Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন বই, স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন


২২ আগস্ট ২০২০ ২০:৫৫

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট দৈনিক ইত্তেহাদে যে বিবৃতি দেন তাতে বিদ্যমান রাষ্ট্রের উপর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে সে সময়েই উঠে আসে সাধারণের মুক্তির দিকটি। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা যে আজাদী লাভ করেছি, সেটা যে গণ আজাদী নয় তা গত এক বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় মন্ত্রীসভা দীর্ঘ এক বছরে জনগণের দুইশ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখদুর্দশা মোচনের চেষ্টা তো করেনই নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আটি চাপিয়েছেন। ভূখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত, ও শত অভাবের ভারে নুব্জ্য জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের কোনো ব্যাবস্থা তারা করেননি, বরঞ্চ পাট, তামাক শুপারি ইত্যাদির উপর নতুন ট্যাক্স বসিয়ে ও বিক্রয় কর বৃদ্ধি করে জনগণের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন।… বস্তুত গণজীবনে আজাদীর পরিবেশ সৃষ্টি না করে আজাদী উৎসব করতে যাওয়া এবং বন্যাক্লিষ্ট, দুর্ভিক্ষ- পীড়িত মরণোন্মমুখ জনগণকে সেই উৎসবে শরিক হতে বলা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ বঙ্গবন্ধু বিবৃতিতে ১৫ আগস্টকে জনগণ বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজকে ‘সংকল্প দিবস’ হিসেবে পালনের আহব্বান জানান।’
[পৃষ্ঠা ৬-৭]

বিজ্ঞাপন

উপমহাদেশ ভেঙে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও দুটি বিকৃত ডানার অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরির মাত্র এক বছর পর পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার তরুণতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পুরোপুরি পাকিস্তানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেবল কঠিন বিবৃতিই দিলেন না, ছাত্র ও যুব সমাজকে ‘সংকল্প দিবস’ পালনের আহব্বান জানান। প্রশ্ন, কিসের সংকল্প দিবস পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মাথায়? পাকিস্তান ভেঙ্গে নতুন একটি দেশ প্রতিষ্ঠার সংকল্প? মাত্র তেইশ বছরের মাথায় শেখ মুজিব সেই সংকল্প বাস্তবায়ণ করে দেখালেন, বাঙালি বীরের জাতি। কারণ, আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, স্বাধীন করতে তেইশ বছরে একটু একটু করে লড়াই সংগ্রাম আর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সামগ্রিক একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন শেখ মুজিব।

বিজ্ঞাপন

তেইশ বছরে তিনি পূর্ব বাংলার কোন জেলায়, মহকুমায়, থানায় গিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রয়োজনের সময়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন, তিল তিল তিলোত্তমায় এবং স্বাধীনতার রক্তমশাল পাকিয়েছেন, ইতিহাসের সেই সব অকাট্য প্রমাণ কোথায়? অকাট্য প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে সেই সময়ের পত্রিকার পাতায় পাতায়, অনেকটা ছিন্ন পত্রের আঙ্গিকে। ইতিহাসের তরুণ গবেষক, অধ্যাপক মুর্শিদা বিনতে রহমান প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার অনুপ্রেরণায়, পত্রিকার পাতার ভাঁজ খুলে খুলে নিভৃতে যতনে চয়ন করেছেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে মুজিবীয় তথ্য সূত্র, নিপুণ সৌকর্যে। এবং সংগ্রহ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বই আকারেও প্রকাশ করেছেন। মুর্শিদা বিনতে রহমানের অনন্য, অসামান্য বইটি স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেরিক্ষত ১৯৭০ এর নির্বাচন।

স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইটি প্রকাশ করেছে জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চলছে জন্ম শতবার্ষিকীর রাষ্ট্রীয় নানা আয়োজন। সেই আয়োজনে বাংলা একাডেমিও সামিল হয়েছে। যথাপোযুক্ত পান্ডুলিপি পেলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শত বই প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়েছে। সেই পরিকল্পনার আওতায় মুর্শিদা বিনতে রহমানের স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছে গত শতকে। আমরা অতিক্রম করছি একবিংশ শতক। জায়নবাদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে। সময়ের পরিভ্রমনে ইতিহাসের বিপুল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন একটি প্রজন্মও আত্মপ্রকাশ করেছে। যেই প্রজন্ম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা বা ইতিহাস থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছে। ত্রিশ লাখ বাঙালির প্রাণ বির্সজন ও পাঁচ লাখ নারীর ব্যক্তিগত শারীরিক যুদ্ধ প্রায় গল্পে পরিণত করতে পেরেছে একদল বিকৃতকামী বাঙালি। স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো গল্প নয়, স্বাধীনতার যুদ্ধ হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা একটি জাতির স্বপ্ন পূরণের রক্তমাখা অঙ্গিকার বাস্তবায়নের পরম ইতিহাস।
অনেক ঘাট মাঠ পার হয়ে সেই ইতিহাস মুখোমুখি হয় গত শতকের তিনটি সালের দিন তারিখের অভিধানে। একটি সাল ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, দ্বিতীয়টি ১৯৭০ সালের নির্বাচন আর তৃতীয় ও শেষ সাল অনিবার্যভাবে ১৯৭১। যত সময় যায়, ইতিহাসের উপর মরচে পড়ে। আবার যদি দেশে থাকে স্বাধীনতার সব সুখ ও অধিকার ভোগ দখল করার পরও একদল পৌন:পুনিক নিমকহারাম, যারা স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসের উপর নিজস্ব মনোভঙ্গির নিকৃষ্ট ধারণা বুনে দিতে চায়, সেই সব আত্মপ্রতারকদল, সেই দেশে স্বাধীনতার যথাযথ তথ্য, উপাত্ত পাওয়া কঠিন তো বটেই, না পাওয়াটাও দোষের নয়। এই প্রকারের বিভ্রান্তি ও প্রতারণার কালে ভিন্ন আঙ্গিকেরও মানুষ থাকেন, যারা প্রকৃত গবেষণায় খুঁজে আনেন অতলের আদি ও অন্ত। স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইটির প্রবক্তা মুর্শিদা বিনতে রহমান সেই আদি অন্তের কষ্ট কঠোর গবেষক। তিনি গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের পত্রিকা ঘেটে গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর তীরের সবুজে মাখা গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া মুকুটবিহীন এক রাখাল রাজার বৈঠা হারা দেশের জনগণমনঅধিনায়ক হওয়ার সেই সময়ের মানচিত্র উপস্থাপন করেছেন, পরম মমতায়, প্রগাঢ় আত্মঅনুসন্ধিৎসায়।

স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইয়ের ভূমিকায় মুর্শিদা বিনতে রহমান লিখেছেন-
‘ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কাজ হয়েছে। এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য নিয়েও বেশ কয়েকটি সংকল গ্রন্থ আছে। কিন্তু কোনো একটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো রচিত হয়নি। নির্দিষ্টভাবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর ভাষ্যে সেগুলো আলোচিত হয়নি। যাও হয়েছে, বিশ্লেষণে ঘাটতি রয়েছে। ফলে, বঙ্গবন্ধুর চিন্তার গভীরতা কর্মপরিধি সর্ম্পকে সাধারণের মাঝেও তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছেন কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যারা কিছুটা রাজনীতি সচেতন, তারা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রাখলেও বর্তমান প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানে না। না জানার কারণ যেমন একটি রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি তেমনি একটি প্রধান কারণ তাঁর কর্ম ও চিন্তা নিয়ে গবেষণামূলক কাজের অভাব। এ প্রেক্ষপটে আমি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। ঐ সমযকার ভাষ্য থেকে জানা যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা আন্দোলনকে কিভাবে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং এ পক্ষে গণভোট আদায় করেছেন, বাংলার মানুষের দ্বারপ্রান্তে তিনি এমন কী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, যার দ্বারা উদ্ধুদ্ধ হয়ে পুরো জাতি অবর্তমানেও অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এবং ছিনিয়ে এনেছেন কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনি ভাষ্যসমূহ পুনপাঠ করে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনাসমূহ উপস্থাপনা করেছি।

প্রত্যেক যাত্রার একটি নিদির্ষ্ট লক্ষ্য থাকে। অধ্যাপক মুর্শিদা বিনতে রহমানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, তিনি সরাসরি উপস্থাপন করেছেন বইয়ের নাতীদীর্ঘ ভূমিকার এই চুম্বক অংশে। বইটি আগাগোড়া পাঠ করার পর, বাংলায় নিবেদিত যে কোনো বাঙালি হতবিহ্বল হযে যাবেন। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে, মহাকালের তুলনায় পঞ্চাশ বছর কিছুই নয়, সেই পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনসাধাণের কাছে একজন শেখ মুজিব কেমন করে তখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত একটি জাতির অপ্রতিদ্বন্ধি নেতা, বঙ্গবন্ধুতে পরিনত হলেন, কেমন করে সত্তুরের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানী জায়নবাদী সামরিক সরকারের গোয়েন্দাদের সকল তথ্য উল্টেপাল্টে দিয়ে পূর্ব বাংলায় তো বটেই দুই পাকিস্তানের নির্বাচিত একক অদ্বিতীয় নেতায় রূপান্তরিত হলেন, নির্বাচনের জনসভাগুলোতে জনগণের সামনে তিনি কি অসম সাহসী আর তুখোড় বক্তব্য রেখেছিলেন, পত্রিকার ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে থাকা সেইসব সোনায় মোড়ানো ভাষ্য মুর্শিদা বিনতে রহমান তুলে ধরেছেন বইটিতে। বইয়ের ভাষ্যগুলো পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস মনস্ক পাঠকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে থাকা ইতিহাসের ঝকঝকে অবাক মানচিত্র। সেই সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকুল অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুনিপুণ রাজনৈতিক কর্মকৌশলের ভাষ্য পাঠ করে নতুন নতুন ধারণায়, প্রজ্ঞায় বাংলার অপ্রতিদ্বন্দী নেতার প্রতি আনত হতে বাধ্য হবেন। চেতানার মশাল জ্বালিয়ে বলবেন, শেখ মুজিব বাঙালির চিরকালের সর্বাধিনায়ক!

বইয়ের এক জায়গায় মুর্শিদা বিনতে রহমান যে ভাষ্য হাজির করেছেন- ‘৩০ মার্চ মুন্সিগনজের আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, যখনই পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য কোনো দাবি করা হতো, তখনই বলা হতো বিছিন্নতাবাদী। আমরা বিচ্ছিন্নবাদে বিশ্বাস করি না। আমরা দেশের জনসমষ্টির শতকরা মোট ৫৬ ভাগ। তদুপরি আমরাই সংগ্রাম করে পাকিস্তান অর্জন করেছি। আমরা বিচ্ছিন্ন হবো কেনো? পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট না করে ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন আদায় করবোই। এতে আমার বিশ্বাস আছে। আগামী নির্বাচন একটি সাধারণ নির্বাচন নয়। এটা স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে গণভোট হবে। জনগণ স্বায়ত্বশাসন চায় কি না, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তার সিদ্ধান্ত হবে।
[পুষ্ঠা: ১০৯]

৯ এপ্রিল বাগেরহাটে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়- শোষণ ও অবিচারের শৃঙ্খল হতে দেশের বারো কোটি মানুষের, বিশেষ করে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্যই আমার সংগ্রাম। শুধু প্রধানমন্ত্রীত্ব কেনো, সারা দুনিয়ার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা আমার পায়ের কাছে ঢালিয়া দিলেও আমি দেশের বিশেষ করিয়া বাংলার বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না।’

জনসমাবেশে তিনি বলেন, তিনি আল্লাহ ছাড়া কোনোদিন কারও কাছে মাথা নত করেননি এবং সকল বাধাবিঘ্নের মুখেও তিনি গণ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সমকালীন সময়ে খান আবদুল কাইউম খান তাঁকে ছয দফা ত্যাগ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হওয়ার আহব্বান জানালে উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আইয়ুব খান আমাকে প্রধানমন্ত্রীত্বসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ আমাকে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সবই আমি প্রত্যাখান করেছি। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রীত্বের মোহই যদি আমাকে জনগণের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন্ করিতে পারিত, তবে আমাকে বছরের পর বছর জেলজুলুম সহ্য করতে হতো না…। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। জনগণের ভালোবাসাই আমার সব চাইতে বড় পাওনা।’
[পৃষ্ঠা : ১১০]

মুর্শিদা বিনতে রহমান বইয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছেন সেই সময়ের পত্রিকার পাতা থেকে। এবং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দিনের পর দিন পুরোনো সেই ময়লা জড়ানো পত্রিকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বঙ্গবন্ধুর আকর ভাষ্য খুঁজতে হয়েছে। পরিশ্রম, সময়, মেধা আর ব্যক্তিগত আগ্রহের অনন্য সন্মিলনে মুর্শিদা বিনতে রহমান সত্যিকার অর্থেই অনন্য কাজ করেছেন। দায় পালন করেছেন। নইলে, বিস্মৃতপ্রবণ জাতির কপালে যা থাকে, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের হীরকখন্ডগুলো কোন একদিন কালের স্রোতে হারিয়ে যেত অথবা ঘুমিয়ে থাকতো ইতিহাসের সংবেদী উপাদানগুলো পত্রিকার পাতায় পাতায়।

সত্তুরের নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভার মধ্যে দিয়ে। সেই জনসভায় তিনি অনেক গুরুত্বর্পূন তথ্যসমৃদ্ধ ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের এক জায়গায় তিনি যা বলেছিলেন, আজও প্রাসঙ্গিক, এবং ইসলামের লেবাসধারীদের জন্য চিরকালের জন্য প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু অনেক কথার মধ্যে জামায়েতের সমালোচনা করে বলেছেন- ‘১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তোমরা ‘যুক্তফ্রন্টে’ ভোট দিলে ‘বিবি তালাক’ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছিলে। যুক্তফ্রন্ট জিতেছে। কিন্তু কাহারও বিবি তালাক হয়নি। ১৯৫৬ সালে ধুয়া তুলেছিলে ‘যুক্ত নির্বাচন’ সমর্থন করলে ‘ইসলাম’ বরবাদ হইযা যাইবে। যুক্ত নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কই ইসলামতো বরবাদ হয়নি। মেয়েলোক রাষ্ট্রপ্রধান হইলে ‘গয়ের ইসলামী কাজ হবে’ এককালে এই ফতোয়াও তোমরা দিয়েছো। আবার ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মিল্লাতকে সমর্থন করছো, কই ‘গয়ের ইসলাম’ কাজের জন্য তওবা তো করো নাই। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তোমরা বলেছিলে ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে ইসলাম খাতরা মে চলে জায়েগা’। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হইযাছে। কই ইসলামতো খাতরা মে নাহি গিয়া! এবার বলছো, ছয় দফা হলে পাকিস্তান ধ্বংস হইবে। আমি তোমাদের সাফ জানিয়ে দিতে চাই, ছয় দফাও হবে, পাকিস্তানও থাকবে। তোমাদের বে-ইনসাফী ফতোয়া ফতোয়াই থাকবে।’
[পৃষ্টা- ১১২]

বঙ্গবন্ধুর উপরের ভাষ্য কিন্তু আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, ধর্মের লেবাসধারীরা বার বার ধর্মের অপব্যখা দিয়ে সরল জনতাকে বিভ্রান্ত করেছে, করছে। এবং কি অকাট্য খুরধার যুক্তির কুঠারাঘাতে তিনি ওদের ফতোয়ার অসারত্ব প্রমান করেছেন। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীদের বোধোদয় হযনি, হওয়ার কেনো সুযোগ নেই। দেখুন বঙ্গবন্ধুর আর একটি ঐতিহাসিক যুক্তি। যা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের সাফ জানিয়ে দিতে চাই, ছয় দফাও হবে, পাকিস্তানও থাকবে’। বঙ্গবন্ধুর মুখের উচ্চরিত বাণীর সত্যতা ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর, অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা যেমন হয়েছে, পাকিস্তান নামক খন্ডিত পাকিস্তানও থেকেছে।

সত্তুরের নির্বাচনের সময়ে বঙ্গবন্ধু এই বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরেছেন, বাংলার জনগণও এক ও অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে পরম ভালোবাসায় তাকে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের যে যে এলাকায় তিনি নির্বাচনি সফরে গেছেন, সেই সফরের, জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা তুলে ধরেছেন মুর্শিদা বিনতে রহমান স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭১ এর নির্বাচন বইয়ের পাতায় পাতায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল পূর্ব বাংলায় নির্বাচনি জনসভা করেন নি, তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও বেশ কয়েকটি জনসভায় নির্বাচনী ভাষণ দিয়েছিলেন। একজন সফল গবেষকের প্রথম দায়, ইতিহাসের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুপুঙ্খু তথ্য খুঁজে বের করা এবং পাঠকদের সামনে সারবত্তা তুলে ধরা। তরুণ গবেষক মুর্শিদা সেই অনুপুঙ্খু গবেষণা করেছেন ধ্যানের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে, সম্পূর্ণ দায়বোধের সঙ্গে। ফলে, প্রায় তিনশো পৃষ্ঠার গোটা বইটি হয়ে উঠেছে সত্তুরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী জনসভার একমাত্র আকরগ্রন্থ। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব জায়গায় নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন, মুর্শিদা বিনতে রহমান অনুসন্ধিৎসু গবেষণার প্রেরণায় বইয়ে সেই তথ্যও উপস্থাপন করেছেন। আমাদের অধিকাংশ বাঙালির ধারণা, বঙ্গবন্ধু কেবল পূর্ব বাংলাই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। না, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানেও নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়েছেন। কারণ, তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল। স্বাভাবিকভাবে দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে পশ্চিম পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

‘বত্রিশের ঠিকানায় বীরাঙ্গনারা’

১৯৭০ সালের ২৮ শে জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীর নিস্তার পার্কের বিশাল জনসভায় নির্বাচনী ভাষন দিয়েছিলেন। বেলুচিন্থানের কোয়েটার মিউনিসিপ্যাল পার্কে নির্বাচনী জনসভা করেন ১ জুলাই। লাহোরে বক্তৃতা করেন ৫ জুলাই। কোয়েটা থেকে ট্রেন যোগে লাহোরে যাবার পথের বিবরণ দিয়েছেন মুর্শিদা বিনতে রহমান । তিনি লিখেছেন- ‘কোয়েটা হতে ট্রেনযোগে তিনি লাহোরে পৌঁছুলে স্টেশনে সংবর্ধনা জানানো হয়। এই সময়ে জাতীয় পতাকা ও আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্য কর্মী শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা জানান। কোয়েটা হতে লাহোরের পথে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামলে কর্মীরা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু শিকারপুরে পৌঁছুলে জিয়ে সিন্ধ, জিয়ে বাংলা, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ শ্লোগানে তাঁকে সংবর্ধিত করা হয়।
[পৃষ্ঠা: ২৩৩, ২৩৪]

বাঙালি শেখ মুজিবের রাজনীতির প্রভাব কেবল বাংলায় নয়, বাংলা পার হয়ে প্রায় পনেরোশ কিলোমিটার দূরের তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসভার ছবিও ছাপা হয়েছে। ফলে, বইটি ইতিহাসের অমোঘ উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে বাঙালির চেতনার যাদুঘরে থেকে যাবে চিরকাল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির কাছে কতোটা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, মুর্শিদার একটি তথ্যে আবিষ্কার করা যায়। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান নির্বাচনী জনসভা শেষ করে ঢাকায় ফেরেন ৬ জুলাই, ১৯৭০ সালে। বিমানবন্দরের পরিস্থিতি কেমন ছিল সেদিন? বর্ননা রেখেছেন মুর্শিদা বিনতে রহমান। তিনি জানান- ‘বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছায় তখন ঘোষণা আসে যে, টারমাক ছাড়িয়া আপনারা যদি সরিয়া না যান তাহা হইলে শেখ সাহেবকে বহনকারী বিমানখানিকে বাধ্য হইয়া কলিকাতা অভিমুখে ফিরাইয়া দিতে হইবে।’

বিমানবন্দরের কতৃপক্ষ উপর্যুপুরি এরূপ ঘোষণা দেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে সংবধৃনা জনাতে এই সময়ে অসংখ্য মানুষের কারণে বিামনবন্দরের আন্তর্জাতিক ও ডোমেস্টিক উইং ছেপে সমগ্র টারমাক এলাকা সয়লাব হয়ে যায়। এই জনগনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নারীও ছিলেন। বিনা আমন্ত্রণে ও প্রচারেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করতে আসেন।
[পৃষ্ঠা -২৩৪, ২৩৫]

মুর্শিদা বিনতে রহমান খুব পরিকল্পিত চৈতন্যে স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইটি সাজিয়েছেন। সূচীর দিতে চোখ রাখলেই অনুভব করা যায়, তিনি কতোটা নিপুণ নৈপুণ্যে বাঙালির উষাকালের ইতিহাসকে ধারণ করেছেন, মন্থন করেছেন এবং লিখেছেন। মোট পাঁচটি অধ্যায়ে স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইটি সাজিয়েছেন। অধ্যায় পরিচিতি: অধ্যায় এক, বঙ্গবন্ধুর মানসজগতে স্বাধীন বাংলাদেশ। অধ্যায় দুই, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা। অধ্যায় তিন, ১৯৭০ এ নির্বাচনী ভাষ্য। অধ্যায় চার, কাউন্সিলের বক্তব্য বিবৃতি ও আবেদন। অধ্যায় পাঁচ, নেতা ও জনতা। বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি যুক্ত করেছেন অনেক অজানা তথ্য। সবচেয়ে অবাক ঘটনা, বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী জনসভা বঙ্গবন্ধু করেছেন, সেইসব এলাকার মানচিত্র যুক্ত করেছেন মুর্শিদা বিনতে রহমান। সেই মানচিত্রের দিকে তাকালে লহমায় বুঝে নেওয়া যাবে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কোন জেলায়, কোন মহকুমায়, কোন থানায় জনসভা করেছিলেন। বইটিতে দুর্লভ আটাশটি ছবি দিয়েছে অনন্য মাত্রা।

খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে মুর্শিদা বিনতে রহমানের স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন বইয়ের বয়ান। বইটির মোট পৃষ্ঠা ২৮৬। ২৮৬ পৃষ্ঠার বইয়ের বিশাল ক্যানভাস থেকে এই বয়ানে কতটুকু ব্যবচ্ছেদ করা সম্ভব? পাঠকদের জন্য একটা ধারণার স্কেচ আঁকবার চেষ্টা করেছি মাত্র। নিশ্চিত করে লিখতে পারি, বইটিতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সর্ম্পকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের যাবতীয় ঐতিহাসিক ও খুঁটিনাটি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই।

লেখক- গল্পকার

৩৭০ ৭০ এর নির্বাচন টপ নিউজ নতুন বই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মনি হায়দার মুর্শিদা বিনতে রহমান স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু: পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০ এর নির্বাচন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দু’দিনে ভারতে ৯৯ টন ইলিশ রফতানি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৪

সম্পর্কিত খবর