মরক্কো ফুটবলের জয়যাত্রার গল্প
১ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০৮
মরক্কো এবারের বিশ্বকাপসহ ৬ষ্ঠ বারের মতো বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে বিশ্বকাপে ক্যামেরুন আফ্রিকা থেকে সর্বোচ্চ ৮ বার অংশগ্রহণ করে ১৯৯০ সালে সর্বোচ্চ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল। দ্বিতীয় স্থানে আছে নাইজেরিয়া যারা ৬ বারের অংশগ্রহণে ৩ বারই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত গিয়েছিল।
মরক্কো ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। পূর্বের ৫টি আসরে তারা কেবলমাত্র ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত যেতে পেরেছিল আর সেটা ছিল আরব দেশ হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রথমবারের মতো উত্তরণ। তারা পোল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের সঙ্গে ০-০ গোলের ড্র করার পাশাপাশি পর্তুগালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে সেবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানির কাছে ০-১ ব্যাবধানে পরাজিত হতে হয় লোথার ম্যাথাউসের করা ৮৮ মিনিটের গোলে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপেও তারা পশ্চিম জার্মানির কাছে পরাজিত হয়েছিল ১-২ গোলে।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ একমাত্র ব্যতিক্রম যে টুর্নামেন্টে তারা কোন পয়েন্ট পায়নি, যদিও তিনটি দলের কাছেই তারা ন্যূনতম এক গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তারা ৪ পয়েন্ট পেলেও পরবর্তী রাউন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। স্কটল্যান্ডকে পরাজিত করে ৩-০ গোলে, তবে নরওয়ের সঙ্গে ম্যাচটিতে আত্মঘাতী গোল এবং গোল-রক্ষকের বেশ কয়েকবার ভুলের কারণে ২-২ গোলে ড্র করতে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৮ সালে তারা ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১০তম স্থানে ছিল আর বর্তমানে আছে ২২তম স্থানে।
আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস টুর্নামেন্টে মরক্কো মাত্র ১ বার ১৯৭৬ সালে শিরোপা জিতেছিল আর রানার্সআপ হয়েছিল ২০০৪ সালে। এই টুর্নামেন্টটিতে সর্বোচ্চ ৭ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মিশর, কিন্তু বিশ্বকাপে তারা ৩ বারের বেশি কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ক্যামেরুন আফ্রিকা কাপ অফ নেশনসের শিরোপা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ বার জিতেছে আর ঘানা জিতেছে ৪ বার।
সিএএফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লীগে মিশরের ক্লাবের জয় জয়কার। এই টুর্নামেন্টে মিশরের ক্লাবগুলো সর্বোচ্চ ১৬ বার শিরোপা জয় করেছে, যেখানে মরক্কোর ক্লাবগুলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ বার শিরোপা লাভ করেছে।
তবে সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে সিএএফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতেছে মরক্কোর ওয়াইদাদ অ্যাথলেটিক ক্লাব, যারা ফাইনালে মিশরের আল-আহলি ক্লাবকে পরাজিত করেছিল। সেই সাথে ২০২১-২২ মৌসুমে আফ্রিকার দ্বিতীয় সেরা সিএএফ কনফেডারেশন কাপও জিতে নিয়েছে মরক্কোর আর.এস বারকানে ক্লাব যারা দক্ষিণ আফ্রিকার অরলান্ডো পাইরেটসকে ফাইনালে টাই-ব্রেকারে হারিয়ে একই বছরে আফ্রিকা অঞ্চলের দুইটি বড় ক্লাব শিরোপা জিতে নিয়েছে। অন্যদিকে মরক্কোর ‘এ’ দল ২০১৮ এবং ২০২০ সালে আফ্রিকান নেশনস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিয়েছিল। অর্থাৎ মরক্কো আগামী দিনের জন্য যে যথেষ্ট প্রস্তুত তা এই ফলাফলের মাধ্যমে আমরা অবগত হলাম।
ভবিষ্যতের জন্য মরক্কোর প্রস্তুতি কেমন:
সিএএফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লীগে মিশরের আল-আহলি ক্লাব মরক্কোর ওয়াইদাদ ক্লাবের কাছে হেরে যাবার পর, আল-আহলির দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ পিতসো মোসিমানে বলেছেন মরক্কো দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে ফুটবলে ২০ বছর এগিয়ে গেছে। তিনি আরো জানিয়েছেন উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো ঐতিহ্যগত ভাবে ফুটবলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, রাজনীতি এবং ধর্মের পরে ফুটবল এখানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
বুরকিনা ফাসোর খেলোয়াড়, অ্যালাইন ট্রাওরে যিনি কিনা ৬৫ ম্যাচে ২১ গোল করেছেন, তিনি ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মরক্কোর ফুটবল খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের লীগ এই মুহূর্তে আফ্রিকান অঞ্চলের সেরা লীগ।
২০১৪ সালে মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান হয়ে আসেন ফৌজি লেকইয়া, যিনি এসে মরক্কোর ফুটবলের উন্নয়নে তিনটি বিষয়ে প্রাধান্য দেন:
১) প্রথমে যে কাজটি করেন সেটা হল মরক্কো জুড়ে যে সমস্ত স্টেডিয়াম বা খেলার মাঠগুলো ছিল সেগুলোর সংস্কার বা নতুন করে তৈরি করা শুরু করেন এবং এর পাশাপাশি মাঠগুলোতে তিনি টার্ফের পরিবর্তে ন্যাচারাল ঘাসে খেলার উপরে জোড় দেন।
২) দ্বিতীয় যে কাজটি করেন, সেটা হলো সব ফুটবল ক্লাবগুলোকে ফেডারেশনের নজরদারিতে নিয়ে আসেন এবং প্রথম বিভাগে প্রতিনিধিত্ব করা সব ক্লাবগুলোকে বার্ষিক ৭ লাখ ডলার করে অনুদান দেবার ব্যবস্থা করেন। ফেডারেশন প্রতিটি ক্লাবের খেলোয়াড়রা সময়মতো বেতন পান কিনা এবং মাঠ ভালো অবস্থায় থাকে কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করে। শুধু তাই নয় জাতীয় লীগে ভালো করা দলগুলোকে তিনি বিশেষ বোনাস দিয়ে থাকেন। সেই সাথে আফ্রিকান ক্লাব কাপে অংশ নেয়া দল গুলোকে ভ্রমণ এবং বাসস্থানের জন্য ফেডারেশন থেকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। ৩) আরেকটি কাজ ফুটবল ফেডারেশন খুব সুন্দর ভাবে করে যাচ্ছে সেটা হল তরুণদেরকে প্রফেশনাল ফুটবল দলে সুযোগ পাওয়ার আগে তাদের ঘষামাজা করার কাজটিও তদারকি করছে।
আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস এবং ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে মিশরের জয় জয়াকার ভাঙার জন্য মরক্কো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই তরুণদের জন্য মরক্কো জুড়ে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রয়েছে যার ব্যবস্থাপনা থেকে বর্তমান বিশ্বকাপ দলে উঠে এসেছেন ইউসুফ এন-নেসিরি, আজ্জেদিন ওনাহি, নায়েফ আগুয়ের্দের মত খেলোয়াড় যারা স্পেন, ফ্রান্স এবং ইংলিশ লীগ মাতিয়েছেন।মরক্কোর সালেতে অবস্থিত মোহাম্মদ VI ফুটবল ন্যাশনাল একাডেমিতে ২০১৮ সালে ৬৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়, যাকে আফ্রিকা ফুটবলের ‘স্পোর্টস মক্কা’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই ন্যাশনাল একাডেমিতে তারাই সুযোগ পাবেন যারা বিভিন্ন রাজ্যের একাডেমিতে ভালো ফল করতে পারবে। বর্তমানে এই একাডেমিতে চালু কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করে পর্তুগাল ও ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার নুনো গোমেজ এবং মিকেল সিলভেস্ট্রে একে বিশ্বমানের বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ফুটবলকে পুরো মরক্কোতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন শহরে বড় বড় স্টেডিয়াম তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কাসাব্লাঙ্কা, রাবাত, আগদির, মারাকেশ, ফেজ, ট্যাঙ্গিয়ার প্রভৃতি শহরে ৬টি স্টেডিয়াম রয়েছে যাদের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৬৭ হাজারের মধ্যে। স্টেডিয়ামগুলো হল স্টেড মোহাম্মদ ভি, স্টেড প্রিন্স মৌলে আবদেল্লাহ, আদর স্টেডিয়াম, গ্র্যান্ড স্টেড ডি মারাকেশ, ফেজ স্টেডিয়াম এবং স্তাদে ইবনে বতুতা। এছাড়া মরক্কো পর্তুগাল এবং স্পেনের সাথে যৌথভাবে ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার অংশ হিসেবে ৯৩ হাজার এবং ৫৫ হাজার দর্শক আসন বিশিষ্ট দুটি নতুন স্টেডিয়াম, গ্র্যান্ড স্টেড ডি ক্যাসাব্লাঙ্কা ও গ্র্যান্ড স্টেড ডি ওজাদা নির্মীয়মান অবস্থায় রয়েছে। আর এসবই মরক্কোর ফুটবলে এক নতুন গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে।
ফুটবলের প্রতি মরোক্কানরা আরেকটি কারণে গভীর ভালোবাসা বোধ করে কারণ তাদের দেশে নামে মাত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ফলে তরুণ জনগোষ্ঠীর সরাসরি প্রতিবাদ করার সুযোগ না পাওয়ায় ফুটবল মাঠেই তাদের রাজনীতি চর্চা সবচেয়ে বেশি হয়। অন্যদিকে ঐতিহ্যগতভাবে গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করা মরক্কোর রাজারা সুযোগ পেলে ফুটবল মাঠে নিজেদেরকে জাহির করার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং নতুন ক্রীড়া সুবিধা উদ্বোধনের উছিলায় কিছু বিনিয়োগ করার পাশাপাশি সমাজে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে জনগণের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার চেষ্টা করতেন এবং করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় আমরা মরক্কোর স্টেডিয়ামগুলোতে দর্শক সংঘাতের খবর পেয়ে থাকি, যা আসলে তরুণ প্রজন্মের জনগণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গেলে পুলিশি প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়ে স্টেডিয়ামে বিরূপ পরিবেশ তৈরি হয়।
৯০ দশকে মেয়েরা ফুটবল খেলতে গেলে নানারকম কটুক্তির শিকার হত। সেই দিনও এখন বদলে গেছে। ১৯৯৮ সাল থেকে মরক্কোর মহিলা ফুটবল দল গঠন করার পর ২০২৩ মহিলা বিশ্বকাপে তারা প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
ফিফাও মরক্কোর বিভিন্ন ফুটবল উন্নয়ন কার্যক্রমে বেশ খুশী। গত জুনে মরক্কোতে ফিফা আয়োজিত ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট স্কিম (TDS) কর্মশালাতে ফিফা উল্লেখ করেছে, মরক্কো নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার, সৃষ্টিশীল মিড-ফিল্ডার এবং কার্যকরী ফরোয়ার্ড তৈরি করার জন্য বিশ্বব্যপী একটি ভালো মডেল হতে পারে।
বর্তমান দলের খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা:
মরক্কোর বর্তমান বিশ্বকাপ দলে ২৬ জনের ২০ জনই খেলছেন ইউরোপের স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, তুরস্ক, ইতালি এবং বেলজিয়ামের বিভিন্ন ক্লাব দলে। এই ২০ জনের ১৮ জনই ইউরোপের প্রথম স্তরের লীগে এখন পর্যন্ত ২০২৪টি ম্যাচ খেলেছেন, অর্থাৎ গড়ে এই ১৮ জন প্রায় ১১২টি ম্যাচ খেলেছেন ইউরোপের প্রথম সারির ক্লাব গুলোতে। গোলরক্ষক পজিশন থেকে শুরু করে ডিফেন্স, মিডফিল্ড এবং স্ট্রাইকারদের বেশিরভাগই ইউরোপের বিভিন্ন দলে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, ২৬ জনের ১৩ জনই জন্মেছেন মরক্কোর বাইরে। নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেছেন ৪ জন, বেলজিয়ামে ৩ জন, স্পেনে ২ জন, ফ্রান্সে ২ জন এবং ইতালি ও কানাডাতে ১ জন করে।
এই মুহূর্তে মরক্কোর সেরা খেলোয়াড় হাকিম জিয়েশ, নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেছেন, যিনি কিনা বর্তমানে চেলসিতে খেলছেন এবং এখন পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে ২৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন। আরেক মিড-ফিল্ডার সোফিয়ান বাউফল খেলেছেন ২০২টি ম্যাচ। সেভিয়াতে খেলা গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো ২০০টি ম্যাচ খেলেছেন। ডিফেন্ডারদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ১৯০টি ম্যাচ খেলেছেন রোমেইন সাইস, যিনি উলভারহ্যাম্পটনে খেলেছেন ১৭৩টি ম্যাচ। মিড-ফিল্ডার, সোফিয়ান আমরাবাত খেলে ফেলেছেন ১৯৬টি ম্যাচ, যিনি এখন ইতালির ফিওরেন্টিনাকে খেলছেন। স্ট্রাইকারদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ১৭৬টি ম্যাচ খেলেছেন ইউসুফ এন নেসিরি যিনি কিনা বর্তমানে সেভিয়াতে খেলছেন। এছাড়া ইউরোপীয় অঙ্গনে পরিচিত স্পেনের মাদ্রিদে জন্মগ্রহণ করা রাইট ফুল-ব্যাক, আশরাফ হাকিমি এখন খেলছেন পিএসজিতে। আরেক ফুল-ব্যাক নওসাইর মাজরাউই খেলেন আয়াক্সে।
উপরের তথ্য থেকেই বোঝা যায় মরক্কোর এই দলটি বেশ অভিজ্ঞ। যদিও তাদের গড় বয়স মাত্র ২৬.২ বছর। দলের সকল খেলোয়াড় মিলে প্রায় ৫৫৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। মূল একাদশের খেলোয়াড়রা খেলেছেন ৪১৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, গড় হিসেব করলে তারা প্রায় ৩৮টি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। অর্থাৎ দলটি তরুণ হলেও তাদের ইউরোপীয় লীগ এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে যথেষ্ট।
বর্তমান জাতীয় দলের কোচ কে? মরক্কোর ৪৭ বছর বয়সী বর্তমান কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। একজন রাইট-ব্যাক হিসেবে তিনি মরক্কোর হয়ে ৪৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন। এছাড়া ক্লাব ফুটবল খেলেছেন ফ্রান্স এবং স্পেনে, এ দুটি দেশের লীগে তিনি প্রায় ২০০টির মত ক্লাব ম্যাচ খেলেছেন। ফ্রান্সের আজাসিও ক্লাবে খেলেছেন সর্বোচ্চ ৭২টি এবং তুলুজে খেলেছেন ৩৭টি ম্যাচ। খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে তার সেরা সাফল্য ছিল ২০০৪ আফ্রিকা কাপ অফ নেশনসের রানার্স-আপ হওয়া।
বিশ্বকাপের ঠিক আগে তিনি মরক্কো জাতীয় দলের কোচ হিসেবে যোগদান করেন এই বছরের আগস্ট মাসে এবং বিশ্বকাপের ২টি ম্যাচ সহ এ পর্যন্ত ৫টি ম্যাচের ৩টিতে জয় তুলে নিয়েছেন এবং ২টিতে ড্র করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোচ হিসেবে স্বল্প পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও মরক্কোর জাতীয় দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপের মাত্র তিন মাস আগে তিনি জায়গা পান বসনিয়ান কোচ ভাহিদ হালিলহোজিচের জায়গায়। কোচের দায়িত্ব পেয়েই তিনি ফিরিয়ে আনেন চেলসিতে খেলা দলের সেরা খেলোয়াড় হাকিম জিয়েশকে, যিনি কিনা পূর্বতন কোচ হালিলহোজিচের সময় আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস এবং বিশ্বকাপের বাছাই-পর্বে কোচের সাথে মনোমালিন্যের কারণে বাদ পড়েছিলেন। রেগরাগুই জিয়েশকে ফিরিয়ে এনে কত ভালো কাজ করেছেন তার প্রমাণ গতকাল বিশ্ববাসী দেখতে পেয়েছে। বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে জয় পাওয়া ম্যাচটিতে জিয়েশ দুটি গোলেই অবদান রেখেছেন।
রেগরাগুই এর আগে ২০১২-১৩ মৌসুমে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মরক্কোর সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় দলে কাজ করার আগে তিনি প্রায় ৮ বছর মরক্কো এবং কাতার লীগে কাজ করেন। তার উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে ২০২১-২২ মৌসুম ওয়াইদাদ অ্যাথলেটিক ক্লাবকে মরক্কোর শীর্ষ ফুটবল লীগের চ্যাম্পিয়ন করানো। আর এখন পর্যন্ত তার সেরা সাফল্য হচ্ছে ওয়াইদাদ ক্লাবকে সিএফ চ্যাম্পিয়নস লীগে ২০১৭ সালের পর আবার চ্যাম্পিয়ন হবার স্বাদ পাইয়ে দেয়া, যেটা ছিল তাদের তৃতীয় শিরোপা। ফাইনালে তার দল হারিয়েছিল মিশরের আল-আহলিকে ২-০ গোলে, আর জিতে নিয়েছিল ২.৫ মিলিয়ন ডলারের প্রাইজমানি। আল-আহলিকে হারানো সহজ কথা নয় কারণ তারা এই টুর্নামেন্টটিতে ১০ বার চ্যাম্পিয়ন ও ৫ বার রানার্সআপ হয়েছিল।
বর্তমান দলের সঙ্গে ২০১৮ বিশ্বকাপের দলের কৌশলগত পার্থক্য:
২০১৮ বিশ্বকাপের সময়ও দলটিতে ২৩ জনের স্কোয়াডে ১৮ জন খেলোয়াড় ছিল যারা ফ্রান্স, বেলজিয়াম বা জার্মানির মতো দেশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও মরক্কোর হয়ে খেলেছিল। হার্ভে রেনার্ড তখন তাদের কোচ ছিলেন যিনি কিছুটা আক্রমণাত্মক খেলাতে পছন্দ করেন, যার উদাহরণ আমরা এবারের বিশ্বকাপে সৌদি আরবকে দেখছি।
রেনার্ডর নেতৃত্বে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে না যেতে পারলেও তারা লড়াই করেছিল সেয়ানে সেয়ানে। ইরানের সঙ্গে ০-১ গোলে পরাজিত হওয়া ম্যাচটিতে তারা গোল খেয়েছিল ৯৪ মিনিটের আত্মঘাতী গোলে। যদিও বল পজেশন রেখেছিল ৬৮%, শট নিয়েছিল ১৩টি যার মধ্যে ৩টি টার্গেটে ছিল, অথচ তার বিপরীতে ইরানিরা ৯টি শট নিয়েছিল এবং টার্গেটে ছিল মাত্র ২টি শট। পর্তুগালের সঙ্গে ম্যাচটিতেও তারা ০-১ গোলে হেরেছিল রোনালদোর দেয়া গোলে, কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও সেই ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করেছিল মরোক্কানরা। কারণ তারা বল পজেশন রেখেছিল ৫৫%, শট নিয়েছিল ১৫টি যার মধ্যে টার্গেটে ছিল ৪টি। পক্ষান্তরে পর্তুগিজরা ১০টি শট নিয়ে টার্গেটে রাখতে পেরেছিল মাত্র ২টি শট। আর স্পেনের সাথে ২-২ গোলে ড্র হওয়া শেষ ম্যাচটিতে ৯০ মিনিট সময় পর্যন্ত এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ৯১ মিনিটে স্পেন সমতা আনলে, মাত্র ১ পয়েন্ট অর্জন করায় গ্রুপ পর্যায় থেকে বাদ পড়তে হয়।
আর এই বিশ্বকাপে রেগরাগুইর কোচিংয়ে প্রথম ২টি ম্যাচে মরক্কো ৪ পয়েন্ট তুলে নিয়েছে। এবার তারা বল পজেশন নিজেদের দখলে রাখা কমিয়ে দিয়ে গোল না খাবার পণ করেছে ফলশ্রুতিতে প্রথম দুটি ম্যাচে তারা কোন গোল হজম করেনি। কিছুটা রক্ষণাত্মক হওয়ায় শট নেয়ার হার কমে গেলেও গোল পোস্ট বরাবর অর্থাৎ টার্গেটে তারা ঠিকই গতবারের মতো শট নিতে সক্ষম হচ্ছে। মরক্কো প্রথম দুটি ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া এবং বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ১৮টি শট নিয়ে ৬টি শট টার্গেটে রাখতে পেরেছিল, অথচ এই দুই প্রবল প্রতিপক্ষ মাত্র ১৫টি শট নিয়ে টার্গেটে রাখতে পেরেছে ৫টি শট।
আমার দেখা সেরা ১৪ খেলোয়াড় (বর্তমান ও নতুন খেলোয়াড় সহ):
১) গোল-রক্ষক:- i) ইয়াসিন বোনো (ম্যাচ: ৪৭টি। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই খেলোয়াড়ের জন্ম কানাডায়। বয়স ৩১ বছর। তিনি এখনও জাতীয় দল ও স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ার সাথে খেলছেন। এখন পর্যন্ত সেভিয়ার সাথে ৮২টি ম্যাচ খেলেছেন এবং তার আগে ইতালীয় দল জিরোনার সাথে ৮৩টি ম্যাচ খেলেছেন)।
২) রক্ষণ-ভাগ:-
রাইট-ব্যাক: ii) আশরাফ হাকিমি (ম্যাচ: ৫৬টি এবং গোল: ৮টি। তিনি স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। বয়স: ২৪ বছর। তিনি বর্তমান জাতীয় দল এবং প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর সাথে খেলছেন। তিনি এখন পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, ইন্টার মিলান এবং প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর সাথে ১৪৬টি ম্যাচ খেলেছেন)।
সেন্ট্রাল-ডিফেন্ডার: iii) নুরদ্দীন নেয়বেত (ম্যাচ: ১১৫টি এবং গোল: ৪টি। তিনি ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেনে ৩৭৩টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছেন – সর্বোচ্চ ২২১টি ম্যাচ খেলেছেন স্প্যানিশ দেপোর্তিভো লা করোনার সাথে)।
- iv)রোমেইন সাইস(ম্যাচ: ৬৮টি এবং গোল: ২টি। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই খেলোয়াড় ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। বয়স: ৩২ বছর। তিনি বর্তমান জাতীয় দল এবং তুর্কি বেসিকতাস ক্লাবের সাথে খেলছেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং তুরস্ক লীগ গুলোতে এখন পর্যন্ত ৩৪৪টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছেন – ইংল্যান্ডে উলভারহ্যাম্পটনের সাথে সর্বোচ্চ ১৭৬ ম্যাচ খেলেছেন)।
লেফট-ব্যাক: v) আবদেলক্রিম এল হাদ্রিউই (ম্যাচ: ৭২টি এবং গোল: ৪টি। বেনফিকা, এ জেড আলকমার, শার্লেরোই ইত্যাদি শীর্ষ স্তরের ক্লাবে ১৬৮টি ম্যাচ খেলেছেন)।
৩) মধ্য-মাঠ:-
রক্ষণাত্মক-মিডফিল্ড: vi) করিম আল-আহমাদি (ম্যাচ: ৬৬টি এবং গোল: ১টি। তিনি নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ডাচ এবং ইংলিশ লিগে ৩৫৬টি ম্যাচ খেলেছেন – ফেইনুর্ডের সাথে সর্বোচ্চ ২১৬টি ম্যাচ খেলেছেন)।
আক্রমণাত্মক-মিডফিল্ড: vii) মুস্তাফা হাজি (ম্যাচ: ৬৩টি এবং গোল: ১২টি। শীর্ষ স্তরে ৪১৪টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ১১৮টি গোল করেছেন – ফরাসি ভিত্তিক ন্যান্সির সাথে ২৪৩ ম্যাচ খেলে ৯৮ গোল করেছেন। এছাড়া দেপোর্তিভো লা করোনা, কভেন্ট্রি সিটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ক্লাবগুলির সাথেও খেলেছেন। তিনি আমার মরক্কোর সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়)।
viii) ইউসুফ হাজি (ম্যাচ: ৬৪টি এবং গোল: ১৬টি। তিনি ফরাসি ভিত্তিক ন্যান্সি, বাস্তিয়া, রেঁনে ক্লাবে ৪৬৫টি ম্যাচ খেলে ৭৮টি গোল করেছেন – ন্যান্সির হয়ে সর্বোচ্চ ৩৪৭টি খেলা খেলে ৮৬টি গোল করেছেন। তিনি মোস্তফা হাজির ছোট ভাই)।
- ix) হাকিম জিয়েশ (ম্যাচ: ৪৫টি এবং গোল: ১৮টি। তিনি নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন।বয়স: ২৯ বছর।তিনি বর্তমান জাতীয় দল এবং চেলসি ক্লাবের সাথে খেলছেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৬৫টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছেন এবং ৮৫টি গোল করেছেন হিরেনভীন, টুয়েন্টি এনশেডে, আয়াক্স এবং চেলসির সাথে)।
৪) ফরোয়ার্ড:- x) ইউসুফ এন নেসিরি (ম্যাচ: ৫২টি এবং গোল: ৫টি। বয়স: ২৫ বছর। তিনি বর্তমান জাতীয় দল ও স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ার সাথে খেলছেন। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকার সেভিয়ার হয়ে এখন পর্যন্ত ৮৯টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ২৭টি গোল করেছেন এছাড়াও তিনি লা লিগায় মালাগা এবং লেগানেসের সাথে ৮৭টি ম্যাচ খেলেছেন)।
- xi)ইউসেফ এল-আরাবি(ম্যাচ: ৪৬ টি এবং গোল: ১৬টি। তিনি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। বয়স: ৩৫ বছর। জাতীয় দল থেকে অবসর নেননি কিন্তু এখনও অলিম্পিয়াকোসের সাথে খেলছেন। তিনি এখনও পর্যন্ত ৩১৪টি ম্যাচ খেলেছেন ক্যান, গ্রানাডা এবং অলিম্পিয়াকোসের সাথে এবং, গোল করেছেন ১৩২টি)।
৫) অতিরিক্ত:- ডিফেন্ডার, xii) মেহেদি বেনাতিয়া (ম্যাচ: ৬৬টি এবং গোল: ২টি। তিনিও ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। উদিনিস, রোমা, বায়ার্ম মিউনিখ এবং জুভেন্টাসের সাথে শীর্ষ স্তরে ২৩৯টি ম্যাচ খেলেছেন)।
মিড-ফিল্ডার, xiii) নুরদ্দীন আমরাবাত (ম্যাচ: ৬৪টি এবং গোল: ৭টি। তিনি নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। শীর্ষ স্তরে তিনি ২৯৯টি ম্যাচ খেলেছেন – উল্লেখযোগ্য ক্লাবগুলি হল পিএসভি আইন্দোভেন, গালাতাসারে, মালাগা, ওয়াটফোর্ড ইত্যাদি। তিনি বর্তমান জাতীয় খেলোয়াড় সোফিয়ান আমরাবাতের বড় ভাই)।
ফরোয়ার্ড, xiv) মারোয়ানে চামাখ (ম্যাচ: ৬৫টি এবং গোল: ১৮টি। তিনি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস লীগে ৩৩৫টি ম্যাচ খেলে ৭১টি গোল করেছেন – বোর্দোর সাথে সর্বোচ্চ ২৩০টি ম্যাচ খেলেছেন)।
সারাবাংলা/এসএইচএস