আফগানিস্তানকে উড়িয়ে এশিয়া কাপের সুপার ফোরে বাংলাদেশ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:২৩
শ্রীলংকার বিপক্ষে বাজেভাবে হারার পর বাংলাদেশর সামনে সমীকরণ খুব সহজ ছিল না। এশিয়া কাপের সুপার ফোরের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিততেই হতো এবং সেটিও বড় ব্যবধানে। মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে ৩৩৪ রানের বিশাল স্কোর গড়লে হিসাবটা দাঁড়ায় এমন— আফগানদের ২৭৯ রানের মধ্যে আটকানো গেলে রানরেটের চক্করে পড়লেও সুপার ফোর নিশ্চিত হবে।
কদিন আগেই পাকিস্তানের ঘাম ছুটিয়ে আফগানিস্তানকে এই ফ্ল্যাট পিচে এই লক্ষ্যের মধ্যে বেঁধে রাখা সম্ভব হবে কি না, দুশ্চিন্তা ছিল তা নিয়েও। তবে বোলারদের, বিশেষ করে পেসারদের দুর্দান্ত বোলিং আর সাকিব আল হাসানের বুদ্ধিদ্বীপ্ত অধিনায়কত্বে আফগানদের ২৪৫ রানে আটকে রেখে সব হিসাব মিলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলংকা-আফগানিস্তান ম্যাচের রেজাল্ট যাই হোক না কেন, এশিয়া কাপের পরের রাউন্ড তথা সুপার ফোর নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ।
দিন শেষে আফগানিস্তানকে ৮৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে সাকিব আল হাসানের দল। বাটিংয়ে ‘মেকশিফট ওপেনার’ হিসেবে নেমে দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পর ও বল হাতেও ১ উইকেট নিয়ে অনুমিতভাবেই ম্যাচসেরা হয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ।
যেভাবে নিশ্চিত সুপার ফোর
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৮৯ রানের জয়ের পর বাংলাদেশের রানরেট এখন ০.৩৭৩। শ্রীলংকার বর্তমান রানরেট ০.৯৫১। শ্রীলংকা যদি পরের ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারিয়ে দেয় তবে লংকানরা গ্রুপ সেরা এবং বাংলাদেশ গ্রুপ রানারআপ হিসেবে পরের রাউন্ডে যাবে। আফগানিস্তান কোনো হিসাবের মধ্যেই থাকবে না।
বাংলাদেশের সঙ্গে বড় পরাজয়ে এখন আফগানিস্তান রানরেটে অনেকটাই পিছিয়ে। তাদের বর্তমান রানরেট -১.৭৮০। আফগানিস্তানের সামনে এখন হিসাব হলো— সুপার ফোরে যেতে হলে তাদের শ্রীলংকাকে কমপক্ষে ৬৯ রানে হারাতে হবে। তখন তাদের নেট রানরেট গিয়ে দাঁড়াবে -০.৪২। এই ব্যবধানে হারলে শ্রীলংকার রানরেট কমে হবে -০.৪৩। সেক্ষেত্রে শ্রীলংকার চেয়ে রানরেটে চুল পরিমাণ ব্যবধানে এগিয়ে যাবে আফগানিস্তান। তারাই উঠবে সুপার ফোরে। বাংলাদেশ তখন হবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন।
এর চেয়ে কম যেকোনো রানের ব্যবধানে শ্রীলংকাকে হারালে আর রানরেটে তাদের অতিক্রম করতে পারবে না আফগানরা। তখন গ্রুপে তৃতীয় দল হিসেবেই তাদের টুর্নামেন্ট শেষ করতে হবে। আর শ্রীলংকাকে ১০৮ রানের ব্যবধানে হারাতে পারলে আফগানদের রানরেট দাঁড়াবে ০.৩৮, যা বাংলাদেশের ০.৩৭৩ রানরেটের চেয়ে সামান্য বেশি। তখন আফগানিস্তান হবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, বাংলাদেশ রানারআপ হিসেবে উঠে যাবে সুপার ফোরে।
সব হিসাবের শেষ কথা হলো এই— শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানের পক্ষে একই সঙ্গে রানরেটের ব্যবধানে বাংলাদেশে পেছনে ফেলা সম্ভব না। অর্থাৎ গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশকে তৃতীয় স্থানে ফেলে বাকি দুই দলের পরের রাউন্ডে যাওয়ারও সুযোগ নেই। শ্রীলংকা অথবা আফগানিস্তান যেই উঠুক না কেন দ্বিতীয় রাউন্ডে, বাংলাদেশ এখনই সেখানে গিয়ে বসে আছে। শ্রীলংকা-আফগানিস্তান ম্যাচের ফলাফলের ওপর কেবল নির্ভর করবে গ্রুপের পয়েন্ট টেবিলের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় অবস্থানটুকু।
পেসারদের তোপ, সাকিবের ক্যাপ্টেন্সি
রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ৩৩৪ রানের পুঁজি নিয়ে বোলিং করতে নেমে শুরুতেই আফগানিস্তানকে ধাক্কা দেয় বাংলাদেশ। শরিফুল ইসলামের দুর্দান্ত এক ইনসুইংয়ে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ড্রেসিং রুমে ফেরেন রহমতউল্লাহ গুরবাজ।
এরপর দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ইব্রাহিম জাদরান ও রহমত শাহ ৭৮ রানের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাসকিন আহমেদ রহমত শাহকে (৩৩) বোল্ড করে ব্রেকথ্রু এনে দেন। তখনো আরেক প্রান্তে ইব্রাহিম জাদরান অটল। ৫১ বলে ফিফটি পূর্ণ করা আফগান ওপেনার দলকে টেনে নিচ্ছিলেন দারুণভাবে। শেষ পর্যন্ত হাসান মাহমুদের বলে মুশফিকুর রহিমের অসাধারণ এক ক্যাচে তাকে ফিরতে হয় প্যাভিলিয়নে। তার নামে পাশে তখন ৭৪ বলে ১০টি চার ১টি ছয়ে ৭৫ রান।
এরপর নাজিবুল্লাহ জাদরানকে নিয়ে হাল ধরেছিলেন আফগান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদি। বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছিলেন। তবে নাজিবুল্লাহ মেহেদি হাসান মিরাজের বলে বোল্ড হওয়ার পর শাহিদি নিজেও শরিফুল ইসলামের দারুণ এক সুইং বলে হাঁকাতে গিয়ে সীমানায় ক্যাচ দিয়েছেন। শাহিদি ৬০ বলে ৫১ রান করে ফেরার পর নিয়মিত বিরতিতেই উইকেট হারিয়েছে আফগানিস্তান।
৯ নম্বরে নেমে রশিদ খান ১৫ বলে ২৪ রানের ঝড়ো একটা ইনিংস খেলে বাংলাদেশের সমীকরণ মেলানোর হিসেবটা শঙ্কার মধ্যে ফেলেছিলেন কিছুটা। শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন তাসকিন। দারুণ এক লাফিয়ে উঠা বলে রশিদকে ১০ম উইকেট হিসেবে সাকিব আল হাসানের ক্যাচ বানিয়েছেন তাসকিন। তাতে ৪৪.৩ ওভারে ২৪৫ রানে গুটিয়ে যায় আফগানদের ইনিংস।
বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পাশাপাশি সাকিব আল হাসানের ক্যাপ্টেন্সিও ছিল চোখে পড়ার মতো। পেস ও স্পিন আক্রমণের সমন্বয় ঘটিয়ে বারবার বোলিংয়ে পরিবর্তন এনেছেন। ফ্ল্যাট উইকেটে আফগানদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় জুটি ক্রিজে জমে গেলেও ব্যাটাররা যেন থিতু হওয়ার সুযোগ পান, বারবার বোলার বদল করে সেই চেষ্টা করেছেন সাকিব। উইকেট পড়লেই চেয়েছেন চাপ বাড়াতে।
লাহোরের এই পিচে স্পিনারদের জন্য খুব বেশি কিছু ছিল না। আফগানদের বোলিং ইনিংসেও তার প্রমাণ মিলেছিল। তাদের সেরা দুই স্পিনার রশিদ খান এবং মুজিবুর রহমানও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। বাংলাদেশি স্পিনারদের অবস্থাও ছিল একই রকম। কিন্তু তিন পেসার দিয়ে তো আর ৫০ ওভার বোলিং করানো সম্ভব না। তাই নিজে বল করেছেন, মিরাজকে তো বল করাতেই হতো। চেষ্টা করেছেন আফিফ, শামীমকে দিয়েও। তবে তাকে ভরসা করতে হয়েছে পেসারদের ওপর।
দারুণ বোলিং করতে থাকা শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ ও তাসকিন আহমেদকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার ছোট ছোট স্পেলে আক্রমণে এনে ব্যাটারদের চাপে রাখতে চেয়েছেন সাকিব। পেসাররা তার প্রতিদানও দিয়েছেন। সাকিবের কৌশল দারুণভাবে কাজেও লেগেছে। কোমড় তুলে দাঁড়াতে পারেননি আফগানিস্তানের নিচের দিকের ব্যাটাররা।
বাংলাদেশের পক্ষে তাসকিন আহমেদ ৮.৩ ওভার বোলিং করে ৪৪ রান খরচায় নিয়েছেন চার উইকেট। শরিফুল ৯ ওভারে ৩৬ রানে নিয়েছেন তিন উইকেট। হাসান মাহমুদ ও মেহেদি হাসান মিরাজ নিয়েছেন একটি করে উইকেট। আফগানদের বাকি উইকেটটি পড়েছে রান আউটে।
মিরাজ-শান্তের জোড়া শতকে রানের পাহাড়
এর আগে নাজমুল হোসেন শান্ত ও মেহেদি হাসান মিরাজের দুর্দান্ত দুটি সেঞ্চুরিতে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ৩৩৪ রান তোলে বাংলাদেশ। ৬০ ও ৬৩ রানে প্রথম ও দ্বিতীয় উইকেট হারানো বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় উইকেটে ১৯৪ রানের জুটি গড়েন শান্ত-মিরাজ। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটি এটা।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মাত্র দ্বিতীয়বার ওপেনিং করতে নামা মেহেদি ব্যথা নিয়ে মাঠ ছাড়ার আগে ১১৯ বল খেলে করেছেন ১১২ রান। চার মেরেছেন ৭টি, ছক্কা ৩টি। শান্ত রান আউট হয়েছেন ১০৫ বলে ১০৪ রান করে। শন্ত চার মেরেছেন ৯টি, ছক্কা ২টি।
শেষ দিকে মুশফিকুর রহিম ১৫ বলে ২৫ ও সাকিব আল হাসান ১৮ বলে অপরাজিত ৩২ রানের কার্যকরী দুটি ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে ৩৩০ পার করে দেন।
সারাবাংলা/এসএইচএস