ভারতীয়দের কাঁদিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়
১৯ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৫৪
ভারতীয় ক্রিকেট এই দুঃখ সইবে কীভাবে! তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের সব প্রস্তুতিই ছিল ভারতের। বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে ফাইনালে উঠে এসেছিল রোহিত শর্মার দল। অপ্রতিরোধ্য দল, ক্রিকেটারদের দুর্দান্ত ফর্ম, চেনা কন্ডিশন, নিজেদের মাঠ সবই ছিল ভারতের পক্ষে। কিন্তু ফাইনালে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল ভারত। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ভারতীয় বোলিং-ব্যাটিংয়ের সামনে যেখানে দাঁড়াতে পারল না প্রতিপক্ষ দলগুলো সেখানে শিরোপা নির্ধারনি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের ব্যাটিংও ভালো হলো না, বোলিংও ভালো হলো না।
আগে ব্যাটিং করে ২৪০ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। এই কম সংগ্রহ নিয়ে জিততে হলে শুরুতেই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে হতো। ভারতীয় পেসাররা সেই কাজটা অবশ্য করতে পেরেছিল। শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ার তিন উইকেট তুলে নেয় ভারত। তবে ওপেনার ট্রাভিস হেডকে কিছুতেই থামাতে পারল না রোহিত শর্মার ভারত।
১২০ বলে ১৩৭ রানের অবিস্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছেন হেড। তাকে মার্নাশ লাবুশেন সঙ্গ দিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। ৪৭ রানে তিন উইকেট পরে যাওয়ার পর চতুর্থ উইকেটে ১৯২ রান তুলেছেন দুজন। এই জুটিতেই ভারতের স্বপ্নভঙ্গ। বিশ্বকাপ ফাইনালে ৭ উইকেটের জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপে অষ্টম ফাইনাল খেলতে নেমে আজ ষষ্ঠ শিরোপা জিতল অস্ট্রেলিয়া। অপর দিকে এর আগে দুই বার শিরোপা জেতা ভারত চতুর্থবার ফাইনাল খেলতে নেমেছিল।
রোববার (১৯ নভেম্বর) আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই দ্রুত রান তুলতে চেয়েছে। পরের ওভারগুলোতে উইকেটে স্পিন ধরবে ভেবেই হয়তো অজিদের এমন কৌশল। জাসপ্রিত বুমরাহর করা প্রথম ওভার থেকেই ১৫ রান তুলে সেই কৌশলের যথার্থতার প্রমাণ দিচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে দ্বিতীয় ওভারেই অজিদের টেনে ধরেন মোহাম্মদ শামি।
টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহাম্মদ শামি দারুণ এক সুইং বলে ডেভিড ওয়ার্নারকে স্লিপে ক্যাচ বানান। শুরুতে ওয়ার্নার ফিরলেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বন্ধ করেনি অস্ট্রেলিয়া। ট্রাভিস হেড ও মিচেল মার্শ বেশ ভালোই খেলছিলেন। এরপর জাসপ্রিত বুমরাহর জোড়া আঘাত।
১৫ রান করা মার্শকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানান বুমরাহ। খানিক বাদে বুমরাহর দারুণ এক স্লো বলে পরাস্ত হয়েছেন স্টিভ স্মিথ। ভারতীয় ফিল্ডারদের জোড়ালো আবেদনের মুখে আউট দিয়ে দেন আম্পায়ার। স্মিথ আর রিভিউও নেননি। কিন্তু পরে দেখা যায় ইমপ্যাক্ট ছিল বাইরে, অর্থাৎ রিভিউ নিলে আউট হতেন না স্মিথ! বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ম্যাচে ম্যাচে এমন ভুল নিশ্চয় যন্ত্রণা দিবে স্মিথকে!
৪৭ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে ফেলা অস্ট্রেলিয়ার হয়ে হাল ধরেন ট্রাভিড হেড ও মার্নাস লাবুশেন। এই জুটিটা আর ভাঙতে পারেনি ভারত। অপ্রতিরোধ্যভাবে বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছালেও শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই কারণেই।
লাবুশেন একপ্রান্তে উইকেটে পরে থাকতে চেয়েছেন। অপরপ্রান্তে ট্রাভিস হেড খেলেছেন নিজের মতো করেই। একশর কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে গেছেন অজি ওপেনার, সব ধরনের চেষ্টা করেও হেডকে থামাতে পারেনি ভারত। চতুর্থ উইকেট জুটিতে ২১৫ বলে ১৯২ রান তুলেছেন দুজন। অজিদের বিশ্বকাপ জিততে যখন মাত্র ২ রান প্রয়োজন তখন ১২০ বলে ১৩৭ রানের স্মরণীয় এক ইনিংস খেলে ফিরেন ট্রাফিস হেড। তার ইনিংসে চারের মার ছিল ১৫টি, ছক্কা ৪টি।
৪৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে জয়ের জন্য ২৪১ রান তুলে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। মার্নাস লাবুশনে ১১০ বল খেলে ৪টি চারে ৫৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। ভারতের হয়ে দুটি উইকেট নিয়েছেন জাসপ্রিত বুমরাহ।
এর আগে শুরু থেকেই উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে ভারত। পঞ্চম ওভারে স্টার্কের শর্ট লেংথের বলে এরপর চড়াও হলেন, তবে যেভাবে চেয়েছিলেন খেলতে পারেননি সেভাবে, লেংথও ঠিক সে শট খেলার পক্ষে ছিল না। গিলের পুলে সরাসরি ক্যাচ গেছে মিড অনে থাকা অ্যাডাম জাম্পার হাতে। গিল ফেরেন ৭ বলে ৪ রান করে। এরপর তিনে নামা বিরাট কোহলিকে সঙ্গী করে ঝড়ো গতিতে রান তুলতে থাকেন রোহিত। সপ্তম ওভারেই পূর্ণ করেন দলীয় অর্ধশতক। একের পর এক বল বাউন্ডারিতে আছড়ে ফেলতে শুরু করেন রোহিত শর্মা। তবে পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে বল হাতে এসেই রোহিত ঝড় থামান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
রোহিত শর্মা ৩১ বলে ৪৭ রান করে যখন ফিরলেন তখন ভারতের স্কোরবোর্ডে রান ৭৬। চারে ব্যাট হাতে আসেন শ্রেয়াস আইয়ার। এসেই বাউন্ডারি দিয়ে শুরু। তবে ১১তম ওভারে প্যাট কামিন্স সিম ঘুরিয়ে দেওয়া বলটি ধরে রেখেছিল লাইন। শ্রেয়াস আইয়ার খোঁচা দিয়েছেন তাতে। পরপর ২ ওভারে ২ উইকেট হারিয়েছে ভারত। আইয়ার ফিরলেন ৩ বলে ৪ রান করে। ভারত ৮১ রানে হারাল তৃতীয় উইকেট।
এরপর ভারতীয় ব্যাটিং স্তম্ভ বিরাট কোহলি তখন একাই লড়াই চালিয়ে যান। দলকে বিপদ থেকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে এই জুটি। অজি বোলারদের অনেকটাই দেখে শুনে খেলেছেন দুজনই। যেখানে শুরুর দিকে বাউন্ডারির ফুলঝুড়ি ফুটেছিল, সেখানে বিপদ এড়াতে এই জুটি সিঙ্গেল-ডাবলের উপরেই ভরসা রেখেছেন। ১০ থেকে ২০ ওভারের মাঝে একটিও চার ছয় হাঁকাতে পারেনি ভারত!
কোহলি এবং লোকেশ রাহুল মিলে ইনিংস মেরামতের কাজে মন দেন। অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে জুটির পঞ্চাশ করতে লেগেছে ৮৮ বল। কোনো বাউন্ডারি হয়নি এই জুটিতে। চলতি বিশ্বকাপে নবম পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংসে ৫৬ বলে মাইলফলক স্পর্শ করেছেন কোহলি। তিনি মেরেছেন চারটি বাউন্ডারি। সবগুলোই প্রথম দশ ওভারের ভেতরে। ধীরগতির ব্যাটিংয়ে আরেকটি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন বিরাট কোহলি। ইনিংসের ২৬তম ওভারের প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে তুলে নিলে অর্ধশতক। তাকে দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছেন রাহুল, তিনিও ধীরে সুস্থেই ব্যাটিং করেছেন পুরোটা সময়।
কামিন্সের শর্ট লেংথের বল আলতো করে খেলতে চেয়েছিলেন কোহলি। তবে বল এতটা উঠবে, ভাবতে পারেননি। ব্যাটের কানায় লেগে বল গিয়ে ভেঙেছে স্টাম্প। ফাইনালের মহাগুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। কোহলি থেমেছেন ৬৩ বলে ৫৪ রান করে। রাহুলের সঙ্গে তাঁর জুটি ভেঙেছে ৬৭ রানে।
কোহলি ফেরার পর উইকেটে আসেন জাদেজা। এসে রাহুলের সঙ্গে ধীরেসুস্থে এগোতে থাকেন রানের গতি। এর মধ্যেই ৮৬ বলে ৫০ রাহুলের। রাহুলের ফিফটির পর বেশি সময় টিকতে পারেননি জাদেজা। ৩৬তম ওভারের চতুর্থ বলেই জাদেজার বিপক্ষে কট বিহাইন্ডের রিভিউ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। যদিও তাদেরকেই ঠিক আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি। তবে পরের বলে আর রিভিউ দরকার পড়েনি। হ্যাজলউডের অফ স্টাম্পের বাইরের লাইন ধরে রাখা বলে খোঁচা দিয়ে ফিরে গেছেন জাদেজা। ২২ বল খেলে এ বাঁহাতি করতে পেরেছেন ৯ রান। ভারত ১৭৮ রানে হারায় পঞ্চম উইকেট।
সাতে ব্যাট হাতে আসেন সূর্যকুমার যাদব। তাকে নিয়ে ইনিংস শেষের দিকে এগোতে থাকেন রাহুল। তবে লোকেশ রাহুলের জন্য মিচেল স্টার্কের এ ডেলিভারি যথেষ্টর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে গেল। কোহলির পর রাহুলও থামলেন ৫০ পেরিয়েই। শুরু থেকে সতর্ক খেলছিলেন, ৪০ ওভার পেরিয়ে যাওয়ার পর এসে রাহুল আউট হলেন রক্ষণাত্মক শট খেলতে গিয়েই। ১০৭ বলে মাত্র একটি চারে ৬৬ রান করে রাহুল ফিরলেন দলীয় ২০৩ রানে।
শেষ দিকে সূর্যকুমার যাদব ১৮ রান আর কুলদিপ ১০ আর সিরাজ ৯ রান করলে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ভারত ২৪০ রানে অল আউট হয়। অস্টেলিয়ার হয়ে তিন উইকেট নেন মিচেল স্টার্ক। দুটি করে উইকেট নেন জশ হ্যাজেলউড এবং প্যাট কামিন্স। এছাড়া একটি করে উইকেট নেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং অ্যাডাম জাম্পা।
ওয়ানডে বিশ্বকাপের সবকটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন জিটিভি। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম র্যাবিটহোলবিডি‘তেও দেখা যাবে এবারের বিশ্বকাপ।
সারাবাংলা/এসএইচএস