শিশু-কিশোরের ইন্টারনেট আসক্তি,পরিনতি ও করনীয়
১১ জুলাই ২০২৪ ১৭:০৬
বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কার আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন সহজ করে দিয়েছে। হাতের নাগালেই যেন পৃথিবী! হাত বাড়ালেই নিমিষেই বিশ্বের সংবাদ থেকে শুরু করে কত কিছু জানা যায়। আধুনিক বিশ্বায়নে বিজ্ঞানের এক আপডেট আবিষ্কার হল ইন্টারনেট সেবা। ইন্টারনেট সেবা বিশ্বময় এক জাদুর নাম। এই ইন্টারনেট সেবা ছাড়া আধুনিক বিশ্বের কোন কিছুই চিন্তা করা যায় না। ডিজিটাল যুগে প্রায় সবকিছুই চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে। এতকিছু ভাল’র মধ্যে আছে নানান প্রকার বিপত্তি। যে ইন্টারনেট সেবা গোটা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সেই ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়বৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণা বলছে,একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিণ স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোন এসএমএস আসলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে। বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সাথে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজী নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এসব ভিডিও গেম খেলার ফলে শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়;এমনকি চোখের দৃষ্টি শক্তির হ্রাস সহ মানসিক ভাবে অনেকে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে।
ইন্টারনেট গেমে সাধারণত বন্দুক,পিস্তল সহ গোলাবারুদ ব্যবহার করে একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যার ফলে যখন তারা গেমে পরাজিত হয় তখন তাদের মন এবং মেজাজ খিটখিটে হয় ও একে অপরের সাথে রাগারাগি,ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। শিশু-কিশোররা আগামীর কর্ণধার। তাদের মানসিক বিকাশে এই ইন্টারনেটের অপব্যবহার দিন দিন যেন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। মাদকাসক্তের চেয়েও বেশি আসক্ত হচ্ছে ইন্টারনেটে হোয়াট্স আপ,ফেইসবুক, ভাইবার, ইমো,ম্যাসেঞ্জার, গুগল,ইউটিউবে। গত দুই বছরে করোনার প্যান্ডামিক অবস্থায় করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে বন্ধ রাখতে হয়েছে সরকারকে। একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে অনলাইন ক্লাসের নামে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত সকলের হাতেই রয়েছে স্মার্টফোন-ল্যাপটপসহ পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের এই সুবিধার অপব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে অনলাইন ভিডিও গেমিংয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডব্লিউএইচও) প্রথম বারের মত ভিডিও গেমে আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাভুক্ত করেছে। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মানসিক রোগ নির্ণয়–বিষয়ক গাইডলাইনে (ডিএসএম-৫-) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণার ভিত্তিতে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিল। করোনাকালে দিনের বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের নাম করে এই গেমিংয়ের পেছনে ব্যয় করছে,বেড়েছে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার। বর্তমানে জনপ্রিয় কিছু গেমের নাম পাবজি, কল অফ ডিউটি, ফ্রি ফায়ার, প্রো ইভুলেশন সকার (পেইস) ব্যবহার করে আসক্ত অনেক শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা যদি এইভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটের সময় পার করে তাহলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে জাতি এক মেধা শূন্যতায় ভুগছে। অনলাইন দুনিয়ার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক গবেষণা বলছে শিশু এবং কিশোররা প্রায় ১৯ শতাংশ ভিডিও গেম এবং ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত রয়েছে। এসব সন্তানদের গড়ে তুলতে পিতা-মাতাকে দিতে হবে। সন্তানদের কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে অবিভাবকদের। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ করতে বাবা-মা কে মূলত দুটি জিনিস নজরদারিতে রাখতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে যে,শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোন ধরণের বিপদে পড়ছে কি না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তারা কোন আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে কিনা। এ বিষয়ে ফাইবার অ্যাট হোম-এর প্রধান প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “সাইবার অ্যাবিউজ এখন খুব কমন ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এটা একটা হুমকির জায়গা। আরেকটি হচ্ছে অ্যাডিকশন। বাচ্চারা তখন ইন্টারনেট ছাড়া থাকতেই পারে না বা থাকতেই চায় না এমন আচরণ করে। তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌলিক কিছু জিনিসে পরিবর্তন এনে একটু সচেতন হলেই শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজরদারি করা যায়। এর মধ্যে অন্যতম হল- প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা। শিশুদের যদি কোন ডিভাইস দেয়া হয় তাহলে সেটিতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করাটাই নিরাপদ বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
শিশু-কিশোরা অনুকরণশীল। তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করা অবিভাবকের দায়িত্ব। ইন্টারনেটে তাদের যুক্ত করতে হলে শিক্ষামূলক সাইডগুলো ব্যবহারের মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। শহরে অনেক ইন্টারনেটে গেইম খেলার দোকান আছে সেখানে গিয়ে ঘন্টা চুক্তিতে মানসিকতা বিকৃতের মত নানান গেইম খেলছে শিশু-কিশোররা। ইন্টারনেটের নানাবিধ অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছে সন্তানরা। অনিচ্ছা স্বত্বেও অল্প বয়সীরা জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধ,কিশোর গ্যাং অপরাধ সহ নানাবিধ অপরাধে। প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিৎ সন্তানদের এই আধুনিক যুগে আধুনিকতার অপসংস্কৃতির ভয়াল গ্রাস থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় সজাগ দৃষ্টি রাখা। সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে মেধা বিকাশে সহায়তা করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই