Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নূরজাহান


২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২০:১৮

তখন বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি। মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদক। তার গ্রীনরোডের বাড়িতেই অফিস। সমকালীন পরিচিত অনেক মিডিয়া কর্মী এখানে যোগ দিয়েছেন। ১৯৯২ সালের ঘটনা। রাতের বেলা নিউজ ডেস্কে একটা নিউজ এসেছে।
ফতোয়ার কারনে মারা গেছে একটি মেয়ে। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ছাতকছড়ায়। ফতোয়াবাজরা মেয়েটিকে গর্তে দাঁড় করিয়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। নূরজাহান নাম। এর বেশি তথ্য নেই। আমাকে দ্রুত স্পটে চলে যেতে বলা হয়। এমন কাজ আমার ভালও লাগে।
তখন ট্রেন-বাসের সংখ্যা বেশি নয়। বেশি রাতে কোথাও যেতে সংবাদপত্রের গাড়িই ভরসা। মধ্যরাতের পর ঢাকার দৈনিকবাংলা মোড়, বাংলারবানী, ইত্তেফাক-ইনকিলাব অফিসের সামনে থেকে মফঃস্বলগামী পত্রিকার গাড়িগুলো ছেড়ে যেত। পত্রিকার গাড়ি কার আগে কে যাবে প্রতিযোগিতায় এগুলো দ্রুত চলত।
এমন অনেক স্পট রিপোর্টিংএ রাতের এসব পত্রিকার গাড়িতেই গিয়েছি। পত্রিকার গাঁটের মাঝে কোনঠাসা অবস্থায় বসতে হয়। বিপদে পড়ে অথবা অল্পভাড়ায় যেতে শ্রমজীবী মানুষেরাই মূলত এসব গাড়ির যাত্রী। সে রাতে তেমন এক গাড়িতে চড়ে ভোরের দিকে শ্রীমঙ্গলে গিয়ে নামি। সেখান থেকে প্রথম বাসে ভানুগাছ স্টেশনে।
স্টেশন লাগোয়া একটি টং চা দোকান খুলছে সবে। দোকানিকে বলি ভাই ছাতকছড়া যাব। কোনও দিকে যাব। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলে নূরজাহানের বাড়ি? ধারনা করি ঘটনা তার জানা। অথবা ঘটনার কথা শুনেছেন। ঢাকার সাংবাদিক শুনে লোকটা বেশ খাতির করেন। দোকানের ঝাঁপ আবার ফেলে দিয়ে আমাকে নিয়ে রওয়ানা হন গ্রামের উদ্দেশে।
সে গ্রামেই তার বাড়ি। আগের সময়কার মানুষগুলো এমন আন্তরিক সহযোগী ছিল। নতুবা নিজের দোকান না খুলে সকালের ব্যবসা ফেলে কেউ আগন্তুক একজনকে এভাবে হাঁটা দেন ? পথে যেতে যেতে জেনে নেই প্রাথমিক কিছু তথ্য। মেয়েটির এটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়ের কয়েকদিন পর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়। দ্বিতীয় বিয়ের পর হয় ফতোয়া।
এই বিয়ে শরীয়তে জায়েজ হয় নাই। শরীয়তবিরোধী কাজের বিচার না হলে আল্লাহর গজব নামবে। অতএব গর্ত করে পাথর ছুঁড়ে মারতে হবে। আমাকে নূরজাহানের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে যান দোকানি। আগন্তুকের সামনে নূরজাহানের বাবা। আশ্রব উল্লাহ। পরিচয় জেনে হাউমাউ করে কাঁদেন বাবা। আশ্রব উল্লাহ- মা সায়েরা বেগম।
আমরা ঘরর মানুষ খাইতাম ফারিনা। এর লাগি মনো করছলাম ফুড়িগুর বিয়া অই গেলে ঘরো খানির এগু মানু কমবো। নূরজাহানের প্রথম স্বামী ছিল এলাকায় আসা পরিযায়ী শ্রমিক। বালা মনো করছি বিয়া দিছি। কিন্তু জামাইর বাড়িঘর মা-বাবার পরিচয় তারা জানতেন না। জামাই যখন নিরুদ্দেশ হল তখন খোঁজ বের করে তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সেখানে গিয়ে পাননি।
এর মাঝে গ্রামের যুবক মতলিব নূরজাহানকে বিয়ে করতে চায়। শুভদিন দেখে বিয়েও দেন। তারা ভেবেছেন মেয়েটির ভাতের কষ্ট গেল। স্বামী অন্তত তাকে ভাত খাওয়াতে পারবে। কিন্তু বাধ সাধেন এলাকার মাওলানা মান্নান আর ইউপি মেম্বার মনির সর্দার, দ্বীন মোহাম্মদ, নিয়ামত উল্লাহসহ কয়েকজন। তারা বলেন বিয়ে শরীয়ত মতে জায়েজ হয় নাই।
কারন তালাক হয়নি আগের বিয়ের। তালাক আনতে আবার নূরজাহানের প্রথম স্বামীর বাড়ি যান বাবা আশ্রব উল্লাহ। আবার গিয়েও তাকে পাননি। মাওলানা মান্নান বলেন, তালাক আনতে পারনি মানে বিয়ে বৈধ হয়নি। এ নিয়ে সালিশ হবে। সালিশে নূরজাহান ও তার দ্বিতীয় স্বামী মতলিব মিয়াকে গর্তে দাঁড় করিয়ে পাথর ছুঁড়ে মারার সিদ্ধান্ত হয়। মতলিব মিয়ার বাড়ির উঠোনে খোঁড়া হয় দুটি গর্ত। নূরজাহানের দ্বিতীয় শ্বশুর মতি উল্লাহকেও রাখা হয় সালিশি বিচারের আসামী!
পাথর ছুঁড়ে মারার বিষয়টি ছিল প্রতিকী। কাঁকর ছুঁড়ে মারা হয়। নূরজাহানের মা-বাবাকে বেত্রাঘাত ও তাদের কান ধরে উঠবস করা হয়। বেত্রাঘাত করা হয় দ্বিতীয় স্বামী মতলিবের পিঠেও। নূরজাহানের শ্বশুর মতিউল্যা শাস্তি কমানোর আবেদন করলে তার গর্তের গভীরতা কমিয়ে কোমর পর্যন্ত করা হয়।
১০১ ঘা বেত্রাঘাতের রায় কমিয়ে ৫১ ঘা করা হয়। চোখের সামনে মা-বাবার এই অপমান সহ্য হয়নি নূরজাহানের। সেখান থেকে দৌড়ে ছুটে গিয়ে তিনি যান পিত্রালয়ে। সেখানে গিয়েই তিনি বিষপান করেন। এন্ড্রিন। গ্রামের অনেক বাড়িতে তখন কৃষিকাজের প্রয়োজনে এন্ড্রিন থাকত।
কীটনাশক হিসাবে তা ব্যবহার করা হতো এন্ড্রিন। সেটা পান করে জীবন দিত অনেক ভাগ্যহীন। পত্রিকায় ছাপা হতো, এন্ড্রিন পানে আত্মহত্যা! আমাদের নূরজাহানও সেদিন এন্ড্রিন পানে আত্মহত্যা করেছিল। বিয়ের আগে অখ্যাত এক এনজিওতে কাজ করতেন নূরজাহান।
হয়তো সেই এনজিওর বাইরে গ্রামের বাইরে খুব বেশি লোকজন তার নাম জানতো না। সেই প্রতিবাদ, জীবন দিয়ে প্রতিবাদ তাকে ছড়িয়ে দেয় সবখানে। মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি এই নাম কিনেছেন! সেদিনের সেই সালিশে ছাতকছড়া গ্রামে মতলিব মিয়ার বাড়ির উঠোনে তখনও গর্ত দুটি ছিল।
মতলিব মিয়া আমাকে বলেন, তার স্ত্রী নূরজাহান অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। সে জন্যে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন সালিশের আয়োজক, ফতোয়াবাজ মাওলানা মান্নান। বিরোধের সূত্রপাত সেখান থেকেই। তাদের বিয়ের ৪৫দিন পর ১৯৯২ সালের ১০ জানুয়ারি সেই প্রহসনের বিচার হয়। সেদিনই প্রান দেন নূরজাহান।
রিপোর্টের তথ্য-ছবি নিয়ে সে গ্রাম থেকে বেরুবার পথে দেখা হয় স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে। তারা গ্রামে ঢুকছিলেন। সে দলের সিনিয়র সাংবাদিক ইসহাক কাজল আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আইজ আমরার আর চাকরি নাই! আফনে ঢাকাত থাকি আইয়া রিপোর্ট লইয়া যাইরা গিয়া। আর আমরা গাউত ঢুকিয়ার।
শ্রীমঙ্গল থেকে ট্রেন ধরে ঢাকায় এসে নামি রাত আটটার পর। নির্ঘুম বিধ্বস্ত চেহারা আমার। আমি প্রতিদিন সেভ করার মানুষ। সেদিন শেভ না করায় আরও বিধ্বস্ত লাগছিল। কমলাপুর স্টেশনের পাশে একটি সেলুনে ঢুকে সেভ করে নেই আগে। এরপর রিকশায় গ্রিন রোডের অফিসে যেতে যেতে সাজাই রিপোর্টের লাইন।
অফিসে তখন আমরা নিউজ প্রিন্টের প্যাডে লিখতাম বল পয়েন্ট কলমে। রাতের বেলা তখন রিপোর্টের পিক আওয়ার। সবাই আমার রিপোর্টের অপেক্ষায়। এমন পরিস্থিতিতে রিপোর্টের বডি লিখি আগে। এরপর সূচনার অংশ লিখি। একটা রিপোর্টের শুরুর অংশটাই সবচেয়ে কঠিন অংশ।
এখানে রিপোর্টের আকর্ষনীয় মূল তথ্যাদি থাকবে। যা পাঠককে আকৃষ্ট করে নিয়ে যাবে রিপোর্টের ভেতরে। এই ইন্ট্রু তথা সূচনা থেকেই মূলত রিপোর্টের শিরোনাম তৈরি হয়। সেই তাড়াহুড়ায় আমি এক স্লিপ লিখি আর পাশে দাঁড়ানো শিফট ইনচার্জ হালিম ভাই সেটা নিয়ে যান।
এভাবে এক স্লিপ এক স্লিপ করে নিউজ গেছে কম্পোজে। পড়ে দেখতে পারিনি। দুই কিস্তিতে ছাপা হয় সেই নূরজাহান রিপোর্ট। রিপোর্টটি তখন এমন সাড়া জাগায় যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, মানবাধিকার, এনজিও কর্মীরা ছুটতে থাকেন ছাতকছড়ায়।
ফতোয়াবাজ মাওলানা মান্নান, সালিশের নেতা মনি সর্দারসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে শাস্তি হয় তাদের। এটি সম্ভবত বাংলাদেশে ফতোয়া বিরোধী আইনে প্রথম বিচার। ওই ঘটনার পর বিদেশ থেকে যে সব সাংবাদিক বাংলাদেশে আসেন তাদের কয়েকজন আমাকে নিয়ে স্পটে যান।
আনিসুল হক (পরে মেয়র হন) তখন বিটিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক। স্ত্রী রুবানা হক, আজকের পরিচিত মুখ আব্দুন নূর তুষারসহ আমাকে নিয়ে তারাও যান স্পটে। ইমদাদুল হক নূরজাহান উপন্যাস লিখে খ্যাতি বাড়ান। মিলন তখন নূরজাহান সে গ্রামের নানাকিছু নিয়ে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
ডেল্টা লাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি নারী নির্যাতনবিরোধী রিপোর্টের জন্যে চালু করে নূরজাহান স্মৃতি পুরস্কার। এর প্রথম পুরস্কারটি দেওয়া হয় আমাকে। জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে কবি বেগম সুফিয়া কামাল সে পুরস্কার তুলে দেন আমার হাতে। সঙ্গে ছিল পঁচিশ হাজার টাকার চেক।
সেটিই ছিল আমার সাংবাদিকতার জীবনের প্রথম বড় রোজগার। আমার বিয়েতে নিজের এটিই ছিল বড় অংশগ্রহন। রিপোর্টটি প্রকাশের এক-দুদিন পর একটা ঘটনা বেশ পীড়া দেয়। জাতীয় সংসদ ভবনে এলাকার সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের সঙ্গে দেখা হয়।
আমি তাকে ঘটনা জানিয়ে চাইছিলাম তিনি যদি বিষয়টি নিয়ে সংসদকে একটা নোটিশ দেন, আলোচনার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আমাকে হতাশ করে তিনি বলেন, বিষ খাইয়া মরছে। এ কথা বলে তিনি হন হন করে হেঁটে যান। নূরজাহান ইস্যু আলোচিত-জনপ্রিয় হবার পর কিন্তু এই এমপিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার-মতামত দিয়েছেন।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ নূরজাহান ফজলুল বারী সাংবাদিকতা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর