কাতার বিশ্বকাপকে ইতোমধ্যেই অঘটনের বিশ্বকাপ নামে ডাকা শুরু করেছেন কেউ কউ! সৌদি আরব হারিয়ে দিল আর্জেন্টিনাকে। একদিন জাপানের বড় চমক। চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট জার্মানিকে হারিয়ে দিলো এশিয়ার দল জাপান। অথচ ১৯৯১ সাল পর্যন্তও জাপানি ফুটবল তাদের সর্বনিম্ন অবস্থানে অবস্থান করছিল। তাদের তখন পেশাদার লীগের কাঠামো ছিল না। তার পর থেকে জাপানি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ১০০ বছরের পরিকল্পনা হাতে নেয়।
এরপরই জে-লীগের জন্ম হয়। জাপানের প্রথম স্বপ্ন ছিল পেশাদার ফুটবল লীগের মাধ্যমে একদিন এশিয়ার সেরা হয়ে উঠবে। স্বপ্ন ছিল একটি সফল এবং টেকসই লীগ থাকবে যার জন্য এশিয়াবাসী গর্ব করতে পারে – যেখানে ১০০টি পেশাদার ক্লাব থাকবে এবং সবশেষে ২০৯২ সালের মধ্যে বিশ্বকাপ জিতবে। এসবই ছিল স্বপ্নের অংশ।
৩০ বছর পর আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? প্রধান ইতিবাচক লক্ষণ হল যে সারা দেশে ফুটবলের প্রতি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের দুটি সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা, সুমো কুস্তি ও বেসবলের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে জাপান সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করে। তার আগে তাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয় করা। জে-লীগ শুরু করার আগে প্রায় ৩০ বছর জাপানে অপেশাদার লীগ চালু ছিল। ৬৮ সালে ব্রোঞ্জ জয় করার পর থেকেই জাপানিরা ফুটবলের প্রতি আগ্রহ বোধ শুরু করে।
জে-লীগের শুরুতে ব্রাজিল থেকে জিকো, দুঙ্গা, লিওনার্দো এবং লিনেকাররা আসতে শুরু করেন। তারপর থেকেই স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শক আসা শুরু হল। ব্রাজিলের থেকে খেলোয়াড় আসার সাথে সাথে এশিয়ার অন্যান্য সেরা খেলোয়াড়রাও এই লীগে খেলা শুরু করেন যা পরবর্তীতে জাপানের ফুটবলের মান উন্নত করতে সাহায্য করেছে। পেশাদার লীগের প্রথম তিন বছরের মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে ২১তম স্থানে উঠেছিল এবং প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় বিশ হাজার দর্শক মাঠে জড়ো হওয়া শুরু করে।
কিন্তু ১৯৯৭ সালের দিকে জাপানে অর্থনৈতিক মন্দ শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া শুরু করে এবং কিছু কিছু বড় ক্লাব দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন জাপানি ফুটবল ফেডারেশনের পরামর্শক্রমে ক্লাবগুলো স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সাথে অংশীদারি ভিত্তিতে আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদেরকে উঁচু স্তরের প্রতিযোগিতায় স্থান পাইয়ে দিতে তৃণমূল একাডেমী গুলোর সাহায্য গ্রহণ শুরু করে।
পরবর্তীতে তারা জে-লীগে, দুই স্তরের লীগ চালু করার পাশাপাশি দল সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। জে১-লীগে আগে যেখানে দল সংখ্যা ছিল ১৬টি, সেখানে পরবর্তীতে তা ১৮তে উন্নীত হয়। অন্যদিকে জে২-লীগে দল সংখ্যা ১০ থেকে ২২-এ বৃদ্ধি করা হয়। ফলে এক ধাক্কায় লীগগুলোতে ১৪টি দল বেড়ে যায়।
আর এর সুফল পাওয়া শুরু করে দ্রুতই, কারণ তারা ১৯৯৮ সালে ফুটবল র্যাঙ্কিং-এ ৯ নম্বরে উঠে আসে। ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু করা এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে জাপানি ক্লাবগুলো যেখানে আগে জে-লীগ শুরু করার আগে মাত্র ২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেখানে জে-লীগ শুরু করার পর ১৯৯৮ সাল থেকে তাদের ক্লাবগুলো আরও ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়। এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে এখন পর্যন্ত জাপানের ৬টি ক্লাব শিরোপা জয় করেছে। শুধু কি তাই ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এশিয়ান কাপে জাপান সৌদি আরব এবং ইরানকে টপকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৪ বার শিরোপা জয় করেছে, অথচ তাদের প্রথম শিরোপা এসেছিল ১৯৯২ সালে।
১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে জাপান প্রতিটি বিশ্বকাপেই খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। জাপানের জাতীয় দল বর্তমানে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে চব্বিশতম এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তারা এশিয়ার অন্যান্য দল যেমন ইরান বা সৌদি আরবের চেয়ে গতিময়, আক্রমণাত্মক এবং বল পজেশন নিজেদের দখলে বেশি রেখে ফুটবল খেলে থাকে। ফলে তাদের খেলা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে জাপান তাদের গ্রুপের তিনটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি পজেশন রেখে খেলেছিল এবং এই হারছিল ৫৫-৬২% পর্যন্ত। শুধুমাত্র দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে বেলজিয়ামের কাছে ২-৩ গোলে পরাজিত ম্যাচে তাদের বল পজেশন ৪২% ছিল, যেই ম্যাচটিতে তারা নাসের চাদলির ৯৪ মিনিটে করা গোলে বাদ পড়ে যায়।
জাপানিরা সাধারণত তাদের জাতীয় দলে জাপানি কোচদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ১৯৯২ সালের পর থেকে তাদের ফুটবলের রেনেসাঁ শুরু হলে ব্রাজিলের ফ্যালকাও এবং জিকোর পাশাপাশি ফ্রান্সের ফিলিপ ট্রুসিয়ার, ইতালির আলবার্তো জাকেরনির মত কোচদের সান্নিধ্যে থেকে তাদের খেলায় ব্রাজিল, ফ্রান্স এবং ইতালির মতো কৌশল প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। জাপানের জাতীয় দলের কোচের মধ্যে জিকো সর্বোচ্চ ৭১টি ম্যাচে কোচিং করিয়েছেন আর তার ঠিক পরেই আছেন তাদের বর্তমান কোচ হাজিমে মরিয়াসু যিনি এ পর্যন্ত ৫৮টি ম্যাচে কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মরিয়াসু ২০১৮ সাল থেকে জাপান দলের কোচ হিসাবে কাজ করছেন। তিনি তার দলকে এবারের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যাবার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। গতকাল জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে তিনি তার স্বপ্নযাত্রার সঠিক পথেই রয়েছেন। মোরিয়াসু নতুন প্রজন্মকে ঘিরে তার দল গড়ে তুলেছেন। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত গত বিশ্বকাপে যারা নিয়মিত খেলেছেন তাদের মধ্যে কারো বয়স ২৫ বছরের কম ছিল না। সেই তুলনায় এবারের বিশ্বকাপের দলটি বেশ তরুণ। কোচ বলেছেন, তার দলে তিনি অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
তাদের স্কোয়াডের অধিকাংশ সদস্য বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন দলগুলোর হয়ে খেলছে। কাতার বিশ্বকাপে থাকা ২৬ জন দলের ২০ জনই খেলছেন ইউরোপীয় লীগ গুলোতে। এই বিশ্বকাপে তাদের মিডফিল্ড সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা। বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়া ৯ জন মিড-ফিল্ডার ইউরোপে খেলছেন। মিনামিনো ছাড়াও জুনিয়া ইতো, এন্ডো, মরিতা, মিতোমা এবং কামাদার মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে এমন মিডফিল্ড জাপান এর আগে পায়নি।
গতকাল জার্মানির বিপক্ষে অভাবনীয় সাফল্যের পর জাপানের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা উজ্জ্বল হল। যেখানে তাদের লড়তে হবে বেলজিয়াম বা ক্রোয়েশিয়ার সাথে। যদি তাই হয় তবে তাদের সাক্ষাৎ হতে পারে বেলজিয়ামের সাথে, আর সেক্ষেত্রে গত বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে যাওয়ার বদলা জাপান এবার নিতে পারে কিনা তার দিকে তাকিয়ে আছে এশিয়াবাসী। গতকালের বিজয় সূচক গোলদাতা তাকুমা আসানো পারফরম্যান্স রেটিং-এ ৯/১০ পেয়েছেন সেই সাথে আরেক স্ট্রাইকার দাইজেন মায়েদা প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি এবং পরিশ্রম প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রতিটি বলের পেছনে তাড়া করে গিয়েছেন। ফলে বিশ্বকাপের আগে স্ট্রাইকারদের গোল সংকট নিয়ে যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল তা মিটে গেলেই জাপানের কোয়ার্টার ফাইনালে যাবার রাস্তা প্রশস্ত হবে সেই আশা আমরা করতেই পারি।
আমার দেখা জাপানের সেরা ১৪ খেলোয়াড় (বর্তমান ও নতুন খেলোয়াড় সহ):
যারা পূর্ববর্তী বিশ্বকাপে খেলেছেন, তাদের উপরে ভিত্তি করে বাছাই করা হয়েছে।
১) গোল-রক্ষক:- ইজি কাওয়াশিমা (ম্যাচ সংখ্যা: ৯৫টি। বয়স: ৩৯ বছর। এখনও জাতীয় দল এবং ফরাসি ক্লাব স্ট্রাসবার্গের সাথে খেলছেন। ইউরোপে এখন পর্যন্ত ১৪৪টি ম্যাচ খেলেছে – সর্বোচ্চ ৬৮টি ম্যাচ বেলজিয়াম লীগে স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজর সাথে খেলেছেন)।
২) রক্ষণ-ভাগ:-
রাইট-ব্যাক: হিরোকি সাকাই (ম্যাচ সংখ্যা: ৭৩টি এবং গোল সংখ্যা: ১টি। বয়স: ৩২ বছর। জাতীয় দলের বর্তমান খেলোয়াড়। ইউরোপীয় সার্কিটে ২৩৭টি ম্যাচ খেলেছেন – ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ের সাথে ১৪৫টি ম্যাচ খেলেছেন)।
সেন্ট্রাল-ডিফেন্ডার: মায়া ইয়োশিদা (ম্যাচ: ১২৩টি এবং গোল: ১২টি। ৩৪ বছর বয়স্ক বর্তমান জাতীয় দলের ডিফেন্ডার খেলছেন জার্মানির শালকে-০৪ ক্লাবে। তিনি ইউরোপে এখনো পর্যন্ত ২৯৫টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছেন ভিভিভি-ভেনলো, সাউদাম্পটন, সাম্পডোরিয়া প্রভৃতি ক্লাবে)।
ইউজি নাকাজাওয়া (ম্যাচ: ১১০টি এবং গোল: ১৭টি। জাপানি লিগে ৫৯৩টি ম্যাচ খেলেছেন – ইয়োকোহামা মারিনোসের সাথে সর্বোচ্চ ৫১০টি ম্যাচ খেলেছেন)।
লেফট-ব্যাক: ইউতো নাগাতোমো (ম্যাচ: ১৩৯টি এবং গোল: ৪টি। বয়স: ৩৬ বছর। জাতীয় দলের বর্তমান খেলোয়াড়। ইউরোপে ২৫৮টি ম্যাচ খেলেছেন – সর্বোচ্চ ইন্টার মিলানের সাথে ১৭০ ম্যাচ খেলেছেন)।
৩) মধ্য-মাঠ:-
রক্ষণাত্মক-মিডফিল্ড: মাকোতো হাসেবে (ম্যাচ: ১১৪টি এবং গোল: ২টি। জার্মান বুন্দেসলিগায় ৩৬ ২টি ম্যাচ খেলেছেন – আইনট্রাক্ট ফ্রাঙ্কফুর্টের সাথে ২১৩টি ম্যাচ খেলেছেন)।
আক্রমণাত্মক-মিডফিল্ড: হিদেতোশি নাকাতা (ম্যাচ: ৭৭টি এবং গোল: ১১টি। ইতালিয়ান সিরি-এ এবং ইংলিশ লিগের সাথে ২০৩টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ২৫টি গোল করেছেন – ইতালিয়ান ক্লাব পারমা, পেরুগিয়া, রোমা ইত্যাদির সাথে ১৮২টি ম্যাচ খেলেছেন)। শানসুকে নাকামুরা (ম্যাচ: ৯৮টি এবং গোল: ২৪টি। ইউরোপিয়ান লীগে খেলেছেন ২২২টি ম্যাচ – বেশিরভাগই সেল্টিকের সাথে ১২৮টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ২৯টি গোল করেছেন)।
শিনজি কাগাওয়া (ম্যাচ: ৯৭টি এবং গোল: ৩১টি। ইউরোপীয় সার্কিটে ২৫৫টি ম্যাচ খেলেছেন – বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সাথে ১৪৮টি ম্যাচ খেলে ৪১টি গোল করেছেন)।
৪) ফরোয়ার্ড:- শিনজি ওকাজাকি (ম্যাচ: ১১৯টি এবং গোল: ৫০টি। ইউরোপে এখন পর্যন্ত ৩৪১টি ম্যাচ খেলেছেন – লিসেস্টার সিটির সাথে ১১৪টি ম্যাচ খেলেছে এবং বুন্দেসলিগায় ১২৮টি ম্যাচ খেলেছেন)।
কাজুয়োশি মিউরা (ম্যাচ: ৮৯টি এবং গোল: ৫৫টি। জাপানি লীগ ছাড়াও ব্রাজিলের লীগে খেলেছেন ৯৩টি ম্যাচ। এছাড়াও ইতালীয় দল জেনোয়া এবং ক্রোয়েশিয়ান দিনামো জাগরেবে সংক্ষিপ্ত স্পেলের জন্য খেলেছেন)।
৫) অতিরিক্ত:- ডিফেন্ডার, মাসামি ইহারা (ম্যাচ: ১২২টি এবং গোল: ৫টি। সব সময় জাপানি ক্লাবে খেলেছেন – সর্বোচ্চ ২৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন ইয়োকোহামা মারিনোসের সঙ্গে)।
মিডফিল্ডার, জুনিচি ইনামোতো ((ম্যাচ: ৮২টি এবং গোল: ৫টি। ইউরোপে খেলেছেন ১৫৬টি ম্যাচ – ফুলহ্যাম এবং আইনট্রাক্ট ফ্রাঙ্কফুর্টের হয়ে ৪১ এবং ৪৩টি ম্যাচ খেলেছেন। তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন)।
মিডফিল্ডার, কেইসুকে হোন্ডা (ম্যাচ: ৯৮টি এবং গোল: ৩৭টি। ইউরোপীয় সার্কিটে ১৭৯টি ম্যাচ খেলেছেন – তাদের মধ্যে সিএসকেএ মস্কো এবং এ.সি মিলান ক্লাবে খেলেছেন ৯৪ এবং ৮১টি ম্যাচ)।