মৃত্যু উপত্যকায় ফুটবল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবন
৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫৫ | আপডেট: ৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৩৮
২৩ জানুয়ারি, ২০২৪। কাতারের রাজধানী দোহার আবদুল্লাহ বিন খলিফা স্টেডিয়ামে তখন গমগম করছে ফিলিস্তিনি সমর্থকদের উল্লাসে। রেফারির লম্বা বাঁশি। টাচলাইনের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফিলিস্তিনি ডিফেন্ডার মোহাম্মেদ সালেহ। খানিক পর সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন কৃতজ্ঞতায়। চাপা কান্নার দমকে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা তোলার শক্তিটাও ছিল না ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে স্বজন হারানো এই ফুটবলার।
সেদিন হংকংকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এএফসি এশিয়ান কাপের রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উঠেছিল ফিলিস্তিন। ৩-০ ব্যবধানে পাওয়া সেই জয় ছিল এশিয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে তাদের প্রথম। মৃত্যুকূপ হয়ে ওঠা দেশটার সমর্থক-ফুটবলারদের অশ্রু আর উল্লাসই সাক্ষী দিয়েছিল এই ঐতিহাসিক অর্জনের।

কান্নায় ভেঙে পড়েন ফিলিস্তিনি ডিফেন্ডার মোহামেদ সালেহ
অথচ সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে নেই বেচে থাকার কোনো নিশ্চয়তা। দেশটির নাগরিকরা জানেন না, আরও একটা সকাল তারা দেখতে পাবেন কিনা। ইসরায়েলি সেনাদের ট্যাংক ঘিরে রাখে এলাকা, ক্ষণে ক্ষণে যেখানে উড়ে এসে পড়ে প্রাণঘাতী মর্টার শেল। আবারও মৃত্যুতাড়িত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিন। গাজায় ফের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, মরক্কো, তুরস্ক-সহ আরও অনেক দেশ ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। এই দেশগুলোতে আজ (সোমবার) পালন হচ্ছে ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচি। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। এমনকি ডাক এসেছে বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠানেও কাজ বর্জনের। সবাই একত্রিত হয়েছেন গাজায় গণহত্যা বন্ধের প্রতিবাদে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসয়ায়েলে হামাসের আক্রমণের পর থেকে শুরু এই সংঘাতের। প্রতিশোধ নিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল। সেই মানবিক সংকট এখন চরমে। ক্ষণে ক্ষণে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। গত বছরের শুরুতে সেই হামলার প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে ফিলিস্তিনি ফুটবলাররা বেছে নিয়েছিলেন এশিয়ান কাপের মঞ্চকে। কারণ ‘দ্য বিউটিফুল গেম খ্যাত’ ফুটবলই হয়ে উঠেছে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদের ভাষা, বেচে থাকার আকুতি।
ফিলিস্তিনের ফুটবল যাত্রা
ফিরতে হবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। ১৯১৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল ফিলিস্তিন। সেই শাসনামলেই ১৯২৮ সালে ‘প্যালেস্টেনিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে ফিলিস্তিন। কিন্তু সেখানে ইহুদিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াতে অ্যাসোসিয়েশন থেকে বেরিয়ে আসে ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীরা।গঠন করে ‘আরব প্যালেস্টেনিয়ান স্পোর্টস ফেডারেশন’।ওদিকে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের অনারব ও ইহুদিদের সেই সংগঠন ফিফার সদস্যপদও পেয়ে যায়। নাম বদলে হয়ে যায় ইসরায়েল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
কিন্তু ফিলিস্তিনের আরবরা তখনো নিজেদের ফুটবল দলের স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৯৮ সালে ফিফার স্বীকৃতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য অন্য আরব দলগুলোর বিপক্ষে নিয়মিতই ম্যাচ খেলেছে। এমনকি আরব কাপেও অংশ নিয়েছে।
ফিফার স্বীকৃতিতে বাকবদল
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৯৮ সালে ফুটবল নেশন হিসেবে ফিফার স্বীকৃতি পায় ফিলিস্তিন। ফিফার সদস্যপদ পাওয়ার পরই আসে দেশের ফুটবলে চমকপ্রদ বদল। তাদের নিজস্ব ফুটবল দল তো ছিলই। এর দুই বছর পর ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে নিজেদের পেশাদার লিগ ‘ওয়েস্ট ব্যাংক প্রিমিয়ার লিগ’।

১৯৯৮ সালে ফিফার স্বীকৃতি পায় ফিলিস্তিন
এরপর ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে ফিলিস্তিনের ফুটবল কাঠামো। খেলতে শুরু করে ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও। কিন্তু ফুটবলের সবকিছুই আবর্তিত হত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে।
ফুটবলেও ইসরায়েলি আগ্রাসন
পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে ফিলিস্তিন। পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান, যাবতীয় সুবিধাদি গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের চেয়ে ভালো। চারপাশেই ইসরায়েলের বানানো দেয়াল, একপাশে মিশর। যে পথ দিয়ে গাজাবাসীদের বাইরের দুনিয়ায় বেরোতে চাইলে অনুমতিও নিতে হয় ইসরায়েল থেকে।
ফিলিস্তিনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কঠিন, নেই চলাফেরার স্বাধীনতা। গাজা থেকে কোথাও যেতে চাইলে পেরোতে হয় সামরিক চেকপোস্ট। তাই পশ্চিম তীরের ফুটবল লিগে খেলতে যেতে পারতেন না অনেকেই। গাজার যেসব ফুটবলার খেলতেন ওয়েস্ট ব্যাংক প্রিমিয়ার লিগে, তারাও উপত্যকা ছাড়তেন নানান ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পর।
২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ ফিলিস্তিন খেলতে পারেনি গাজা থেকে বের হতে না পারায়। ১৮ সদস্যের স্কোয়াডকে অনুমতি দেয়নি ইসরায়েল। ফিলিস্তিন ম্যাচ খেলতে যেতে না পারায় ৩-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয় সিঙ্গাপুরকে। পরবর্তীতে ফিফাকে অনুরোধ করেও সেই ম্যাচ আবার মাঠে গড়াতে পারেনি তারা।
প্রাণ হারিয়েছেন ফুটবলাররাও
পদে পদে ইসরায়েলের বাধার মুখে পড়া ফিলিস্তিনের ফুটবলাররাও প্রাণও হারিয়েছেন তাদের হামলায়। ২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ইসরায়লের এয়ারস্ট্রাইকে মারা যান আয়মান আলকুর্দ, ওয়াজেহ মোশতাহি নামের দুই ফুটবলার। গত বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়া হামাস-ইসরায়েলের এই সংঘাতে পরিবারের সদস্য-বন্ধুদের হারিয়েছেন ফিলিস্তিনের বর্তমান ফুটবল দলের অনেক সদস্য।
এশিয়ান কাপের গত আসরে হংকংয়ের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ম্যাচের আগে ২১ জানুয়ারি ডিফেন্ডার সালেহ জানতে পারেন তার তিন চাচাতো ভাই মারা গেছেন। হামলা হয়েছে তার চাচার বাসায়। যে ইয়ারমুক স্টেডিয়ামে সালেহ-সহ গাজা উপত্যকার বাকি ফুটবলাররা খেলতেন, সেই স্টেডিয়ামটাও গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। পরিবারকে মৃত্যু উপত্যকায় রেখে এই ক্ষতগুলো বুকে নিয়ে সালেহ খেলেছেন এশিয়ান কাপে।
ফরোয়ার্ড মাহমুদ ওয়াদি, এশিয়ান কাপে ইরানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে নামার আধা ঘন্টা আগে জানতে পারেন, তার কাজিনরা মারা গেছেন ইসরায়লের শেলিংয়ে। সেই শোক নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ওয়াদি। জেদ চাপিয়ে রেখে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য তারা কিছু করতে চান।
ফুটবলকে কতটা ভালোবাসেন ফিলিস্তিনিরা?
২০০৮ সালে গাজায় এয়ার স্ট্রাইক করেছিল ইসরায়েল। সেই হামলায় গুরুতর আহত হওয়া গাজার ক্লাব শাবাব রাফার ফুটবলার হাজেম আল রেখাইকে মৃত ভেবে মর্গের ফ্রিজারে রেখে দেন চিকিৎসকরা। ঘটনার ৫ ঘণ্টা পর তার মা মর্গে গিয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। চোখের কোণা দিয়ে দেখতে পান কারো একটা হাত নড়ছে আলতো করে। বেচে ছিলেন হাজেম! অথচ সবাই তাকে মৃতই ভেবেছিল! শরীরজুড়ে শ্রাপনেল, স্প্লিন্টার নিয়ে হাজেম আবার ফুটবলে ফিরবেন কেউই ভাবেনি। তবে সুস্থ হয়ে ২০১১ সালে ওয়েস্ট ব্যাংক প্রিমিয়ার লিগে যোগ দেন। খেলেছেন ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ক্লাবেও।
পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি, নেই মন ভালো করার মতো কিছু, অবরুদ্ধ গাজার মানুষেরা হয়তো মৃত্যুর প্রহর গুনে দিন কাটান। তাই ফিলিস্তিনিদের এই জেদ, দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর সংকল্প, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়া, সবকিছু এসে জমা হয়েছে ফুটবলে। কারণ এই ফুটবলই জীবনের কথা বলে। ফুটবলটাই হয়ে উঠেছে নিজভূমে পরবাসী ফিলিস্তিনিদের বেচে থাকার অবলম্বন। মোহাম্মেদ সালেহ-মাহমুদ ওয়াদিরা ফুটবলের সবুজ মাঠকেই বানিয়েছেন যুদ্ধের ময়দান। ‘দ্য বিউটিফুল গেম’ খ্যাত ফুটবলটা তারা হৃদয় দিয়েই খেলেন।
সারাবাংলা/জেটি
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সহিংসতা এশিয়ান কাপ গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিন ফুটবল দল