স্মৃতি হয়ে যাওয়া ‘মিষ্টি মেয়ে’র আজ জন্মদিন
১৯ জুলাই ২০২১ ১২:২৪
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী অভিনেত্রী কবরী সারোয়ার। ষাট ও সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত এই নায়িকার আজ জন্মদিন। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতে জন্মগ্রহন করেন অভিনেত্রী কবরী সারোয়ার। তার আসল নাম ছিল মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল।
দর্শকরা ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন ‘মিষ্টি মেয়ে’। মিনা পাল থেকে হয়েছেন মানুষের ভালোবাসার কবরী। অভিনয় গুণে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। অভিনয় জীবনে যেমন ছিলেন অনন্য, ব্যক্তি জীবনেও ছিলেন অনন্য। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব কবরীর। এরপর থেকে ধীরে ধীরে টেলিভিশন এবং সিনেমা জগতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে ভারত পাড়ি দেন।
কলকাতা গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এসময়ের একটি স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে কবরী বলেন, ‘সেখানে একটি অনুষ্ঠান হয়। আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে আমি তুলে ধরি, কীভাবে আমি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় সেখানে পালিয়ে যায়। সেটা বলতে বলতে আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করি যেন আমার দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, আমার মা-বোনকে বাঁচানোর জন্য। তারপর আমি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ি। আর কিছুই জানিনা।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্র জগতে মনোনিবেশ করেন কবরী সারোয়ার। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ ছবির নায়িকা হিসেবে অভিনয় জীবনের শুরু কবরীর। এরপর থেকে প্রায় একশ’টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে হীরামন, ময়নামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার, বিনিময়, আগন্তুকসহ জহির রায়হানের তৈরি উর্দু ছবি ‘বাহানা’ এবং ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে নায়ক ফারুকের বিপরীতে ‘সারেং বউ’ ছবিতে অভিনয়ের পর সারেং বউ নামে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের কেরিয়ারে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো নায়কদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
ঢাকার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী। তাদের এই বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলছিলেন, ‘আমরা এতটাই আবেগ দিয়ে অভিনয় করতাম যে, ছবির প্রতিটি দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তুলতাম।’
২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চিত্রপরিচালক হিসেবেও তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন। এমন কি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ তে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী মূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক।’
দৃঢ়চেতা এই মানুষটি হার মানলেন করোনা কাছে। ১৩ দিনের লড়াই করে বেঁচে ফিরতে পারলেন না ‘সারেং বউ’। ৫ এপ্রিল করোনা নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হন কবরী। সেখান থেকে অবস্থার অবনতি হলে ৮ এপ্রিল তাকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানেই ১৭ এপ্রিল (শনিবার) রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তী শিল্পী। যে মৃত্যুকে ভয় পেতেন কবরী, সে মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্যের কাছে হার মানতে হলো তার। মৃত্যু নিয়ে কিংবদন্তি কবরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে অনেকগুলো দরজা থাকে। তার মধ্যে মৃত্যু হলো শেষ দরজা। মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার চোখ জলেতে ভরে যায়। কবরী আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, সামান্য একটু কথা বলতেও নয়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে, ভাবলেই ভয় লাগে।’
বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ের শেষশয্যা হয়েছে বনানী কবরস্থানে। তার কবর মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জাতীয় পতাকায়। তার প্রতিটা জন্মদিন মানেই ভক্ত, আত্মীয়স্বজন ও কাছের লোকদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হওয়া। রাত ১২টা বাজার আগ থেকেই মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসতে থাকে অসংখ্য ক্ষুদে বার্তা। সে বার্তা পড়তে পড়তে রাত পেরিয়ে যায়। কেউ কেউ বাসায় ফুল নিয়েও আসেন শুভেচ্ছা জানাতে। কিন্তু এবারের এই জন্মদিনটা …
কবরী আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, সামান্য একটু কথা বলতেও নয়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেলেন আমাদের ‘মিষ্টি মেয়ে’ …
সারাবাংলা/এএসজি