মঞ্চবাস্তবতায় উপন্যাসের সত্য উচ্চারণ, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
২৪ মার্চ ২০১৯ ১৫:১৭
শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে একটি আলোচিত মঞ্চপ্রযোজনা। আলোচনার স্পটলাইট সৈয়দ জামিল আহমেদ এর নাট্যনির্দেশনা কৌশল। নাট্যনির্দেশনায় তিনি প্রতিবার নতুন পথে হাঁটেন। ইতোমধ্যে তিনি থিয়েটার যোগাযোগে স্বতন্ত্র ভাষাবৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছেন। সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত প্রতিটি প্রযোজনাই একেকটি মাইলফলক। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের সফল নাট্যমঞ্চায়ন ইতিহাসে তাঁর নির্দেশিত ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘কমলারাণীর সাঘরদীঘি’, ‘বেহুলার ভাসান’, ‘চাকা’, ‘রিজওয়ান’ আলাদাভাবে চেনা যায়। এবার নতুন মাইলফলক স্থাপিত হচ্ছে তাঁর নির্দেশনায় শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
উপন্যাসের কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে, তথাকথিত নাট্যরূপায়ন না করে, উপন্যাসটিকে হুবুহু মঞ্চবাস্তবতায় দাঁড় করেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। হলে প্রবেশ করেই দর্শকের চোখে ধরা পড়ে নীলাভ একটি স্থির চিত্রপট। বিশালায়তনের মঞ্চ নাটকের প্রারম্ভেই দর্শকের অনুভূতিকে দোলা দেয়। জাতীয় নাট্যশালার মূল হলের প্রচলিত প্রোসেনিয়াম-সাইক্লোরামার পরিধি সরিয়ে বিস্তৃত সীমাজুড়ে অভিনয়ভূমি নির্মাণ করা হয়েছে। স্পেসকে ঢেলে সাজানো হয়েছে ত্রিমাত্রিক পরিসরে। অঙ্কের হিসেবে এই মঞ্চক্যানভাসের অভিনয়স্থান চুয়ান্ন ফুট প্রস্থের আশি ফুট ক্ষেত্রগভীরতা, আর উচ্চতায় আঠার ফুট। এই বিশাল মঞ্চ উপন্যাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। বর্ণনাত্মক গল্পকথন কৌশলে উপন্যাসটি মঞ্চে হাজির হয়। বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখলে- পুরো উপন্যাসটি একটি মহাচরিত্র হিসেবে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়, জনাকুড়ি কথক বা চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকে মেলে ধরে দর্শকের সামনে। প্রধান চরিত্রের সহযোগী চরিত্র হিসেবে মঞ্চে আসে- গল্পের কথনকৌশল, স্পেস, কম্পোজিশন, সেট, লাইট, কস্টিউম, প্রপস ও আবহসঙ্গীত। গল্পের প্রয়োজনে এসব চরিত্রের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি হয় নতুন নতুন দৃশ্যকাব্য। দর্শক চোখ মেলে উপন্যাসটি দেখতে থাকে।
‘ঊনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট্ করে ছিঁড়ে যায়। আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয় যে কারণে, এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়।’
কোরাসের সম্মিলিত কথন বয়ানে শুরু হয় আবদুল মজিদের অস্তিত্বের সংকটের উপন্যাস। পটভূমি ১৯৮৫। গল্পের শুরু মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১৪ বছর পর। গল্পের কেন্দ্রে মজিদ। তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় পুরান ঢাকার যুদ্ধকালীন সময় ও সমকালীন জীবন। মজিদের সমসাময়িক জীবন ও একাত্তরের যুদ্ধকালীন দুঃসহ স্মৃতিসময় এই দুই কাল ফ্ল্যাসব্যাক ও ব্যাক টু প্রেজেন্ট চিন্তা ও বর্ণনায় নন-লিনিয়ার কায়দায় গল্পটি এগিয়ে যায়। মূর্ত হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সময় বালক মজিদ, তার বোন মোমেনা ও পরিবারে আর্তনাদ। বদু মাওলানা ঢাকায় শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরি লেনের শান্তিবাহিনীর প্রধান। যার নির্দেশে একদিনে সাতজন মানুষ খুন হয় চৌধুরি লেনে। লক্ষ্মীবাজার এলাকায় প্রথম যেদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আসে তখন তাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল তিনজন নারী এবং একদিনে মারা গিয়েছিল সাতজন মানুষ। বদু মাওলানা মানুষ হত্যা করে আকাশে মাংস ছিটিয়ে দিতেন, আর অসংখ্য কাক সেই মাংস খাওয়ার জন্যে ভিড় করতো চৌধুরি লেনের আকাশে। বদু মাওলানার নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আজিজ পাঠানের বাড়ি লুটেরও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বালক মজিদ। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে বদু মাওলানার নেতৃত্বে রাজাকার দল মজিদের বোন মোমেনাকে তুলে নিয়ে যায়। চারদিন পর মজিদ তার বোন মোমেনার লাশ খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গ নদীর কিনারায়।
যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বদু মাওলনা পালিয়ে যায়। স্বাধীনতার মাত্র বছর দুয়েক পর বদু মাওলনা সাধারণ ক্ষমায় আবার ফিরে আসে পুরোনো চেহারায়। অবাক বিস্ময়ে সাধারণ মানুষগুলো শুধু দেখে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দলের স্থানীয় নেতা আবদুল আজিজ যিনি নিজেও শ্যামাপ্রসাদ লেনের বাসিন্দা ছিলেন, যুদ্ধের সময় যার বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে বদু মাওলানা। সেই আজিজ যখন মজিদের কাঁধে হাত রেখে বলে রাজনীতি করতে হলে- অতীতের অনেক কিছু ভুলে যেত হয়, মজিদ যখন দেখে আবদুল আজিজ শান্তিবাহিনীর প্রধান বদু মাওলানাকে ক্ষমা করে বুকে টেনে নেয়। তখনই মজিদের বিশ্বাস আর সকল আশার আলো নিভে যায়, এক ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বাংলাদেশ। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের ভেতর থেকেই পুনর্জন্ম নিতে থাকে রাজাকার ও তাদের দোসরেরা। রাজাকারদের পুনরুত্থান ঠেকানোর ক্ষমতা আবদুল মজিদের নেই, যেহেতেু রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব সমর্থনের মধ্য দিয়ে রাজাকারেরা এগিয়ে যাচ্ছে তাই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই আবদুল মজিদ নিজ মহল্লা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
দুই ঘণ্টা মঞ্চবাস্তবতায় আটচল্লিশ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি একটি মহাচরিত্র হিসেবে নিজেকে মূর্ত করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন উপন্যাসটি ১৯৮৭ সালে শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই ১৯৮৭ সালের পরের ঘটনা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই উপন্যাসের গল্পে অনুপস্থিত। ঔপন্যাসিক উপন্যাসটি রচনার সময়কালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কথা বলেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসের ফ্রেমে বন্দি করেননি। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় একেঁছেন পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিভৎস তাণ্ডব, তাদের পুনরুত্থান, পুনর্বাসন আর ক্ষমতায়নের সত্য উচ্চারণ। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার অবস্থান থেকে এই নাটকটি বিবেচনায় নিলে বিভ্রাট সৃষ্টি হতে পারে। কারণ রাজনৈতিক ইতিহাসে গত এক দশকের বাস্তবতায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে- সকল চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম এখনও চলছে, তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশগড়ার কাজে দৃঢ়ভাবে প্রত্যয়ী, সর্বোপরি স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি দেশপরিচালনায় বিশ্বব্যাপি সুনাম অর্জন করে চলেছে।
শিল্পকলার যেকোনো মাধ্যমে সমালোচনা ও পর্যালোচনা থাকবে এটিই স্বাভাবিক রীতি। শিল্পবিচারে থিয়েটারও ব্যতিক্রম নয়। একটি প্রযোজনা শেষে দর্শকের ভিন্ন মত, দ্বিমত, পর্যলোচনা ও সমালোচনা হলে থিয়েটার আরও গতিশীল, পেশাদার ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। সম্প্রতি এই প্রযোজনাটি ঘিরে সাধারণ দর্শক, নাট্যকর্মী, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, বেতার, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অঙ্গনে যে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হচ্ছে- এটা নিঃসন্দেহে থিয়েটারচর্চার জন্য শুভ দিক বলে আমি বিবেচনা করি।
বাংলাদেশে পেশাদার নাট্যচর্চার লক্ষ্যে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে প্রযোজনা ভিত্তিক নাট্যসংগঠন ‘স্পর্ধা’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর শিল্পসৃষ্টির তাগিদেই ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসটিকে তারা মঞ্চক্যানভাসে চিত্রিত করেছে। সমকালীন জীবন ও মঞ্চবাস্তবতায় এধরণের উদ্যোগ সত্যিই একটি স্পর্ধার ব্যাপারই বটে। আর এধরণের স্পর্ধা দেখানো সম্ভবপর হয়েছে নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ এর থিয়েট্রিক্যাল অদম্য প্রাণশক্তির কারণে। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন কৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- দুই ঘণ্টা সময়ের প্রযোজনাটি চলে বিরতিহীন। ভীষণ গতিময়। ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যকল্প তৈরি হয়, আবার নিমিষেই বদলে যায়। দর্শকের সামনেই ঘটে সব অদল-বদল। নানান দৃশ্য ও ঘটনার সমন্বয়ে নির্দেশক যে ক্যানভাস মেলে ধরেন তা এক কথায় অনবদ্য। এসব কাজে দেখা মেলে থিয়েটারের সেট ও প্রপস ব্যবস্থাপনা সহযোগীদের চুপিসার পেশাদার নৈপুণ্য। প্রযোজনাটিতে বেশ কিছু বিষয় সংযোজন বিয়োজন করলে আরও অর্থপূর্ণ পূর্ণতা লাভ করবে- পুরো প্রযোজনা জুড়ে আবহসঙ্গীতের সাউন্ড লেভেল সংলাপের চেয়ে অনেক উচুঁতে পরিবেশিত হয়। যে কারণে আপস্টেজের সংলাপগুলো দর্শক তেমন শুনতে পাননি। মুহুর্মুহু কম্পোজিশন, সেট ও দৃশ্যপট পরিবর্তন করায় দর্শকের কল্পনায় নাট্যমূহূর্ত সৃষ্টি হতে না হতেই বিলীন হয়ে যায়। দ্রুত পরিবর্তন ও অধিক গতি গল্পের রূপক, সাংকেতিক, মনস্তাত্ত্বিক বা দার্শনিক বক্তব্য সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে নিবিড় যোগাযোগ পথ তৈরি করতে হয়, তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। রিয়্যেলিস্টিক প্রপস ব্যবহার না করলেও দর্শক ঐসব ঘটনা বুঝে নিতে পারবে, এতোটুকু বিশ্বাস দর্শকদের বোধ হয় করা যেতে পারে। প্রযোজনাটিতে অভিনয় করছেন সোয়েরী সুলতানা, প্রদ্যুৎ কুমার ঘোষ, আব্দুর রাহীম, শরীফ সিরাজ, মহসিনা আক্তার, সউদ চৌধুরী, সোহেল রানা, যোজন মাহমুদ, উত্তম চক্রবর্তী, সরওয়ার জাহান উপল, পিজু পারভেজ, কৌশিক বিশ্বাস, ফয়সাল কবির সাদি, শাহীন সাইদুর, শোভন দাস, সজীব চন্দ্র সরকার, হাসান তাবিন, ইরফান উদ্দীন, সানজিদা মিশি। নেপথ্য কুশীলবের মধ্যে রয়েছেন পোশাক পরিকল্পনায় মহসিনা আক্তার, কোরিওগ্রাফিতে অমিত চৌধুরী এবং মঞ্চ নির্মাণে আমানউল্লাহ খান মোনা।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ প্রযোজনার অন্যতম শক্তি হলো অভিনয়শিল্পীদের সম্মিলিত এনার্জি। এই যুথবদ্ধ এনার্জির প্রধান কারিগর নাট্যজন সৈয়দ জামিল আহমেদ। প্রযোজনার মূল পরিকল্পনা ও নির্দেশনার পাশাপাশি মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা এবং সংগীত নির্বাচন এই তিনটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নিজে ডিজাইন সম্পন্ন করেছেন। নির্দেশক উপন্যাসের তৎপর গল্পবাস্তবতার প্রয়োজনে গতিময় বেশ কয়েকটি শৈল্পিক নাট্যমূহুর্ত সৃজন করেছেন, যা দেখে যেকোনো দর্শকই মুগ্ধ হবেন। এসব থিয়েট্রিক্যাল নাট্যমুহূর্তই নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ এর নাট্যপ্রযোজনা সিগ্নেচার, তাঁকে চিনে নেবার শিল্পশৈলী। মঞ্চের আলোয় ও নেপথ্যে মিলে ত্রিশজন কলাকুশলী দু’ঘণ্টায় যে উদ্যম, ভক্তি, প্রাণশক্তি, তেজ নিয়ে উপন্যাসের ঘটনাটিকে মঞ্চবাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজনীয় শিল্পউপাদানগুলোকে একটি চূড়ান্ত বিন্দুতে এনে নান্দনিক কৃত্যে রূপান্তর ঘটান- সেখানেই লুক্কায়িত থাকেন নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ, এজন্যই তাঁর স্পর্শে অনন্য মাত্রায় পৌঁছায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
সারাবাংলা/পিএম
জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিষাদ সিন্ধু মঞ্চ নাটক রিজওয়ান শহীদুল জহির সৈয়দ জামিল আহমেদ