শিল্পী-স্বজনের ভালোবাসায় দিলুর শেষ বিদায়
১৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৩৭
না ফেরার দেশে মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু। আজ (১৯ জানুয়ারি) সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬৯ বছর বয়সি প্রবীণ এই অভিনেতা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘সংশপ্তক’ নাটকে ‘মালু’ চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করা এই অভিনেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিলেন সংস্কৃতিকর্মী ও অনুরাগীরা। বিকেল ৩টায় তার মরদেহ রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে।
অভিনয় দিয়েই সবার সবার হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া এই মানুষটিকে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে ভালোবাসা জানালেন সকলেই। মুজিবুর রহমান দিলুর দীর্ঘদিনের অগ্রজ-অনুজ সঙ্গীরা। সবাই নির্বাক। বেদনার্ত হৃদয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন সতীর্থরা। এ কান্না যেন সবার। হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই অভিনেতা। সেখানে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। মুজিবুর রহমান দিলু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘তার মরদেহ সামনে রেখে কথা যে কোন সহযোদ্ধার জন্য খুবই কঠিন কাজ। মুজিবুর রহমান দিলু- যখন মাত্র ১৮ বছর বয়স, তখনই সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল দেশ মাতৃকার ডাকে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এই দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এবং সে এতটাই নিবেদিত ছিল যে, যুদ্ধে যদি জীবনও দিতে হয়, তাও সে হাসিমুখে দিতে প্রস্তুত ছিল সেই সদ্য কৈশোর পেরুনো যুবক।’
‘আমরা যখন ভারতে ট্রেনিং নিই, তখনও বুঝতে পারিনি, কতটা সাহসী ছিল সে। ঢাকায় আসার পর, আমাদের ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনীর যাদের মধ্যে ছিল- শহীদ মানিক, শিল্পী শাহাবুদ্দিন, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, মাহবুব আলী, মুজিবুর রহমান দিলু- এদের প্রত্যেকেই স্বনামে খ্যাত। আমার মনে আছে, সেই সময়টায় ঢাকা শহরের কিছু স্কুল-কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে। তখন খালেদ মোশারফ সেক্টর ২-এর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্দেশ দিলেন যে, যেসব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা আছে, সেসব বন্ধ করিয়ে দিতে হবে।’
‘খালেদ মোশারফের নির্দেশ পেয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, মোট ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে যে কয়টা সম্ভব আমরা বন্ধ করিয়ে দেবো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা যে বোমা ফাটাবো বা গোলাগুলি করবো, এতে কি ছাত্রদের শারীরিক ভাবে কোন ক্ষতি হবে কিনা। কারণ, ছাত্ররা তো কোন না কোন ভাবে আমাদেরই বন্ধু। যদিও সেসময় খুবই স্বল্পসংখ্যক কিছু ছাত্র ক্লাস করছিল। তো সেই তেরটির মধ্যে মুজিবুর রহমান দিলুর উপর দায়িত্ব ছিল ঢাকা কলেজ বন্ধ করার। সে নিজেও ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্র। বলা যায়, সে তার নিজের জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে কোন রকম ক্ষতিসাধন ছাড়াই এই অপারেশনটা অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করেছিল।’
‘এই ব্যাপারটা আজকে বলাটা যত সহজ, সেদিন কিন্তু এরকম একটা অপারেশন ঘটানো সহজ ছিল না। দিনের বেলা একটা ছেলে কলেজে ঢুকছে, যাকে সবাই চেনে। এবং সে যে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেটাও সবাই জানে। সেখানে নিজের কলেজে নিজেই বোমা মারতে পারাটা কতটা সাহসিকতার ব্যাপার, সেটা মুজিবুর রহমান দিলু বলেই সম্ভব হয়েছিল। আর সম্ভব হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে।’
‘আজকে আমরা দিলুকে সম্মান দিতে পারছি, রাষ্ট্র তাকে বিশেষ সম্মান দিচ্ছে- এই নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলোর কাছে এটাই প্রাপ্তি। সংস্কৃতির প্রতি সে এতটাই নিবেদিত ছিল যে, যুদ্ধ শেষে ঘরেও ফিরে যায়নি। জড়িয়ে পড়লো নাটক আর শিল্পচর্চায়। এবং একটা কথা সত্য দিলু যে কাজই করেছে, একেবারে মন প্রান দিয়ে করেছে। যার ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য ছিল তার মাথার মুকুট। তার ‘আমি গাধা বলছি’র নাটক সেই দশকেই অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। চরিত্রাভিনয়ে ভীষণ পারঙ্গম ছিল সে। সুন্দর কণ্ঠস্বর আর শুদ্ধ উচ্চারন, তার বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য।’
‘আজকে দিলু আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। এই চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের একটি অংশের পরিসমাপ্তি ঘটলো। ইতিহাস সবসময় একজন মানুষের কর্মের সাতে সম্পৃক্ত থাকে। দিলু যুদ্ধ করেছিল, তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে দিলু জড়িত। দিলু শিল্পচর্চার বিভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে কাজ করে গিয়েছিল, সফল ভাবে মানুষকে পথ দেখাতে পেরেছিল বলেই শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসেও সে সমান অংশীদার। ইতিহাসের এই অংশকে আজ আমরা বিদায় দিচ্ছি। যে বিদায় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে। বলতে চাই, দিলু, তুমি যেমন আমাদের শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে, আমরাও তোমাকে সমান ভাবে আজীবন ভালোবাসি। তোমার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা…’
ছবি- সারাবাংলা