ফ্রান্সের সে জাদু মিললো না, কঠিন পরীক্ষার মুখে আর্জেন্টিনা
১৬ জুন ২০১৮ ২২:৪১
আব্দুল আজীজ, সাবেক ফিফা রেফারি
বিশ্বকাপ শুরুর আগে লিওনেল মেসির একটা সাক্ষাতকারে পরেছিলাম মেসি বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপে ফেভারিট দল হছে ব্রাজিল, স্পেন আর ফ্রান্স। স্পেনের খেলা গতকাল দেখেছি, মনে হয়েছে ভাগ্য সাথে থাকলে চ্যাম্পিয়ান হতেও পারে স্পেন। ফ্রান্সকেও যেহেতু ফেভারিট ধরা হয়েছে তাই ফ্রান্সের খেলা দেখার জন্যও মুখিয়ে ছিলাম। তবে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি ফ্রান্স জিতলেও সম্ভবত দর্শকদের মন ভরাতে পারে নি। অস্ট্রেলিয়ার থেকে যে তারা শক্তিশালী দল এটা বুঝা গেছে, কিন্তু কেন জানি মনে হছিল ক্যারিশম্যাটিক কোন কিছুর অভাব আছে যেটা আমরা জিদানের ফ্রান্সের কাছে পেতাম। পুরো ফ্রান্স দল যদি ঈদের লাচ্ছি সেমাই হয় তাহলে জিদান হচ্ছে লাচ্ছি সেমাইয়ের সেই মচমচা অংশ।
বর্তমানে ফুটবলে টেকনোলজি চলে এসেছে। আমাদের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল অনেক কঠিন, যে কোন ভুল সিদ্ধান্তে দেশের কত রেফারিকে যে আবাহনী আর মোহামেডানের সমর্থকদের কাছে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। আর পেনাল্টি ডিবক্সের লাইন বরাবর ফাউলে পেনাল্টি না ফ্রি কিক- এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল।
সেরকম এক সিদ্ধান্তে ফ্রান্স পেনাল্টি পেল। এবং এর মাধ্যমে আরও একটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল ফ্রান্স। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম গোল দিয়েছিল ফ্রান্স। প্রথম পেনাল্টি ঠেকিয়েছিল ফ্রান্স। এখন প্রথম রিভিউতে পেনাল্টি পাওয়ার দলও হলো ফ্রান্স। টেকনোলজির ব্যবহার আবার খেলার গতিকেও রুদ্ধ করে। ফুটবল একটি গতিশীল খেলা। পেনাল্টিতে গোল করেন গ্রিজম্যান, ফ্রান্সের নামকরা স্ট্রাইকার।
অস্ট্রেলিয়া ১-০ গোলে পিছিয়ে পরে খেলায় ফিরে আসে চার মিনিট পরেই , খেলার সময়কাল তখন ৬২ মিনিট। খুবই আজব এক হ্যান্ডবল দেখলাম। ঠিক বুঝতেই পারলাম না উমতিতির মনে তখন কি ছিল। হাত দিয়ে গোল দেওয়ার কথা শোনা যায় কিন্তু হাত দিয়ে কেউ আত্মঘাতি গোল দিতে চায় এই প্রথম দেখলাম। এরকম পজিশনে হাত উপরেও বা এল কিভাবে! ২০১০ বিশ্বকাপে সম্ভবত সার্বিয়া ঘানার কাছে হেরেছিল এরকম করে পাওয়া পেনাল্টিতেই। যে কারণে জার্মানীকে হারিয়েও ২য় পর্বে যাওয়া হয় নি সেবার সার্বিয়ানদের।
অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করেন জেদিনাক। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের প্লে-অফে যার হ্যাটট্রিকেই হন্ডুরাসকে হারিয়ে বিশ্বকাপ খেলার টিকিট পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেবারও দেখেছিলাম পেনাল্টি বা ফ্রি-কিকে ঠাণ্ডা মাথায় গোল করার দক্ষতা আছে তার। আজকেও মিস করেন নি তিনি।
ফ্রান্সের ৩ নম্বর গোলটি আরেক ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিল। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডে তৃতীয় গোলের বিতর্ক। এখন পর্যন্ত তখনকার জার্মান গোলকিপার সেই গোলটি মেনে নেয় নি। অতিরিক্ত সময়ের সেই গোলেই ইংল্যান্ড এগিয়ে গিয়েছিল। উপরের বারে লেগে লাইন স্পর্শ করাতেই গোল পেয়েছিল ইংল্যান্ড।
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রকৃতি ইংল্যান্ডকে সেটা ফিরিয়ে দিয়েছিল ২০১০ বিশ্বকাপে। জার্মানী ২-১ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ল্যাম্পার্ডের শট ভিতরে ড্রপ খেলেও রেফারী গোল দেননি।
গোল লাইন টেকনোলজির কারণেই আজ তেমন বিতর্ক হয়নি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পগবার শট উপরের বারে লেগে বল লাইন অতিক্রম করে তা টেকনোলজি দিয়েই জানা যায়। ফ্রান্সও ম্যাচ জিতে যায়। এই জয় ৩ পয়েন্ট এনে দিলেও টুর্নামেন্ট জিততে হলে বিশেষ কিছুই করতে হবে ফ্রান্সকে।
আর্জেন্টিনার সমর্থক বাংলাদেশে সব থেকে বেশি। ১৯৮৬ এর ম্যারাডোনা ম্যাজিক দিয়ে শুরু। সেবারই সম্ভবত প্রথম বিশ্বকাপের সবগুলো খেলা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। বাঘা বাঘা দলগুলোকে ফাঁকি দিয়ে কাপ জয় করে এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের মনে জায়গা করে নেন দিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালের পর প্রতি বিশ্বকাপেই ফেভারিট হিসেবে শুরু করলেও বিশ্বকাপ অধরাই থেকে গেছে আর্জেন্টিনার জন্য। সব থেকে কাছে গিয়েছিল দুইবার- ১৯৯০ আর ২০১৪, দুইবারই হারতে হয়েছে জার্মানদের কাছে মাত্র ১ গোলে।
ম্যারাডোনার মত মেসি বিশ্বকাপ এনে দিবে এমন প্রত্যাশাই করে বিশ্বের সকল আর্জেন্টাইন সমর্থক। কিন্তু জাতীয় দলের জন্য ভাগ্য দেবতা মেসিকে কিছু দেন নি। ফাইনালে উঠেও কাপ জেতা হয়ে উঠছে না।
২০১৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার যাত্রা শুরু হলো আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সমর্থকরা জয় আশা করলেও মেসির পেনাল্টি মিসে ড্র হয়ে গেল। তবে আইসল্যান্ড অত দুর্বল দল না, ইউরোতে তারা ইংল্যান্ডকেও হারিয়েছিল। আর খেলার দখল বেশিরভাগ সময় আর্জেন্টিনার কাছেই ছিল, আগুয়েরো গোলটিও সুন্দর দিয়েছে। মেসির পেনাল্টিটা যে খারাপ ছিল তা না, পোস্টেই মেরেছিল, গোলকিপার জাজ করে ফেলায় আর গোল দেওয়া যায় নি।
এক ড্রতে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় নি। এর থেকে বাজে ভাবে শুরু করেও ১৯৯০ সালে ফাইনাল খেলেছিল তারা। নবাগত ক্যামেরুনের কাছে ১ গোলে হেরেছিল সেবার। ২০১০ সালে প্রথম ম্যাচ হেরেও বিশ্বকাপ জিতেছিল স্পেন। কাজেই ঘুরে দাড়ানোর মনোবল থাকলে আর সাথে ভাগ্য থাকলে আর্জেন্টিনারও হতে পারে।
শ্রুতিলিখন- রাসয়াত রহমান জিকো