‘নবীনদের সঙ্গে প্রবীণদের সংযোগ ঘটানোর দায়িত্বটা আমাদেরই’
২৩ জুলাই ২০২০ ১৬:৪৬
বাংলাদেশে মূলধারার নৃত্যচর্চায় যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তাদের মধ্যে অন্যতম মুনমুন আহমেদ। যিনি একাধারে একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার, নৃত্য নির্দেশক এবং শিক্ষক। পাশাপাশি একজন সু-অভিনেত্রী হিসেবেও স্থান করে নিয়েছেন এ দেশের নাট্যাঙ্গন ও চলচ্চিত্রে।
অসাধারণ নান্দনিক চিন্তাভাবনা ও সৌন্দর্যের অধিকারী মুনমুন আহমেদ তার নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিলেও তার শিল্পী জীবনের সূচনা হয়েছিল গান শেখার মাধ্যমে। কৈশোরে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীতগুরু ওস্তাদ আখতার সাদমানীর কাছে। কিন্তু এ পথে বেশিদূর এগুনো হয়নি। নাচের প্রতি অনুভব করেছিলেন তার ভালোবাসা, ভালো লাগা। গান ছেড়ে চলে আসেন নাচে। হাতেখড়ি নেন ওস্তাদ আজহার আলী সাহেবের কাছে। এরপর তালিম নেন নৃত্যগুরু হাবিবুল চৌধুরী ও সালেহা চৌধুরীর কাছে। নৃত্যচর্চায় এতোটাই নিবিড়ভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি, তার ফলস্বরূপ ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
মুনমুন আহমেদ এরপর পদ্ধতিগত কত্থক নাচের তালিম নেন নৃত্যগুরু সৈয়দ আবুল কালামের কাছে। তার শিক্ষায় অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে একজন চৌকস নৃত্যশিল্পী হিসেবে তৈরি করেন মুনমুন। ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চে প্রশংসিত হয় তার নৃত্য পরিবেশনা। ১৯৮৭ সালে আসে তার জীবনের বিশেষ সুযোগ- ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে নাচ শিখতে দিল্লি চলে যান তিনি। ভারতের কত্থক কেন্দ্র থেকে ১৯৯০ সালে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে (কত্থক) সম্মান সহ ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন এবং ১৯৯২ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে সম্মানোত্তর পোস্ট ডিপ্লোমা ডিগ্রী ও ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে ফেলোশিপ লাভ করেন তিনি। দিল্লিতে তার গুরু ছিলেন কত্থক নৃত্যের কিংবদন্তী নৃত্যগুরু পন্ডিত বিরজু মহারাজ, পন্ডিত রাজকুমার শর্মা ও পন্ডিত রামমোহন মহারাজ।
নৃত্যচর্চার পাশাপাশি মুনমুন আহমেদ অভিনয় করেছেন অসংখ্য টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে। হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত ‘আমার আছে জল’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়।
বাংলাদেশে কত্থক নৃত্যের প্রসারে ১৯৯৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেওয়াজ পারফরমার্স স্কুল’- যেখানে কত্থক নৃত্যের মুলধারায় শিক্ষার্থীরা সরাসরি তালিম নিচ্ছেন তার কাছ থেকে। এরই মধ্যে একাধিক শিক্ষার্থী প্রতিশ্রুতিশীল নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এ দেশের নৃত্যাঙ্গনে।
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই ঘরবন্দি সময়েও থেমে থাকেন নি মুনমুন আহমেদ। অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তার নৃত্যচর্চায়, নৃত্যশিক্ষায়। তার এই ব্যস্ততার মধ্যেই নতুন করে যুক্ত হল আরেকটি আয়োজন- ভারতীয় দূতাবাসের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)’র অনলাইনে নৃত্যশিক্ষার ওয়ার্কশপ ‘গুরুপ্রথা-২’। অনলাইনে কত্থক ও মনিপুরী নৃত্যের ওয়ার্কশপ। শুক্রবার (২৪ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া এই ওয়ার্কশপে কত্থক নৃত্যে তিনটি ব্যাচে ১৫ জন করে ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে কত্থক শেখাবেন তিনি।
মুনমুন আহমেদ আইজিসিসি’র এই আয়োজন এবং ঘরবন্দি সময়ে তার যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়ে কথা বললেন সারাবাংলা’র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্ত’র সঙ্গে। তারই বিস্তারিত সারাবাংলা’র পাঠকদের জন্য…
• প্রসঙ্গঃ আইজিসিসি’র এই কোর্স _
এটাকে পুরোপুরি কত্থক শেখার ক্লাস বলা যাবে না। কারণ চারটা শুক্রবারে চারটা ক্লাসে কত্থক শিখে ফেলা একেবারেই সম্ভব নয়। এটা শুধুমাত্র কত্থক সম্পর্কে একটা ধারনা দেয়া। বিশেষ করে যারা যে অবস্থানে আছে, তাদেরকে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটা পথ দেখানো। এটা যদি দীর্ঘমেয়াদি হত তাহলে হয়তো একজন শিল্পী তৈরি হত। চারটা ক্লাসে তো এটা সম্ভব হবে না।
প্রথম দিকটাই এটা নিয়ে একটু চিন্তিতই ছিলাম যে, মাত্র চারটা ক্লাসে কিভাবে সেট করবো। কত্থক নাচ হচ্ছে একটা মহাসাগর। এক্ষেত্রে আমি যেটা করেছি, সেটা হল চারটা ক্লাসের একটা সিলেবাস দাঁড় করিয়েছি। যেটাতে কত্থক সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া। বিশেষ করে যারা একেবারে নতুন তাদের মধ্যে কত্থক নাচের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ে এবং এটার মধ্যে যেন লেগে থাকে। আমি বিশ্বাস করি যে, যদি তাদের মধ্যে কত্থক নাচের প্রতি ভালো লাগাটা আমি তৈরি করে দিতে পারি, তাহলে এটা নিয়ে তারা আরো শিখতে চাইবে, কাজ করতে চাইবে। একদম কিছু না করার চাইতে অন্তত কিছু একটা করা বা একটা কিছুর মধ্যে লেগে থাকাটাকে আমি পজেটিভ মনে করি। সে জন্যই নতুনদেরকে একেবারে প্রাথমিক ধারণা এবং ইন্টারমিডিয়েট ও এডভান্স ব্যাচের শিক্ষার্থীদের তাদের মতো করেই ক্লাসটা নেবো।
• আইজিসিসির সঙ্গে আবার _
আমি মনে করি আইজিসিসির কোর্সটা আবার চালু হওয়া উচিৎ। কারণ সারা বিশ্বে ওদের কর্মকান্ড রয়েছে। সেখানে নাচ, গান। ইয়োগা- সবই শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের এখানে নাচটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়াটা নাচের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি। আইজিসিসি’র এই কোর্সে প্রচুর ছেলে-মেয়ে নাচটাকে ভালোবেসেই ভর্তি হয়। এবং প্রতি বছরই এখান থেকে ট্যালেন্টেড কিছু নৃত্যশিল্পী বের হত- যেটা আমাদের নৃত্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা পিছিয়ে পরছি। তাই এই কোর্সটা আবার চালু করা প্রয়োজন। আইজিসিসি’র কাছে আমার অনুরোধ তারা যেন বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবেন।
• করোনাকালিন সময়ের ব্যস্ততা _
প্রথম দিকটাই ভেবেছিলাম যে এটা থেকে দ্রুতই মুক্ত হতে পারবো। তাই শুরুর দিকে নাচ নিয়ে কোন ভাবনাই ছিল না। বই পড়ে, সিনেমা দেখে সময় কাটিয়েছি। এরপর যখনই পহেলা বৈশাখ, আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস, ঈদুল ফিতর- একটার পর একটা বিশেষ দিবস আর উৎসব গুলো চলে আসলো, মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই দিনগুলো আমরা কিভাবে কাটাতাম, কত কাজ করতাম। আমার মনে হল আমি কি বাসায় থেকেই কাজ করতে পারি না। সিদ্ধান্ত নিলাম কাজ করবো। প্রথমে পহেলা বৈশাখ, এরপর আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস- এভাবেই প্রতিনিয়ত একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছি। এর মধ্যে আমাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল। ঐ উপলক্ষে সুজিতকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য চিলেকোঠায় উঠে একটা নাচের ভিডিও বানালাম- ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’। এছাড়াও আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনলাইনে ক্লাসটা আরও আগেই শুরু করে দিয়েছিলাম। আরেক কাজ করছি- সেটা হচ্ছে স্কুলের ছেলে-মেয়েদেরকে আমার নাচের ভিডিও করে পাঠাচ্ছি। ওরা সে নাচটা ওদের ঘরে বসেই তুলে আবার আমাকে পাঠিয়ে দেয়। আমি সেটা দেখে ওদের ভুল ভ্রান্তিগুলো শুধরে দেই। আমি সামনে থেকে ওদের শেখাতে পারছিনা, কিন্তু চেষ্টা করছি ওদের মধ্যে নাচের ধারাবাহিকতা বা চর্চাটা যেন নিয়মিত চলতে থাকে। এছাড়াও প্রতি বুধবার শিল্পকলা একাডেমীর বছরব্যাপী কত্থক নৃত্য কর্মশালার ক্লাস চলছে আমার অনলাইনে।
• অনলাইন আড্ডা ‘নাচের নেপথ্যে’ _
এটাও এই করোনাকালিন সময়ের কাজ। অনলাইন আড্ডায় আমাদের নাচের জগতের জ্যেষ্ঠ শিল্পী বা নৃত্যগুরুরা রয়েছেন, তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তাদের নাচের যাত্রাপথের গল্প শুনতে। মূলত নবীনদের জন্যই এই আয়োজন। তারা যেন এই জ্যেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী বা নৃত্যগুরুদের সম্পর্কে জানতে পারে। তারা কতটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নাচের জগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নবীনরা যেন সেটা জানতে পারে। কারণ নতুন প্রজন্ম এদেরকে চিনে না। আর আমি মনে করি এটা আমাদেরই দায়িত্ব যে নবীনদের সঙ্গে প্রবীণদের সংযোগ ঘটানো। তাই আমি এটা শুরু করলাম।
• আইজিসিসির এই আয়োজন থেকে প্রত্যাশা _
একদম কিছু না হওয়ার থেকে আবার যে একটু একটু করে হচ্ছে, এটাতে আমি আনন্দিত। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, এই দুঃসময়টা আমরা পার করে উঠবো। শুধু এই সময়টাকে আমাদের এভাবেই কাজ করে যেতে হবে। আমি আগেই বলেছি- চারটা ক্লাসের মাধ্যমে বিশাল কিছু আশা করাটা ভুল। তারপরও আনন্দ একটাই যে, আইজিসিসি থেকে এই আয়োজনটা হচ্ছে। এবং নতুন কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারছি। এটাও একধরণের ভালো লাগা। মজার বিষয় আইজিসিসি থেকে এই কোর্সের বিজ্ঞাপন দেয়ার সাথে সাথেই পনের জন করে তিনটা ব্যাচে পঁয়তাল্লিশ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে গেছে। অনেকেই ভর্তি হতে পারেনি। ওরা এখন আমাকে অস্থির করে তুলছে, এটার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তার মানে এটার প্রতি অনেকেই আগ্রহী। তাই আমি মনে করি এটাকে দীর্ঘমেয়াদি করলে ভালো হয়।
• সবশেষে _
আমরা হয়ত অনেক কিছুই করছি। কিন্তু আমাদের জীবনযাপনটা তো বদলে গেল। অনেকেই আজ বিপর্যস্ত। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার কারনে সেটাও অনেকে করতে পারছে না। আমি আমার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের সহযোগিতা করার। তাই একটাই প্রার্থনা, আমরা সবাই আগের মতোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। জানি না সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য কি ভেবে রেখেছেন।
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে
অনলাইন ক্লাস আইজিসিসি কত্থক নৃত্য নৃত্য প্রশিক্ষণ নৃত্যগুরু পন্ডিত বিরজু মহারাজ নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ রেওয়াজ পারফরমার্স স্কুল