফোডেনকে বিশ্বের সেরা তরুণ খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি বাম পায়ে খেললেও দলের প্রয়োজনে রাইট উইংয়ে খেলতে পারেন। শারীরিকভাবে শক্তিশালী না হলেও বল তার পায়ে আঠার মতো লেগে থাকে এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে কাটানোর ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তিনি একজন প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা। দলের প্রয়োজনে অনেক সময় ‘ফলস নাইন’ পজিশনেও খেলেন।
ইংল্যান্ডের চূড়ান্ত স্কোয়াড—
ইংল্যান্ড সম্প্রতি তাদের কাতারগামী ২৬ জন দলের নাম ঘোষণা করেছে। নিচের দলটির দলটির গড় বয়স: ২৬.৪ বছর। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন রাহিম স্টার্লিং: ৭৯টি এবং সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন, হ্যারি কেন: ৫১টি।
গোলরক্ষক: জর্ডান পিকফোর্ড (এভারটন), অ্যারন রামসডেল (আর্সেনাল), নিক পোপ (নিউক্যাসল)।
রাইট উইংব্যাক: ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড (লিভারপুল), কিরিয়েন ট্রিপিয়ার (নিউক্যাসল), কাইল ওয়াকার (ম্যানচেস্টার সিটি)।
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার: বেন হোয়াইট (আর্সেনাল), জন স্টোনস (ম্যানচেস্টার সিটি), এরিক ডায়ার (টটেনহ্যাম), হ্যারি ম্যাগুয়ের (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), কনর কোডি (এভারটন)।
লেফট উইংব্যাক: লুক শ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার: ডেক্লান রাইস (ওয়েস্ট হ্যাম), কালভিন ফিলিপস (ম্যানচেস্টার সিটি), জর্ডান হেন্ডারসন (লিভারপুল)।
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার: জুড বেলিংহাম (বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড), মেসন মাউন্ট (চেলসি), কনর গ্যালাঘের (চেলসি)।
উইংগার: বুকায়ো সাকা (আর্সেনাল), ফিল ফোডেন (ম্যানচেস্টার সিটি), রাহিম স্টার্লিং (চেলসি), জেমস ম্যাডিসন (লেস্টার সিটি)।
ফরোয়ার্ড: হ্যারি কেন (টটেনহ্যাম), মার্কাস রাশফোর্ড (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), জ্যাক গ্রিলিশ (ম্যানচেস্টার সিটি) এবং ক্যালাম উইলসন (নিউক্যাসল)।
কেমন হলো উপরের ২৬ জনের দলটি—
জর্ডান পিকফোর্ড দলের প্রধান গোলরক্ষক হিসেবেই খেলবেন বলে জানিয়েছেন গ্যারেথ সাউথগেট। তবে এর আগে নেশনস লিগে ইনজুরির কারণে খেলতে না পারলেও ছিলেন গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ইউরোর ফাইনালে। তাকে পেনাল্টি ঠেকাবার একজন স্পেশালিস্ট বলা হয়। তবে তার উচ্চতা ইউরোপের অন্য গোলরক্ষকদের তুলনায় কিছুটা কম।
চেলসির ডিফেন্ডার রিস জেমস এবং লেফটব্যাক বেন চিলওয়েল ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়েছেন। চেলসির এই দুই ডিফেন্ডারের অনুপস্থিতি দলের জন্য একটি বড় আঘাত, যারা রক্ষণ সামলে আক্রমণেও ভালো করতে পারতেন। তবে ম্যানচেস্টার সিটির কাইল ওয়াকার নিজের শারীরিক সমস্যায় ভুগলেও নির্বাচিত হয়েছেন। রাইটব্যাকে ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ডকে দলে নিলেও কোচ বেশিরভাগ সময় নির্ভর করেন বর্ষীয়ান কিরিয়েন ট্রিপিয়ারের ওপর। যিনি কিনা ক্লাব দলে অনেক সময় সাইড বেঞ্চে চলে যান। তবে জাতীয় দলে পরিবর্তিত লেফটব্যাক হিসেবেও খেলে থাকেন।
আর্নল্ডের মধ্যে খেলার সেরা রাইটব্যাক হয়ে ওঠার গুণাবলী থাকলেও রক্ষণাত্মক ঘাটতিগুলো তাকে অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। বেন হোয়াইটকে নিয়ে এই দলে চারজন রাইটব্যাক আছেন! কিন্তু চিলওয়ালের ইনজুরির কারণে হয়তো হোয়াইটকে লেফটব্যাকে খেলতে হতে পারে। এ থেকে ইঙ্গিত করে যে ইংলিশ দল দুই উইংব্যাক থেকে তেমনভাবে আক্রমণে সহায়তা পাবে না।
মগত বছর থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে কঠিন সময় পার করলেও সাউথগেট হ্যারি ম্যাগুয়েরকে দেশের ‘সেরা সেন্টারব্যাক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
জেমস ম্যাডিসন এবং ক্যালাম উইলসন শেষবার ইংল্যান্ডের হয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে খেলেছিলেন। তাই প্রায় তিন বছর পর জাতীয় দলে এসে কেমন খেলবে এই দুই খেলোয়াড়, সেটা সত্যিই তাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে ২০২১ সালের আগস্টের পর থেকে প্রিমিয়ার লিগে যে কোনো ইংলিশ খেলোয়াড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন জেমস ম্যাডিসন। তিনি এ সময় ৪৭টি ক্লাব ম্যাচ খেলে ১৮টি গোল করার পাশাপাশি ১২টি গোলে সহায়তা করেছেন।
এই দলে কাকা বা ভেরনদের মতো প্লে মেকার দূরে থাক, বর্তমান সময়ের মদ্রিচ বা ডি ব্রইনদের মতো কেউ নেই। দলে আছে তিনজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার যার মধ্যে কেলভিন ফিলিপস কেবলমাত্র কাঁধের ইনজুরি থেকে সেরে উঠেছেন এবং গত দুই মাসে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন। অনভিজ্ঞ কনর গ্যালাঘের, যিনি গত এক বছরে জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৪টি ম্যাচ খেলেছেন। তার ব্যাপারে কোচ বলেছেন সে বল প্রেসিং এবং বিপক্ষ দলের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা পালন করবেন।
হ্যারি কেনকে স্ট্রাইকিং পজিশনে সাহায্য করার মতো ফর্ম বা মান মার্কাস রাশফোর্ড এবং জ্যাক গ্রিলিশের নেই। তাই কেনকে নির্ভর করতে হবে বুকায়ো সাকা বা ফিল ফোডেনের মতো উইঙ্গারদের উপরে যারা ভালো ফর্মে আছেন।
বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সম্ভাব্য সেরা একাদশ—
গোলরক্ষক: জর্ডান পিকফোর্ড
ডিফেন্ডার: ট্রেন্ট অ্যালেক্সন্ডার আর্নল্ড, জন স্টোনস, এরিক ডায়ার, বেন হোয়াইট
মিডফিল্ডার: ডেক্লান রাইস, ম্যাসন মাউন্ট, বুকায়ো সাকা, ফিল ফোডেন
ফরোয়ার্ড: রাহিম স্টার্লিং এবং হ্যারি কেন।
সাউথগেট ইংল্যান্ডকে ২০১৮ এবং ২০২০-এর বিশ্বকাপ ও ইউরোতে ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে নিয়ে গেলেও এই দলটি আসলে আমার কাছে তেমন একটা পছন্দনীয় নয়। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে যে দলটি সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল সেই দলটি অনেক বেশি ডিরেক্ট ফুটবল খেলত। তাদের দলে ছিল পল গ্যাসকোয়েনের মতো খেলোয়াড় যার দুর্দান্ত ভলিতে করা অসাধারণ গোল আমরা দেখা গেছে ইউরো-৯৬তে।
দলের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা—
তারা সাধারণত বুদ্ধিমত্তার সাথে বল পজিশন নিজেদের কাছে রেখে সঠিক সময়ে আক্রমণ করার উপায় বের করে। বল পজিশন হারিয়ে ফেললেও বিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে আবার তাদের কব্জায় বল নিতে তারা বেশ সিদ্ধহস্ত।
এ বছর তাদের রক্ষণে বেশ ভালো রকম সমস্যা আছে। দু-একজন খেলোয়াড় ছাড়া বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় বাজে ফর্ম এবং ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করছেন। আগের গ্রুপ পর্বের বিশ্লেষণগুলোতে আমরা দেখেছি ছোট দলগুলো সাধারণত রক্ষণে জোর দেওয়ার জন্য তাদের দলে বেশ কয়েকজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ডেকেছে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে। সেই একই কৌশল ইংল্যান্ড ও খাটাতে পারে তাদের রক্ষণের দুর্বলতা ঢাকার জন্য।
আগেই বলেছি তাদের দলে সৃজনশীল প্লে মেকার নেই বললেই চলে সেই জন্য তাদেরকে উইঙ্গারদের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর হ্যারি কেনের মতো গোল করার লোকও তেমন একটা নেই। তাহলে উপায় কি? সেই ক্ষেত্রে তারা তাদের সেটপিস দক্ষতাকে কাজে লাগাবে। ২০১৮ বিশ্বকাপে এভাবেই তারা ১২ গোলের ৯টি সেটপিস থেকে আদায় করে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও তারা পেনাল্টি কিকসহ সেটপিসে ইউরোপের সেরা ছিল। যেই হ্যারি ম্যাগুয়েরকে নিয়ে ইংল্যান্ডে এত সমালোচনা, সেই তিনি এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও সেটপিস থেকে ৪টি গোল করে হ্যারি কেনের পরে সেরা দ্বিতীয় গোলদাতা ছিলেন।
সাউথগেটের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হল প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার চেষ্টা না করে ১-০ ব্যবধানে জিতে প্রায় সময়ই খুশি থাকতে চায়। তবে তার এই কৌশল কাজে লাগেনি। ১-০ গোলে লিড নেওয়ার পরেও ২০২০ ইউরো ফাইনাল এবং ২০১৮’র কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে তার দলকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। ইউরোর ফাইনালে তো এক গোলে লিড নেওয়ার পরে তাদেরকে গোলমুখী আর কোনো শট নিতে দেখা যায়নি। শুধু সাউথগেটের সময়ই নয় সেই ২০০০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেখা গেছে গোটা ম্যাচে প্রথমে গোল করেও মাত্র ৫০ ভাগ ম্যাচ তারা জয় লাভ করেছে। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং স্পেনের এক্ষেত্রে সফলতার হার ৮০ শতাংশ।
দলের ফর্মেশন—
বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের প্রোফাইল এবং শক্তিমত্তা অনুযায়ী তারা তাদের দলের কৌশল ঠিক করে। সাউথগেট সাধারণত অ্যাটাকিং ফর্মেশনে দলকে সাজান না। হয়তো বা নিজে একজন ডিফেন্ডার ছিলেন বলেই দলকে কিছুটা সতর্কতামূলক ভাবে খেলান।
তারা একটি শক্তিশালী রক্ষণাত্মক আকৃতির ভেতরের থেকে তারপর প্রতিপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ তারা শুরু থেকেই আক্রমণাত্মকভাবে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে না। আর এভাবে খেলেই ইউরো ২০২০’এ প্রথম ৫টি ম্যাচ তারা কোনো গোল হজম করেনি।
ইংল্যান্ড ভিন্ন ভিন্ন ফর্মেশনে খেলে থাকে। যেমন ৪-৩-৩, ৩-৪-১-২, ৩-৪-৩, ৪-২-৩-১।
ইংল্যান্ড দলের সম্ভাবনা—
বাজির দর: ৭/১। তবে ইংল্যান্ড দল কি আসলেই খুব বেশিদূর যেতে পারবে? নেশনস কাপের সর্বশেষ ৬টি ম্যাচে কোনো জয় পায়নি। ৪টিতেই পরাজিত হয়েছে এবং ড্র করেছে ২টিতে। হাঙ্গেরির মতো দলের কাছে জুন মাসে পরাজিত হয়েছে ৪-০ গোলে। অথচ এই হাঙ্গেরিকে পিছনে ফেলেই বিশ্বকাপ-২০২২ বাছাইপর্বে ইউরোপীয় অঞ্চলে গ্রুপ ‘আই’ থেকে ইংল্যান্ড প্রথম হয়ে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করেছে। যেখানে হাঙ্গেরির অবস্থান ছিল চতুর্থ স্থানে। কিন্তু গত ছয় মাসে সেই হাঙ্গেরির সঙ্গেই নেশনস কাপে দুবারের মোকাবিলায় একবারও জয় পায়নি। নেশনস কাপের ধকল কাটাতে কোনো প্রীতি ম্যাচ না খেলেই বিশ্বকাপে যোগদান করবে সরাসরি।
যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে অর্থাৎ ইংল্যান্ড যদি গ্রুপ ‘বি’ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং অন্যদিকে গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেনেগাল বা ইকুয়েডর রানার্সআপ হয় তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে সেনেগাল বা ইকুয়েডরের বাঁধা পেরোতে ইংল্যান্ডকে বেগ পেতে হবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোয়ার্টার ফাইনালে তাদেরকে ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর সব ঠিকঠাক থাকলে সেখান থেকেই ইংলিশদের বিদায় ঘণ্টা বাজতে পারে।
আমার দেখা ইংল্যান্ডের সেরা (১৯৯০ থেকে অদ্যাবধি যেসব খেলোয়াড়রা খেলেছেন)—
গোল রক্ষক:
পিটার শিলটন (ম্যাচ: ১২৩; তিনি ১০০৫ টি ক্লাব ম্যাচ খেলেন, যার মধ্যে ২৮৫টি খেলেন লেস্টার সিটি হয়ে এবং ২০২টি খেলেন নটিংহাম ফরেস্টের হয়ে। তিনি ৪১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বিদায় নেন)।
ডেভিড সীম্যান (ম্যাচ: ৭৫; তিনি ক্লাবে ৭৭১টি ম্যাচ খেলেন – ৪০৫টি ম্যাচ খেলেন আর্সেনালের পক্ষে)।
রক্ষণভাগ:
রাইট উইংব্যাক:
গ্যারি নেভিল (ম্যাচ: ৮৫; উনি সারা জীবন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছেন ৪০০টি ম্যাচ)।
কাইল ওয়াকার (ম্যাচ: ৭০; তিনি এখনো জাতীয় দলে খেলছেন। বয়স: ৩২ বছর। এযাবৎ ১৪৫টি ম্যাচ তার বর্তমান দল ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে খেলেছেন এবং তার আগে টটেনহামের হয়ে খেলেছেন ১৮৩টি ম্যাচ)।
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার:
রিও ফার্দিনান্দ (ম্যাচ: ৭০, গোল: ৩; ক্লাব দলে ৫১৪টি ম্যাচ খেলেন, যার মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলেছেন ৩১২টি ম্যাচ)।
জন টেরি (ম্যাচ: ৭৮, গোল: ৬; তিনি ক্লাবে ৫৩০টি ম্যাচ খেলেন – ৪৯২টি ম্যাচ খেলেন চেলসিতে)।
সল ক্যাম্পবেল (ম্যাচ: ৭১, গোল: ১; ক্লাবের হয়ে ৫০৪টি ম্যাচ খেলেন যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫৫টি ম্যাচ খেলেন টটেনহ্যামের হয়ে এবং ১৪৬টি খেলেন আর্সেনালের হয়ে)।
লেফট উইংব্যাক:
অ্যাশলে কোল (ম্যাচ: ১০৭; চেলসি এবং আর্সেনালের হয়ে ৫০৮টি ক্লাব ম্যাচ খেলেন – চেলসিতে ২২৯টি ম্যাচ এবং আর্সেনালে ১৫৬টি ম্যাচ)।
স্টুয়ার্ট পিয়ার্স (ম্যাচ: ৭৮, গোল: ৫; ক্লাবে ৭৪৭টি ম্যাচ খেলে ৮২টি গোল করেছেন – ৪০১টি ম্যাচে ৬২টি গোল করেন নটিংহ্যাম ফরেস্টের হয়ে)
মধ্যমাঠ:
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার:
স্টিভেন জেরার্ড (ম্যাচ: ১১৪, গোল: ২১; ক্লাব পর্যায়ে ৫৩৮টি ম্যাচ খেলে ১২৫টি গোল করেন – লিভারপুলে খেলেন ৫০৪টি ম্যাচ এবং গোল করেন ১২০টি)।
পল স্কোলস (ম্যাচ: ৬৬, গোল: ১৪; সারা জীবন শুধু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলেছেন, যেখানে ৪৯৯টি ম্যাচ খেলে ১০৭টি গোল করেন। চোখের সমস্যার কারণে ৩০ বছর বয়সে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন)।
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার:
ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড (ম্যাচ: ১০৬, গোল: ২৯; মোট ৬৪৭টি ক্লাব ম্যাচে ১৯৩টি গোল করেন – সর্বোচ্চ চেলসির হয়ে ৪৩৯টি ম্যাচে ১৪৭টি গোল করেন)।
ব্রায়ান রবসন (ম্যাচ: ৯০, গোল: ২৬; তিনি ৫৭১ ম্যাচে ১১৫টি গোল করেন, যার মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেন ৩৪৫টি ম্যাচ এবং গোল করেন ৭৪টি)।
পল গ্যাসকোয়েন (ম্যাচ: ৫৭, গোল: ১০; ইংলিশ, ইতালিয়ান এবং স্কটিশ লীগে তিনি ৩৮৪টি ম্যাচে ৮৩টি গোল করেন – ৯২টি করে ম্যাচ খেলেন নিউ ক্যাসেল এবং টটেনহ্যামে)।
ডেভিড বেকহ্যাম (ম্যাচ: ১১৫, গোল: ১০; তিনি ৫২৩টি ম্যাচ থেকে গোল করেছেন ৯৭টি – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২৬৫ এবং রিয়াল মাদ্রিদে ১১৬টি ম্যাচ খেলেন)।
ডেভিড প্ল্যাট (ম্যাচ: ৬২, গোল: ২৭; ইংল্যান্ড এবং ইতালিয়ান লিগে ৩১৪টি ম্যাচ থেকে ৯৫টি গোল করেন। প্রধানত তিনি অ্যাস্টন ভিলা এবং আর্সেনালে ১২১ ও ৮৮টি ম্যাচ খেলেন)।
জো কোল (ম্যাচ: ৫৬, গোল: ১০; বাম পায়ের এই উইঙ্গার ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ লীগে ৩৯৩টি ম্যাচ খেলেন – চেলসি এবং ওয়েস্ট হ্যামে খেলেন ১৮৩ ও ১৫৭টি ম্যাচ এবং তাদের হয়ে গোল করেন ৩৭টি)।
জন বার্নস (ম্যাচ: ৭৯ ও গোল: ১১; ক্লাবে তিনি ৫৮৬টি ম্যাচে ১৫৫ গোল করেন – বাম পায়ের এই উইঙ্গার লিভারপুলে সর্বোচ্চ ৩১৪টি ম্যাচে ৮৪টি গোল করেন)।
গ্যারি লিনেকার (ম্যাচ: ৮০ ও গোল: ৪৮; ৪৬১টি ম্যাচে ২৩৮টি গোল করেছেন লিচেস্টার সিটি, এভারটন, বার্সেলোনা ও টটেনহামে)।
হ্যারি কেন (ম্যাচ: ৭৫ ও গোল: ৫১; তার বয়স মাত্র ২৯ বছর এবং বর্তমান জাতীয় দলের খেলোয়াড়। টটেনহামের হয়ে এ পর্যন্ত ২৯৩টি ম্যাচে ১৯৪টি গোল করেন )
অ্যালান শিয়ারার (ম্যাচ: ৬৩ ও গোল: ৩০; ক্লাব লেভেলে ৫২৯টি ম্যাচে ২৮৩ টি গোল করেন – প্রধানত নিউ ক্যাসেল ক্লাবের হয়ে ৩০৩ ম্যাচে ১৪৮টি গোল করেন)
মাইকেল ওয়েন (ম্যাচ: ৮৯ ও গোল: ৪০; তিনি ৩৬২ ম্যাচে ১৭৩ গোল করেন এবং সর্বোচ্চ ২১৬টি ম্যাচ খেলেন লিভারপুলে এবং গোল করেন ১১৮টি। তিনি ইনজুরির কারণে ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল বিদায় জানান)।
ওয়েন রুনি (ম্যাচ: ১২০ ও গোল: ৫৩; ক্লাব পর্যায়ে ৫৬৯টি ম্যাচে ২৩৭টি গোল করেন – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ১৮৩টি গোল করেন ৩৯৩টি ম্যাচ থেকে)।
সারাবাংলা/এসআইটি/এসএস
ইংল্যান্ড কাতার বিশ্বকাপ কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ বিশ্বকাপের দল পরিচিতি হ্যারি কেইন