Monday 02 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেরিলিন মনরো: ন্যুড মডেল থেকে তারকা

সোহেল রহমান
১ জুন ২০২৫ ১৩:৪৬ | আপডেট: ১ জুন ২০২৫ ১৪:০০

মেরিলিন মনরো। যার নামের সঙ্গে আজ আর কোনো বিশেষণ প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কোনটা মেরিলিন মনরো’র সবচেয়ে বড় পরিচয়- মডেল, অভিনেত্রী, নারীবাদী নাকি ব্যক্তি জীবনে এক অসুখী ও যন্ত্রণাকাতর নারী। আর তার জীবনের সবচয়ে আলোচিত ঘটনা কোনটা- তারকা হওয়া, বিশ্বখ্যাত নাট্যকার আর্থার মিলারের সঙ্গে বিয়ে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তার ভাই রবার্ট কেনেডির সঙ্গে গোপন প্রণয়, নাকি তার মৃত্যু রহস্য! উত্তর যা-ই হোক, সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তার শরীর বন্দনা।

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মান নি মেরিলিন। রূঢ় বাস্তবতা কৈশোরেই তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কঠিন সত্যের মুখোমুখি। জীবিকার প্রয়োজনে মাসিক মাত্র ৫ সেন্ট বেতনে রেস্টুরেন্টে ডিশ ক্লিনারের কাজ করেছেন। কখনো বা সামান্য চুলের ফিতা কেনার টাকা জমাতে সারা মাস কাজ করেছেন রান্না ঘরে। তবে কারো পরোয়া করেন নি তিনি। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন অভিনেত্রী হবেন। শুধুমাত্র সৌন্দর্যকে পুঁজি করে যে কঠিন পিচ্ছিল পথে তিনি নেমেছিলেন, সেই জুয়া খেলায় তিনি হারেন নি। মেরিলিনের আগে ও পরে এ পথে হেঁটেছেন অনেকেই, কিন্তু তাদের কেউ তারকা হন নি। অন্যদের সঙ্গে তার স্বাতন্ত্র্য এখানেই।

বিজ্ঞাপন

মেরিলিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ১ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে । তার প্রকৃত নাম হচ্ছে- ‘নরমা জেন মোরটেনসন’। ‘নরমা জেন বেকার’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। কৈশোরেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যান। স্বামী হারা তার মা তাকে ফেলে রেখে আসেন আশ্রমে (এতিমখানা)। ছয় বছর বয়সে এক পালক পরিবারের বন্ধুর হাতে ধর্ষিতা হন তিনি। এক পরিবার তাকে শিখিয়েছিল তামাক ও মদ বিরোধী শপথ। আরেক পরিবার তাকে খেলতে দিয়েছিল হুইস্কির বোতল। এভাবে এক আশ্রম থেকে আরেক আশ্রমে এবং কখনো বা বিভিন্ন পরিবারে আশ্রিতা হিসেবে কাটে তার কৈশোর।

তের বছর বয়সে ‘নরমা জেন’ যখন ন্যুড মডেলিং-এ নামেন তখন তাকে কেউ চিনতো না। কিন্তু এ ন্যূড ছবিই একদিন তাকে নিয়ে আসে প্রদীপের আলোয়। তার ‘নরমা জেন’ নামটি বদলে দিয়েছিল স্টুডিও টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স। তিনি তখন ছিলেন এর পেশাদার মডেল। সপ্তাহে বেতন ছিল ১২৫ ডলার। ১৯৫০ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ক্রিস্টান ডুমস ক্যালেন্ডারে মেরিলিনের সম্পূর্ণ নগ্ন ছবি ছাপা হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।

এখানে উল্লেখ্য, ওই ক্যালেন্ডারের মডেল হিসেবে প্রাথমিকভাবে চারজনকে মনোনীত করা হয়। এদের মধ্যে মনরোই শেষ পর্যন্ত সেরা বলে বিবেচিত হন। এ ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হওয়ার পর হলিউডের নামিদামি পরিচালকের সিনেমায় অভিনয়ের অফার আসতে থাকে তার কাছে।

বলা যেতে পারে, তার নগ্নতার শরীরে অভিনেত্রী ও তারকার পালক পরিয়ে দিয়েছিল হলিউড। ক্রমশঃ মেরিলিন হয়ে ওঠেন সৌন্দর্যের দেবী। তার শারীরিক আবেদনের কাছে ম্লান হয়ে পড়েন হলিউডের সেই সময়কার অন্যান্য অভিনেত্রীরা। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ সবই তিনি করায়ত্ত করেছিলেন। সমাজের নিম্নশ্রেণী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যন্ত সকলেই ছিল তার রূপমুগ্ধ ও ভক্ত। খুব দ্রুত তার পারিশ্রমিক গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ডলারে।

খ্যাতির শিখরে আরোহণ করার পরও নিজের অতীতকে কখনো অস্বীকার করেননি মনরো। তিনি বলতেন, ‘আমি খুব সামান্য থেকে উপরে উঠেছি। জন্মের অভ্যর্থনা ছিল নিরুৎসব। জন্মের সময় মুখে মধুও দেয়নি কেউ।’

নিজের নগ্নতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, ‘পেটের ক্ষুধা ও অভাবের জন্যে আমি নগ্ন হয়েছি ফটোগ্রাফারদের সামনে। অর্থাৎ যা করেছিলাম, তা বেঁচে থাকার জন্যই করেছি। …তবে আমি কখনোই কারও রক্ষিতা ছিলাম না। সব সময় নিজেকে আমি নিজেই রক্ষা করেছি। …ক্যামেরার সামনে নগ্ন হয়ে পোজ দেওয়ার সময় শৈশবের সে সমস্ত স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়ত– ছোট্টবেলা থেকেই যা সযত্নে অন্তরে লালন করেছি।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘প্রেমিক ফ্রেড কারমারের কারণে কলম্বিয়া পিকচার্সের চাকরিটা চলে গিয়েছিল। তখন বেঁচে থাকার জন্য ফটোগ্রাফারদের মডেল হয়েছিলাম। ইচ্ছে করলে আমি রাতের হোটেলের নর্তকি হতে পারতাম। কিন্তু সে পথে আমি পা বাড়াইনি। আমার ইচ্ছে ছিল বড় অভিনেত্রী হওয়া।’

জীবদ্দশায় তার মেধা কিংবা অভিনয় ক্ষমতার কোনো মূল্যায়ন হয়নি, কেউ প্রশ্নও তোলেনি এ সব নিয়ে। বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি দাঁড়িয়েছিল শুধু হলিউডের সর্বকালের সেরা একজন ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে

জীবদ্দশায় তার মেধা কিংবা অভিনয় ক্ষমতার কোনো মূল্যায়ন হয়নি, কেউ প্রশ্নও তোলেনি এ সব নিয়ে। বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি দাঁড়িয়েছিল শুধু হলিউডের সর্বকালের সেরা একজন ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে …

মনরো বলতেন, ‘মেয়েদের যদি যৌবনের আবেদন আর রূপের পসরা না থাকতো, তাহলে পৃথিবীর এক শ্রেণীর নিকৃষ্ট পুরুষের কাছে তাদের কোনো আবেদন থাকতো না।’

তিনি বলতেন, ‘আমার দিকে মানুষ বার বার কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু মুখে বলেছে- সুন্দর, স্নিগ্ধ তোমার দেহ, যেন প্রথম বসন্তের স্বর্ণলতা। তোমার মতো আশ্চর্য কেউ নয়। কিন্তু কেউ বলেনি- এই যে আমি হাত বাড়িয়েছি, ধরো, হাত ধরো।’

কিন্তু তারপরও নগ্নতা ছিল তার এক ধরনের প্যাশন বা অবসেশন। মেরিলিন যখন খ্যাতির তুঙ্গে তখনো তিনি প্লে-বয় ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নগ্ন মডেল হয়েছিলেন। আর মৃত্যুর মাত্র দু’মাস আগে শেষবারের মতো নিজের নগ্নতাকে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেন তিনি।

মনরো প্রায়ই বলতেন- ‘আমি স্বপ্ন দেখতাম, নগ্নাবস্থায় ক্রুশবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর লোকেরা সব আমার পায়ের কাছে শুয়ে আছে।’

কখনও বা স্বপ্ন দেখতেন যে, গীর্জার ভেতর হেঁটে যাচ্ছেন তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন। পা ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। কারণ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে তার প্রতিবেশী, বন্ধু ও পরিচিতরা।

জীবদ্দশায় তার মেধা কিংবা অভিনয় ক্ষমতার কোনো মূল্যায়ন হয়নি, কেউ প্রশ্নও তোলেনি এ সব নিয়ে। বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি দাঁড়িয়েছিল শুধু হলিউডের সর্বকালের সেরা একজন ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে। আর এ জন্য দায়ী ছিলেন মেরিলিন নিজেই।

মনরোর ভাষায়- ‘পুরুষরা আমাকে ঘিরে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন- তা যৌনতা ছাড়া আর কিছু নয়। আর আমিও আমার আচরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে যৌন কামনার মূর্তিমান নারী হিসেবে চিহ্নিত করেছি।’

‘সেক্স সিম্বল’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে কী? অনেকের ধারণা এটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।’

সাধারণভাবে সৌন্দর্য ও যৌনতা প্রসঙ্গে তার মত হচ্ছে- ‘আমার ধারণা, সৌন্দর্য ও কমনীয়তা বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। যৌনতা তখনই আকর্ষণীয় যখন এটা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ প্রকৃতির এ দানের অসৎ ব্যবহার করে।’

‘টাইম’ পত্রিকা্য় একবার লেখা হয়েছিল- ‘নগ্ন হওয়ার জন্য মনরোর জিদ আর শ্রম তাকে সকলের কল্পনার নারীতে পরিণত করেছে।’

বলাবাহুল্য, নগ্নতা মনরোকে এমনই এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, তার কাছে দর্শক ও ভক্তদের প্রত্যাশা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে। কিন্তু এগুলো তার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না। এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও দুঃখ দুই-ই ছিল।

মৃত্যুর এক মাস আগে ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিও’র প্রধান পিটার লিভেস-এর সঙ্গে বসে এক নিবন্ধে মেরিলিন লিখেন, ‘আমি একজন ব্যর্থ নারী। পুরুষরা আমার কাছে আমার শক্তির চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা করেন। আমার কাছে তাদের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আমি তা দিতে পারি না। তারা বুঝতে চান না যে, আমার শরীর আর পাঁচজন নারীর মতোই। এর ঊর্ধ্বে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

একই সঙ্গে মৃত্যুর আগে মেরিলিন এ উপলব্ধিতেও পৌঁছেছিলেন যে, ‘বেশির ভাগ লোকের দৃষ্টিতে নারী কোনো মানুষ নয়, পণ্য মাত্র।’

মৃত্যুর মাত্র ১৫ দিন আগে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘যে মেয়েটি পণ্যে পরিণত হয়েছে, তাদেরকে আসলে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা। স্টুডিও তাদেরকে এমন হতে বাধ্য করে। আমি আমাকে মানুষ ভাবি, মেয়ে মানুষ নয়, পণ্য তো নয়ই। আমি পণ্যে পরিণত হতে ঘৃণা করি।’

মনরো ও প্লে-বয়: বহুল আলোচিত ‘প্লে-বয়’ ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিলেন মনরো। তাকে নিয়ে প্লে-বয় ম্যাগাজিনের প্রথম বিশেষ সংখ্যা বের হয় ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে। ওই বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীর শিরোনাম ছিল- ‘দ্য ম্যাগনিসিসান্ট মেরিলিন’। মনরোর উত্থানের পেছনে প্লে-বয় পত্রিকার এ বিশেষ সংখ্যাটি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন প্লে-বয় সম্পাদক হিউ এম হ্যাফনার।

এর দু’বছর পর ১৯৬২ সালে মনরোকে নিয়ে আরও একটি বিশেষ ক্রিস্টমাস সংখ্যা বের করার পরিকল্পনা ছিল প্লে-বয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এর কয়েক মাস আগেই চিরবিদায় নেন মনরো।

মনরোর মৃত্যুর পর এক বছর তার কোনো ছবি ছাপেনি প্লে-বয়। পরের বছর (১৯৬৪) জানুয়ারিতে ১৪ পৃষ্ঠার একটি ‘মনরো সংস্করণ’ বের করা হয়। এর শিরোনাম ছিল- ‘এম এম রিমেমবারড’।

‘প্লে-বয়’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিউ এম হ্যাফনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনরোর প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা দু’জন তিন ও চার দশকের এমনি একটা সময়ে বড় হয়েছি যখন আমেরিকায় সেক্স বিষয়টা ছিল এক রকম অপ্রীতিকর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নগ্নতা ও যৌন স্বাধীনতা আদর্শ হয়ে বর্তায় আমাদের উভয়ের ওপর। এ বিষয়টি আমাদের জীবনধারায় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।’

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

প্লে-বয় মেরিলিন মনরো সোহেল রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর