Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০২)


২৬ জুন ২০২০ ১৪:২৮

বাসায় খবরের কাগজ রাখা বন্ধ হয়েছে। হকার ছেলেটি, পরে শুনেছে তারা, আপাতত পত্রিকা দিতে হবে না শুনে বিচলিত বোধ করেছিল। আরো অনেক বাসায়ই নিশ্চয় এমন ঘটেছে। কাজের মেয়েটিরও বেতনসহ ছুটি। মেয়েটি অবশ্য এরমধ্যে বার দু’তিন নুসরাতকে ফোন করেছে- খালাম্মা, কাজ থাকলে বলবেন, আইসা কইরা দিয়া যাব।

কাজ তো থাকেই, তারা মানুষ দুজন, কিন্তু গুনে দেখলে আর করতে গেলে বোঝা যায়- কাজের পরিমান কম নয়। রমিজ হোসেন তাই নুসরাতের সাথে কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ভাগটা অবশ্য নুসরাই করে দিয়েছেন- প্লেট-পিরিচ-চামচ এসব ধোঁয়া, আর ঝাঁড়ন বা কাপড় দিয়ে এদিক-ওদিক ধুলা সরানো। নুসরাতের পরিশ্রম কিছু কম হবে- এই ভেবে রমিজের কাজ করতে ভালোই লাগে। তবে তার অভিজ্ঞতা কম, শরীরের ব্যালান্সও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। রাতের খাবার পর সিন্কের নীচে কাজ করতে গিয়ে একটি ভেঙেছেন, ভেঙে, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলেছেন- এই লিকুইড সোপগুলো এতই পিছলা…।
তোমার মতো..। কাজ শেষ?
শেষ। আমাকে কী কাজই বা দাও তুমি!
এই করছ, আমার কত ভাগ্য। যাও, ঘরে গিয়ে বসো, আমি আসছি।

রমিজ হোসেনের দীর্ঘদিনের অভ্যাস দিনে দুবার খবরের কাগজ পড়া। সকালে হকার দিয়ে যাওয়ার পর চা খেতে খেতে একবার পড়েন, রাতে খাওয়ার পর পানমসলা চিবাতে চিবাতে পড়েন আরেকবার। এখন খবরের কাগজও নেই, পানমশলাও। পানমশলা শেষ হয়ে গেছে, সেদিন ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গিয়েছিল নুসরাত, তাকে বলা ছিল, নুসরাতের নিজেরও পছন্দ, কিন্তু তার মনে ছিল না- এমন ভিড়, মানুষের এমন চেহারা আর কেনাকাটা, আমার মনে হলো বের হতে পারলে বাঁচি। কী কিনলাম কী কিনলাম না…।

টিভি অবশ্য খোলা আছে। টিভি খোলাই থাকে। সকালে উঠে ছাড়া হয়, বন্ধ হয় রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। কিন্তু টিভিতেই বা সবসময় দেখার কী আছে। দেশি চ্যানেলগুলোয় খবর সব এক। লকডাউন মানছে না, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর সামনে বিপদ, গার্মেন্টস মালিকদের খেলা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব, প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা- সারাদিন আর রাত ধরে। এর চেয়ে মাঝে মাঝে এনিম্যাল প্লানেট দেখা ভালো। রমিজ ওটা দেখেও মাঝে মাঝে। তার এক বন্ধ, ছোটবেলার, মাহবুব, আমেরিকায় থাকে, তো রমিজ এনিম্যাল প্লানেট দেখে শুনে অবাক গলায় বলেছিল- ঐ, হাতি আধাঘন্টা ধইরা নদী পার হয়, এইটার মধ্যে দেখার কী আছে?

সেকথা মনে হলে রমিজ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে এনিম্যাল প্লানেট দেখা শুরু করল।

এনিম্যাল প্লানেটে বিভিন্ন প্রানীর মেটিং এর ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছিল। রমিজ একবার ভাবল, এ বয়সে আর এসময় এসব দেখার দরকার নেই, এ ধরনের ডকুমেন্টারি সে দেখেছেও আগে, তবে, এমনও মুনে হলো- লকডাউন না মানার আর কোন দেশে কতজন মারা গেল, সে খবরের চেয়ে এই আন্তরিকতা ও ক্রোধ দেখা ভালো। রমিজ হোসেন তাই এনিম্যাল প্লানেটই দেখতে লাগলেন, তখনই আমেরিকা থেকে মাহবুবের… ফোন এলো। দোস্ত বাঁইচা আছ?

নুসরাত যখন ঘরে এসে ঢুকল, তখন এনিম্যাল প্লানেটে বাঁদরের মেটিং দেখাচ্ছে।
রমিজের কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল। বাঁদর বলে কথা। তবে ইষৎ নুসরাত ঘরে ঢোকায় সে বিব্রত বোধ করল ও তাড়াতাড়ি চ্যানেল বদলাতে গেল। সেটা সে পারল না, কদিন হলো রিমোট ঠিকমতো কাজ করছে না, ব্যাটারি কমজোরি হয়ে গেছে, নুসরাত দেখে ফেলল, রমিজ হোসেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল- বাঁন্দরের বাঁধরামী দেখছ?
তোমার বুড়ো বয়সেও এইসব দেখার ইচ্ছা, তুমি দেখো।
আরে না। চ্যানেল বদলাচ্ছিলাম, মাহবুবের ফোন আসল, এইদিকে আর খেয়াল করিনি।
এখন বদলাও। নিউজ চ্যানেলে দাও। … মাহবুবের ভাইয়ের কী অবস্থা?
বলল, আক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বলল, ছোটবেলার বন্ধু তো, বলল- একবার শেষ দেখা হলে ভালো হতো। কিন্তু সে ভরসা কম। আমিরিকার যে অবস্থা…।
এখন কি ছেলের সঙ্গে?
রমিজ দুপাশে মাথা নাড়লেন- নাহ, ছেলে অনেক দূরে, ফোনেও কথাবার্তা হয় না। মাহবুব একাই।… আমাদের মতোই ঘরের মধ্যে পড়ে আছে।
একদিন ভিডিও কল করো। অন্তত চেহারা দেখতে পারবে।
রমিজ হোসেন সামান্য মাধা ঝাঁকাল, একটু অন্যমনষ্ক গলায় বলল, আমাদের না হয় কেউ নেই, না ছেলে না মেয়ে। কিন্তু মাহবুবের ছেলে আছে, একই ছেলে, অথচ যোগাযোগ নেই।
এমন অনেক আছে, রমিজ, ছেলে না মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
আছে হয়তো। রমিজ মাথা ঝাঁকাল। আছে। দেখি তো।
আমাদের আকাশ বেঁচে থাকলে কী হতো, আমরা জানি না, যোগাযোগ থাকত কি থাকত না…।
রমিজ হোসেন অবাক চোখে নুসরাতের দিকে তাকালে নুসরাত বলল- কী হলো?
তুমি কখনো আকাশের কথা তুলতে চাও না।
আমরা কেইবা আর তুলি? কম দিন হলো?
অনেকদিন।
বেঁচে থাকলে আকাশের বয়স এখন কত হতো, বলতে পারবে?
বিয়াল্লিশ, না?
নুসরাত হোসেনকে অবাক দেখাল- তোমার মনে আছে?
থাকে না সবসময়। নুসরাত, এটা হলো সত্যি কথা যে সবসময় থাকে না। … আসলে অধিকাংশ সময়ই থাকে না। তবে এখন মনে পড়ছে, ইদানীং, এই যখন বুঝতে পারছি আমাদের চারপাশে কেউ নেই।
আকাশ থাকলে থাকত? নাকি মাহবুব ভাইয়ের ছেলের মতো হতো?
থাকত থাকত। আমাদের ছেলে, তুমিও জানো, থাকত।
আমি আসলে জানি না, রমিজ। ওর মাত্র তিন মাস বয়স, যখন চলে গেল।
রমিজ হোসেনের মুখে সামান্য বোকা-বোকা হাসি দেখা গেল- আসলে আমিও জানি না, আসলে বলা মুশকিল। তবে এভাবে কখনো ভাবিনি তো, এখন ভাবলে মনে হয়, সবচেয়ে কাছের মানুষ কি এসময় দূরে থাকত!
নুসরাত সামান্য হাসলেন- ওর বউ যে কেমন হতো!
ভালো হতো। মাঝেমাঝেই আমাকে এসে জিজ্ঞেস করত- বাবা, চা বানিয়ে দেব??
ওর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যেত, না?
হ্যাঁ…। বাড়িটা হয়তো গমগম করত।
হয়তো একছেলে একমেয়ে হতো ওর, দুজন কী যে দুষ্টুমি করত…!
রমিজ হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন- নুসরাত, এই প্রসঙ্গ আমরা বাদ দিই, হ্যাঁ?
কেন?
তুমি বারবার চোখ মুছছ, আমারও ঠেলে কান্না আসছে। আমাদের তিন মাস বয়সী সন্তান তিন মাসেই থেমে আছে। কী হবে ওর কথা ভেবে!
কিছু না। কিছু হবে না। তুমি সেদিন কথা তুললে আমি তোমার উপর রাগই হয়েছিলাম। কিন্তু তারপর দেখলাম- ভাবলে ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কেউ আছে।
কেউ নেই নুসরাস। রমিজ হোসেন দুপাশে মাথা নাড়লেন। কেউ নেই আমাদের। আছে?
আমি দেখি না।
তোমার এক বোন আছে, কিন্তু তার সাথে তোমার কোনোই যোগাযোগ নেই…।
ওর কথা বলো না।
আর আমার কেউই নেই। না বাবার দিকের না মার দিকে।
আমরা দুজন।
আমরা দুজন।… নুসরাত, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
আমাদের কিছু হবে না, দেখো। আর যদি হয় ও, আমার হবে।
সেটা কি খুব কাজের কথা হবে?
অকাজের কথাও হবে না। তোমার হওয়ার দরকার নেই।
তোমার হওয়ারও দরকার নেই।
আমার হোক। তোমার না হোক। মেয়েরা কীভাবে কীভাবে যেন একা বেঁচে থাকতে পারে। পুরুষরা বড় অসহায়।
রমিজ হোসেন হাসতে আরম্ভ করলেন- একা যে বেঁচে থাকবে, কীভাবে থাকবে?
তাও দুচারজন চেনা মানুষ আছে এদিক ওদিক। তোমার? তাছাড়া বেঁচে থাকতে হলে কত কী যে করতে হয়!
তোমাকে চিনি আমি। আমি না থাকলে তুমি এক সপ্তাহও পার করতে পারবে না।
নুসরাত রমিজ হোসেনের দিকে তাকালেন- পারবে?
রমিজ হোসেন সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি বললেন- অসুখটা খুব খারাপ। খুব খারাপ। শুধু যে অসুখটা খারাপ, না নয়, ধরনটাও খারাপ।
ধরনটা বেশি খারাপ।
ধরো আমাদের একজনের হলো, আরেকজন তার দেখাশোনা করতে পারব না।
এটা একটা বিশ্রি ব্যাপার। ধরো আমার হলো, তুমি আসতে পারবে না আমার কাছে।
তবে রমিজ, আল্লাহ না করেন, তোমার যদি হয়ও, আমি কিন্তু দেখাশোনা করব।
রমিজ হোসেনের মুখে আবার হাসি দেখা দিল- সহমরন? …শোনো, আমার বিশ হাতের মধ্যে আসবে না তুমি।
আমি একা একা বেঁচে থেকে কী করব?
তুমিই না বললে মেয়েরা একা একা বেঁচে থাকতে পারে।
তা পারে, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে না। … একটা ব্যাপার…এই যে লকডাউন শুরু হলো, আমরা বুঝতে শুরু করলাম- আমাদের কেউ নেই, আমাদের কোথাও কেউ নেই।
হুম, ঠিক। এটা আমিও খেয়াল করেছি। কোনো বন্ধ, কোনো আত্মীয়… অদ্ভুত না?

চলবে…

 

আরও পড়ুন,

করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০১)

করোনাকাল করোনাকালের গল্প করোনাকালের রোজনামচা মঈনুল আহসান সাবের


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর