Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মার্নাস লাবুশেন ও নিয়তির লেখা ‘সিনেমার চিত্রনাট্য’

স্পোর্টস ডেস্ক
২০ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৪

শাহরুখ খানের সিনেমার একটি ডায়লগ হয়ত আপনি শুনেছেন, ‘যদি মন থেকে তুমি কিছু চাও, তাহলে পুরো পৃথিবী তোমাকে সেই জিনিস পাইয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টায় থাকে।‘ নিয়তিতে আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন, ‘মিরাকলকে’ চালিয়ে দিতে পারেন কাকতালীয় ব্যাপার হিসেবে। কিন্তু মার্নাস লাবুশেনের গল্পটা হয়ত আপনাকে নিয়তির উপর বিশ্বাস ফেরাতে বাধ্য করবে। কনকাশন সাব থেকে অস্ট্রেলিয়ার মিশন হেক্সা জয়ের অন্যতম স্বপ্নসারথী, লাবুশেনের ক্যারিয়ার যেন সিনেমার চিত্রনাট্য।

বিজ্ঞাপন

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তার খেলারই কথা না। লাবুশেনের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু নিয়তি তো চেয়েছিল অন্যকিছু। বয়স যখন ১০, হুট করেই বাবার চাকরি হলও অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। সবকিছু ছেড়ে এখানে থিতু হবেন কিনা, সে নিয়েও ছিল নানা দ্বিধা। শেষ পর্যন্ত পরিবার নিয়ে চলে ২০০৪ সালে পাড়ি জমালেন অস্ট্রেলিয়ায়। লাবুশেনের জীবনের অস্ট্রেলিয়া অধ্যায়ের শুরু এখানে। ইংরেজি না জানা লাবুশেনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে খাপ খাইয়ে নিতে।

বিজ্ঞাপন

অল্প সময়েই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের ঠাণ্ডা মাথার ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ সুনাম কামান লাবুশেন। ২৪ বছর বয়সে হয় জাতীয় দলে অভিষেক। পাকিস্তান ও শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজে খুব বেশি কিছু না করতে পারলেও তার ব্যাটিং নজর কাড়ে সবারই। সেই সুবাদেই জায়গা করে নেন ২০১৯ অ্যাশেজের স্কোয়াডে। প্রথম টেস্ট ডাগআউটে বসে দেখতে হয়েছে। দ্বিতীয় টেস্টেও ছিলেন দলের বাইরে। নিয়তির পরিকল্পনা অবশ্য অন্যরকই ছিল। দিনটা ১৮ আগস্ট, ২০১৯। মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন স্মিথ। ইতিহাসের প্রথম কনকাশন বদলি হিসেবে তার জায়গায় ব্যাটিংয়ে নামলেন লাবুশেন। দারুণ এক ইনিংস খেলে মন জয় করে নিলেন সবার। পরের টেস্টেই করলেন নিজের প্রথম সেঞ্চুরি।

সেই শুরু, একের পর এক দুর্দান্ত ইনিংসে তাকে স্মিথের যোগ্য বিকল্প হিসেবেই মেনে নিলেন সবাই। উঠেছেন র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষেও। তবে টেস্টে আলো ছড়ালেও ওয়ানডেতে ঠিক থিতু হতে পারছিলেন না লাবুশেন। ওয়ানডে দলে তাই জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, জায়গাও হারান। সেই প্রভাব পড়ে টেস্টেও। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নটা তখন অনেকটাই শেষ হয়ে গিয়েছিল লাবুশেনের। সেই শঙ্কা সত্যি হলও বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণার পর। ১৫ জনের স্কোয়াডে জায়গা হলো না তার, এমনকি ১৮ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডেও তাকে নেওয়া হয়নি।

সিনেমার চিত্রনাট্যে ‘টুইস্ট’ কিন্তু সবে শুরু! বিশ্বকাপের আগে হতে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে স্কোয়াডে ছিলেন না লাবুশেন। স্মিথের হঠাৎ ইনজুরিতে তাকে পাঠানো হয় সেই সিরিজে। প্রথম ম্যাচ বসে দেখেছেন মাঠের বাইরে থেকে। দ্বিতীয় ম্যাচেও ছিলেন না একাদশে। গল্পটা খুব চেনা লাগছে না?

লাবুশেনের মা সেই ম্যাচে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন ছেলের খেলা দেখবেন বলে। ছেলে একাদশে নেই জানিয়ে দেওয়ার পরেও মায়ের মন তো মানে না! বসে রইলেন যদি কিছু হয়। ২০১৯ সালের অ্যাশেজের মতো আবারও মাথায় আঘাত পেলেন অজি ব্যাটার, এবার সেটা ক্যামেরন গ্রিন। বদলি হিসেবে কাকে নামালো অস্ট্রেলিয়া জানেন? সেই লাবুশেন! যে কনকাশন সাব হিসেবে নেমে ক্রিকেট বিশ্বকে নিজের অবস্থান জানিয়েছিলেন, সেই কনকাশন সাব হিসেবে নেমেই বিশ্বকাপ স্কোয়াডে অলৌকিকভাবে জায়গা করে নেওয়ার শেষ যুদ্ধটা করলেন লাবুশেন। দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিলেন। পরের ম্যাচেও করলেন সেঞ্চুরি। কিন্তু বিশ্বকাপ স্কোয়াড তো ঘোষণা করা শেষ, আর কি হবে এসব করে?

‘যদি মন থেকে তুমি কিছু চাও, তাহলে পুরো পৃথিবী তোমাকে সেই জিনিস পাইয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টায় থাকে।‘ লাবুশেন হয়তো সিনেমায় ডায়লগটি শোনেননি। কিন্তু তার জীবনে ঘটে গেলো ঠিক এটাই। বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে ইনজুরিতে পড়লেন অ্যাস্টন অ্যাগার, তার বদলি হিসেবে ভাগ্য খুলে গেলো লাবুশেনের।

বিশ্বকাপে তো এলেন, কিন্তু টুর্নামেন্টজুড়ে খুব একটা আলো ছড়াতে পারেননি লাবুশেন। স্পিনিং উইকেটে তার উপর একটু বেশি ভরসা ছিল অজিদের। সেই ভরসা তিনি রাখতে পারেননি। একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে অনেকবার। ফাইনালের আগে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, লাবুশেনের জায়গায় খেলবেন স্টোয়নিস। ম্যাচের আগের রাত পর্যন্ত স্কোয়াড ঘোষণা করেনি অজিরা। অনেক অপেক্ষার পর লাবুশেনেই ভরসা রাখেন অধিনায়ক ও কোচ।

২৪১ রান তাড়া করতে নেমে ৪৭ রানে এই ৩ উইকেট। ভারতের বিপক্ষে মহা সংকটে অজিরা। ঠিক সেই মুহূর্তেই নিজের সেই চিরচেনা শান্ত, ঠাণ্ডা মাথার ‘টেস্ট ব্যাটিং’ অবতারে দেখা গেলো লাবুশেনকে। ট্রাভিস হেডকে দারুণভাবে সঙ্গ দিয়ে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। আগের ম্যাচগুলোর মতো কোন তাড়াহুড়ো করেননি, খেলেননি কোন বাজে শট। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাটি কামড়ে থেকে ১১০ বলে ৫৮ রানের ইনিংস খেলে দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন।

খেলা শেষে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে দেখা গেছে লাবুশেনকে। এই কান্না আনন্দের, এই কান্না স্বপ্নপূরণের, এই কান্না কিছুটা অবিশ্বাসেরও বটে। লাবুশেন বলেছেন, এমন মিরাকল তার জীবনে হবে, তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি। সত্যিই তো, কনকাশন সাব হয়ে অস্ট্রেলিয়া একাদশে নিয়মিত হবে, কনকাশন সাব হিসেবে নেমেই বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা করে নেবেন, এটা মিরাকল নয়ত কি?

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ার থিতু হওয়া, অবিশ্বাস্যভাবে অ্যাশেজে অভিষেক, উত্থান পতনের যাত্রা শেষে একরাশ হতাশা, হতাশার মাঝে সেই কনকাশন সাব হয়েই ফিনিক্স পাখির মতো নবজন্ম কিংবা ফাইনালের সেই পাহাড়সম সাহস নিয়ে ব্যাটিং করা; লাবুশেনের জীবনটা তো এমনই, ঠিক সিনেমায় যেমন হয়!

সারাবাংলা/এফএম

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩ মার্নাস লাবুশেন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর