জয় ও নান্দনিক ফুটবল দুই-ই ব্রাজিলের
২৪ জুন ২০১৮ ২১:২৯ | আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ২১:৫৩
।। মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ।।
বিশ্বকাপ ২০১৮’র আসরে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে জয়ের ধারায় ফিরেছে ব্রাজিল। কোস্টারিকার বিরুদ্ধে সেলেকাওদের ২-০’র দুর্দান্ত জয়টি বলে দিচ্ছে- ফুটবলে জয়টাই যে শেষ কথা সেটা বিশ্বাস করতে তারা ভুলে যায়নি। খেলার পুরো সময়ই আমরা দেখেছি কোস্টারিকাকে চাপেই রেখেছিল ব্রাজিল। আসলে সামনে এগিয়ে যাবো এমন একটি ভঙ্গিমাই তারা দেখিয়েছে। আক্রমণের পর আক্রমণ শানিয়েছে কোস্টারিকার রক্ষণে। ফলও এসেছে- জয়।
যেমন খেলা তেমনই জয়। বলা চলে প্রত্যাশিত জয়। আমরা ঠিক যেমন খেলা ব্রাজিলের কাছে আশা করি সেলেকাওরা সেই খেলাটিই খেলেছে। বল পায়ে এলেই সতীর্থর দিকে ঠেলে দেওয়া, মাঠটিকে বড় করে নিয়ে খেলা যেমন দেখা গেছে… ভিড়ের মধ্যে ছোট ছোট নির্ভুল পাসের খেলাও ছিল ম্যাচের ক্যানভাস জুড়ে। যখন তখন বল ছুটিয়ে গোলবারে আক্রমনও হয়েছে বার বার।
গ্রুপপর্বে এবার প্রতিপক্ষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল সার্বিয়া… ফলে গ্রুপপর্বের বৈতরণী ব্রাজিল পার করে ফেলবে সেটা ভেবে নেওয়া যায়। তবে নকআউট পর্বে ম্যাচ হয়ে উঠবে কঠোর থেকে কঠোরতর। কিন্তু ব্রাজিল এখন যে কোনও দলকে মোকাবেলায় প্রস্তুত। বিশেষ করে যেসব দল একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে ফুটবল খেলে তাদের সাথেই ব্রাজিলের খেলাটা জমবে ভালো। রক্ষণাত্মক ফুটবলে গোল পাওয়াটা কঠিন কিন্তু যারা জিততে চায় তাদের বিপক্ষে খেলতেই মজা পায় যে কোনও যোগ্য টিম। তখন রক্ষণভাগ ও আক্রমণভাগ উভয় পক্ষের দায়িত্বটা সমান থাকে। যে যার দায়িত্ব পালন করে জয় নিশ্চিত করতে পারে। ব্রাজিল ঠিক সেই ফুটবলটি খেলতেই অভ্যস্ত।
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সেলেকাওদের প্রথম ম্যাচটি অসম ফুটবল রোগে ভুগেছে। প্রতিপক্ষ মোটেই জিততে চায়নি… ফলে রক্ষণভাগেই তাদের সব শক্তি নিয়োগ করে। আর তাতে তিতে শিষ্যরা ভিন্ন পথে চেষ্টা করেও আক্রমণ জমিয়ে উঠাতে পারেনি। গোটা শক্তি ডি-বক্সে নিয়োজিত করে সুইসরা তাদের ঠেকিয়ে দেয় ১-১ এ। ম্যাচের পরে সুইজারল্যান্ডের উল্লাস প্রমাণ করে সেটাই তারা চেয়েছিলো। আর জয়ের খিদে নিয়ে মাঠে নামা ব্রাজিল মাঠ ছাড়ে বেজার মুখে। দ্বিতীয় ম্যাচেও কোস্টারিকা একই পথ ধরে। ডি-বক্সভিত্তিক খেলা নিয়ে দেশটি কাটিয়ে দেয় গোটা ৯০ মিনিট। এবার অবশ্য তিতের কৌশলী পরামর্শ খুব কাজে লেগেছে। শর্ট পাসের চেয়ে গ্যাপ তৈরি করে খেলা আর পায়ে বল না টেনে… দ্রুত পাস করে দেওয়ার কৌশলটিতে এতটা রক্ষণাত্মক ফুটবলেও কোস্টারিকার রক্ষণদূর্গ ভেঙেছে বার বার। আর দেরিতে হলেও কাঙ্খিত গোল এসেছে ব্রাজিলের পক্ষে। শান্ত পণ্ডিত (কোয়ায়েট মাস্টার) খ্যাত কুতিনহো আর গোলমেশিন খ্যাত নেইমার দু’জনই গোল পেয়ে গেলেন ম্যাচের যোগ করা অতিরিক্ত সময়ে।
শুক্রবারের ম্যাচে সেলেকাওদের ব্যক্তিগত গুনগুলোও আমরা দেখতে শুরু করেছি। সামনে আরও দেখা যাবে সেটাই প্রত্যাশিত। ফুটবলে আসলে একক কৃতিত্বটি বড় কথা নয়। খেলতে হবে দলগতভাবে। তবে মধ্যমাঠ থেকে সম্মুখভাগে এমন খেলোয়াড়দের রাখতে হয়, যারা একেকজন নিজেই সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তখন বক্সের ভেতরেও দরকার হয় এমন একাধিক খেলোয়াড়। আর সেটা যখন সম্ভব হয়, তখন গোল পাওয়ার সম্ভাবনাটিও বেড়ে যায়। কোস্টারিকার বিরুদ্ধে এই সুযোগটি বার বার তৈরি করতে পেরেছে ব্রাজিল।
আগেই বলেছি রক্ষণাত্মক খেলার বিপক্ষে মাঠে নেমে খুব ভালো কোনও ফল আনা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরেও বলা চলে এই ম্যাচে ব্রাজিল তার পক্ষে যতটা দরকার ছিলো তার পুরোটাই করেছে। জয় পেতে ধৈর্য্য ধরা দরকার ছিলো। ব্রাজিল সেটাও করেছে। এবং শেষের ভাগে হলেও জয় পেয়েছে।
এরপরেও কেউ কেউ বলেন, ব্রাজিল সেই ম্যাচে খুব একটা আনন্দময় ফুটবল উপহার দিতে পারেনি। তবে সেটা ভক্তদের সাধারণ মত। কিন্তু ভক্তের চোখ দিয়ে না দেখে বাইরের কেউ হিসেবে দেখলে বলা যাবে ব্রাজিল একটি নান্দনিক ও কৌশলী ফুটবলই খেলেছে। আর ব্রাজিলকে সেটাই করে যেতে হবে। কারণ ফুটবলের এই ধরণটাই ব্রাজিলের ট্রেডমার্ক। সারা বিশ্ব সেলেকাওদের এমন নান্দনিক ফুটবলেরই ভক্ত। যখন যে ম্যাচেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে… সমালোচকরা তো বটেই ভক্তরাও ব্রাজিলকে ছেড়ে কথা বলেনি। সে কারণেই এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে প্রথম ম্যাচে নয়… দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম খুঁজে পাওয়া গেছে বলেই মত অনেকের।
বিশ্বকাপের গত ২০ আসরে ব্রাজিল ট্রফি জিতেছে মাত্র পাঁচ বার (যদিও সর্বোচ্চ)। কিন্তু গোটা বিশ্বে ব্রাজিলের যে সুনাম… তা কিন্তু ওই ট্রফি জয়ের কারণে নয়… সমালোচকের মুখেও তাদের নান্দনিক ফুটবলের প্রশংসা শোনা যায়। খেলায় ফল একটা ব্যাপার বটে। জয়-পরাজয় গোলেই নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ব্রাজিল যে নান্দনিক ফুটবল খেলে… সে সুনামটিও কম কথা নয়। ট্রফি হাতে নিলেই ব্রাজিল সেরা… এমন কথা কেউ বলেন না। তাদের খেলাটাই দর্শক-ভক্তের চোখে লেগে থাকে।
এবারের স্কোয়াডে নেইমার-থিয়াগো সিলভা-মার্সেলো-কুতিনহোরা তো রয়েছেনই, তিতের অন্য শিষ্য যেমন জেসুস, উইলিয়ান, ফিরমিনো, পলিনহোরাও যে কোনও মূহূর্তে ম্যাচের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম। কেবল যারা মাঠে নামছেন তাদের কথা নয়… সাইডলাইনে যারা বেঞ্চে বসে থাকছেন… তারাও কিন্তু একেকজন নির্ভরযোগ্য তিতে-শিষ্য। গত ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমে ফাগনার, ডগলাস কস্তা ও ফিরমিনোকে সে প্রমাণ দিতেই দেখেছি। যদিও ম্যাচ শেষে কস্তার ইনজুরি শঙ্কা জাগাচ্ছে। তবে, একেই বলে দলীয় শক্তি… স্কোয়াড পাওয়ার। একে কেউ ছোট করে দেখলে ঠিক হবে না। ব্রাজিলের এমন সব উচ্চমানের ফুটবলার রয়েছে যারা যে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই তৈরি।
নেইমারের কথাতো বলাই হলো না। প্রথম থেকে দ্বিতীয় ম্যাচে নেইমারের অপেক্ষাকৃত ভালো ফুটবল বিশ্ব দেখেছে। ২৬ বছরের ছেলেটির ওপর ধকলতো কম যায় না। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক ম্যাচে রেকর্ড ফাউল তার বিরুদ্ধে করা হয়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচে পেনাল্টি বক্সে ফাউল কলটি ভিডিও রেফারিংয়ে বাদ গেছে… সেটা ঠিক, কিন্তু নেইমারতো একজনই। আর বিশ্বকাপের পরের দিনগুলোতে সেই নেইমারকেই সবাই দেখতে পাবেন। তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সকল চ্যালেঞ্জকে উৎড়ে নেইমার বিশ্বকাপে জ্বলে উঠবেন। আর সেটাই যদি হয়… বিশ্বকাপের ট্রফিতে সেলেকাওদের চুমু এবার সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সারাবাংলা/এমএম