রুদ্ধশ্বাস লড়াই, পাকিস্তানকে হারিয়ে ফের শীর্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা
২৭ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:৫৯
ক্রিকেটীয় উত্তেজনা বিবেচনায় চলমান ওয়ানডে বিশ্বকাপটা যাচ্ছে একেবারেই ম্যারমেরে। এমনকি আপসেট ঘটা ম্যাচগুলোতেও ‘বড় দল’কে উড়িয়ে দিয়েই জিতে গেছে ‘ছোট দলগুলো’। ব্যতিক্রম ছিল কেবল পাকিস্তান-শ্রীলংকা ম্যাচ। সেই পাকিস্তানেরই আরেক ম্যাচে ফিরল উত্তেজনা, এবার প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা।
শেষ দিকে এসে দুই লড়াই যতটা না ক্রিকেটের, তার চেয়ে বেশি পরিণত হলো স্নায়ুর লড়াইয়ে। যেকোনো দলের পক্ষেই যেতে পারত ফলাফল। শেষ পর্যন্ত প্রোটিয়া স্পিনার কেশভ মহারাজের ব্যাট থেকে আসা ‘ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বাউন্ডারিতে শেষ হাসি দক্ষিণ আফ্রিকা। নখ কামড়ানো উত্তেজনায় জয়ী হয়ে ফের টেবিলের শীর্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচ শেষে ধারাভাষ্যকারও বলছিলেন, ‘সম্ভবত এটাই এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ’।
বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকার ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের। টসে জিতে আগে ব্যাটিং করে ২৭০ রান তুলেছিল তারা। জবাবে ব্যাট করতে নামার পর একটা সময় মনে হচ্ছিল সহজেই ম্যাচ জিততে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ পর্যন্ত ৪৭.২ ওভারে গিয়ে জয় আসে তাদের। উইকেটে তখন শেষ জুটি।
২৭০ রান তাড়া করতে নেমে ৩৩ ওভারে ৪ উইকেটে ২০৬ রান তুলে ফেলেন প্রোটিয়া ব্যাটাররা। এইডেন মার্করাম তখন ৭৬ বলে ৭৭ রানে অপরাজিত। ৩২ বলে ২৯ রান তুলে ডেভিড মিলারও তখন সেট হয়ে গেছেন ক্রিজে। ৬ উইকেট হাতে রেখে ১৭ ওভারে তখন প্রয়োজন মাত্র ৬৫ রান। সেই ম্যাচও কিনা হারতে বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
৩৪তম ওভারের প্রথম বলেই শাহিন শাহ আফ্রিদি তুলে নেন মিলারকে, আশার আলো দেখতে পায় পাকিস্তান। তবে মারকো ইয়ানসেন নেমে দ্রুত কিছু চার-ছয় হাঁকালে ফের ফিকে হয়ে আসে সেই আশা। ৩৭তম ওভারে টানা দুটি চার-ছয় খাওয়ার পরের বলেই ইয়ানসেনকে বাবর আজমের হাতে ক্যাচ তুলে দিতে বাধ্য করেন হারিস রউফ। তবু পাকিস্তানি সমর্থকরা ভরসা পাচ্ছিলেন না। কারণ মার্করাম তখনো উইকেটে। আর প্রোটিয়াদের জয়ের জন্য প্রয়োজন তখন মাত্র ৩৬ রান, হাতে ১৩ ওভার!
তবে পাকিস্তানি বোলাররা আশা হারাননি। মোহাম্মদ ওয়াসিম, রউফ আর আফ্রিদি টানা তিন ওভারে চেপে ধরার চেষ্টা করেন। তবু ৪০ ওভার শেষে হিসাবটা হেলে ছিল আফ্রিকার পক্ষেই। তখন ১০ ওভারে তাদের প্রয়োজন ২২ রান, হাতে চার উইকেট। ৪১তম ওভারে গিয়ে পাকিস্তান প্রথম জয়ের আশায় নতুন করে বুক বাঁধতে পারে। মার্করামকে আউট করে দেন উসামা মির। উইকেটে আফ্রিকার স্বীকৃত আর কোনো ব্যাটারও তখন ছিলেন না।
পরের ওভারে জেরালাড কোয়েতজেকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন শাহিন। ম্যাচ তখন পাকিস্তানের হাতের মুঠোয়। উইকেটে স্বীকৃত ব্যাটার না থাকায় রীতিমতো চেপে ধরেন পাকিস্তানি বোলাররা। ১ রানের জন্যও হাঁসফাঁস করতে হচ্ছিল প্রোটিয়া ব্যাটারদের। ৪৬তম ওভারে হারিস অসাধারণভাবে কট অ্যান্ড বোল্ড করে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান লুংগি এনগিদিকে। উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ জুটি, জয়ের জন্য তাদের তখনো প্রয়োজন ১১ রান, যা মনে হচ্ছিল সুদূর পরাহত।
ওই সময় ৬ ওভারে পাকিস্তানি বোলাররা দেন মাত্র ১৪ রান, তুলে নেন ৩ উইকেট। পাকিস্তানের জয় তখন নাগালেই বলা চলে। তবে নাটকীয়তার শেষ তখনো হয়নি। হারিসের করা ৪৬তম ওভারের শেষ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার দশম ব্যাটার শামসির বিপক্ষে এলবিডব্লিউয়ের আপিল করেন হারিস। আম্পায়ার নাকচ করে দিলে পরে রিভিউ নিলে দেখা যায় বল লেগ স্ট্যাম্পে লেগেছে। কিন্তু আম্পায়ার্স কল নট আউট ছিল বলে বেঁচে যান শামসি।
এরপর জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ছিল ৮ রানের। পাকিস্তানি পেসারদের আগ্রসন সয়ে উইকেটে অটল ছিলেন কেশভ মহারাজ ও শামসি। মোহাম্মদ নওয়াজের করা ৪৮তম ওভারের দ্বিতীয় বলটিকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দলের জন্য এক স্মরণীয় জয় এনে দেন কেশভ মহারাজ। ম্যাচ শেষে তিনি অপরাজিত ছিলেন ২১ বলে ৭ রান করে, শামসি ৬ বলে ৪ রান করে।
৬০ রানে পাকিস্তানের চার চারটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেওয়ার কারণে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন শামসি। ম্যাচ শেষে প্রতিক্রিয়ায় তিনিও বলেন, কেশভ মহারাজের ওই বাউন্ডারি হয়তো তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার রান!
এই জয়ে সেমিফাইনালের একদমই কাছাকাছি চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জিতে ১০ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে এখন প্রোটিয়ারা। অন্যদিকে পাকিস্তানের বিদায় অনেকটা নিশ্চিত। ৬ ম্যাচের চারটিতেই হারা পাকিস্তানের পয়েন্ট ৪। টুর্নামেন্টে বাবর আজমের দল আর তিনটি ম্যাচ খেলবে। তিন ম্যাচ জিতলেও সেমির টিকিট পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই পাকিস্তানের।
শেষের দিককার এই উত্তেজনার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুটা খুব ভালো না হলেও লক্ষ্য বিবেচনায় মন্দও ছিল না। চেন্নাইয়ের এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে পাওয়ার প্লেতে দুই ওপেনার কুইন্টন ডি কক (২৪) ও টেম্বা বুভুমাকে (২৮) হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনে নামা ভ্যান ডার ডুসেনও বেশিদূর এগুতে পারেননি। তবে চারে নামা এইডেন মার্করামকে অল্পতে ফেরাতে পারেনি পাকিস্তান।
পঞ্চম উইকেটে ডেভিড মিলারের সঙ্গে মার্করামের ৬৯ রানের জুটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে জয়ের রাস্তায় অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু শাহিন শাহ আফ্রিদি এই জুটি ভাঙতেই পরপর উইকেট হারাতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর তাতে ম্যাচে ফেরে পাকিস্তান। তবে শেষের হিসেবটা মিলাতে পারেনি পাকিস্তান। এইডেন মার্করাম ৯৩ বলে ৭টি চার ৩টি ছয়ে ৯১ রান করে ফিরেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯ রান করেছেন ডেভিড মিলার।
পাকিস্তানের হয়ে শাহিন আফ্রিদি ১০ ওভার বোলিং করে ৪৫ রানে তিন উইকেট নিয়েছেন। দুটি করে উইকেট নিয়েছেন হারিস রউফ, মোহাম্মদ ওয়াসিম ও উসামা মীর।
এর আগে বাবর আজম, সাউদ সাকিলের ফিফটিতে ২৭০ রানের সংগ্রহ গড়ে পাকিস্তান। পুরো ইনিংস অবশ্য ব্যাটিং করতে পারেনি পাকিস্তান, ৪৭তম ওভারেই গুটিয়ে গেছে। টস জিতে ব্যাট করতে শুরুতেই ধাক্কা খায় পাকিস্তান। দলীয় ৩৮ রানের মধ্যে জোড়া উইকেট হারায় তারা। এরপর মোহাম্মদ রিজওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে শুরুর ধাক্কা সামাল দেন অধিনায়ক বাবর আজম।
৪৮ রানের জুটি গড়ে ধাক্কা সামাল দেন এই দুই ব্যাটার। তবে দলীয় ৮৬ রানে ২৭ বলে ৩১ রান করে আউট হন রিজওয়ান। তার বিদায়ের পর ক্রিজে আসা ইফতিখার আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাট করতে থাকেন বাবর। তবে দলীয় ১২৯ রানে ৩১ বলে ২১ রান করে আউট হন ইফতিখার।
সাবলীল ব্যাটিংয়ে অর্ধশতক পূরণ করেন পাক অধিনায়ক। তবে এরপরেই সাজঘরে ফিরে যান। দলীয় ১৪১ রানের মাথায় ৬৫ বলে ৫০ রান করে আউট হন তিনি। এরপর শাদাব খান ও সাউদ শাকিলের ৮৪ রানের জুটির ওপর ভর করেই লড়াই করার পুঁজি পায় পাকিস্তান। দলীয় ২২৫ রানে ৩৬ বলে ৪৩ রান করে আউট হন শাদাব।
শাদাবের বিদায়ের পর পর অর্ধশতক পূরণ সাজঘরে ফিরে যান শাকিলও। ৫২ বলে ৫২ রান করেন তিনি। এরপর ক্রিজে এসেই আউট হন শাহিন আফ্রিদি। এরপর দ্রুতই আরও দুই উইকেট হারিয়ে ২৭০ রানে অলআউট হয় পাকিস্তান। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে তাবরিশ শামসি নেন ৪টি উইকেট।
ওয়ানডে বিশ্বকাপের সবকটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন জিটিভি। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম র্যাবিটহোলবিডি‘তেও দেখা যাবে এবারের বিশ্বকাপ।
সারাবাংলা/এসএইচএস/টিআর
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩ দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল পাকিস্তান ক্রিকেট দল পাকিস্তান বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা