Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তারেক মাসুদ অভিভাবকের মতো গাইডলাইন দিতেন

আহমেদ জামান শিমুল
৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:৩১

ফজলুল হক— প্রখ্যাত নির্মাতা তারেক মাসুদের শেষ ছবি ‘রানওয়ে’-এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সোমবার (৬ ডিসেম্বর) নন্দিত এ নির্মাতার ৬৫তম জন্মবার্ষিকীতে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সারাবাংলার সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আহমেদ জামান শিমুল।

‘রানওয়ে’ ছবিতে যুক্ত হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।

সত্যি কথা বলতে অডিশনের আগ পর্যন্ত তারেক ভাইকে আমি চিনতাম না। প্রথম দিন অডিশনে যাওয়ার পর স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে দিলেন। অনুযায়ী সংলাপ বলতে হবে, অভিনয় করতে হবে। কী কারণে জানি না আমি খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। এর আগে আমি অডিশন ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। আমার সঙ্গে আরেকজন অডিশন দিয়েছিলেন। তিনি বেশ ভালো করেছিলেন। তাতে আমার নার্ভাসনেস আরও বেড়ে গেল। কিন্তু একটা ব্যাপার তখন খেয়াল করেছিলাম, এখনও চোখে ভাসছে—আমার ভুল হচ্ছে, এরপরও তারেক ভাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখে চোখে পড়লে সৌজন্যের হাসি দিচ্ছিলাম। সে দিন আমার অডিশন খারাপ হয়েছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি বাদ। কিন্তু পরবর্তীতে ডাকলেন।

এরপরের দিন আগের থেকে ভালো করলাম। এভাবে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। আমার সঙ্গে আরেকজন যিনি ছিলেন তার সঙ্গে আমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছিল। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, ওই ছবির সহকারী পরিচালক আবু শাহেদ ইমন আমাকে বলে দিয়েছিলেন, ফজলুল তুমি যদি মূল চরিত্রটা না করতে পারো, তাহলে কি মন খারাপ করবা? আমি বলেছিলাম, না ভাই। মন খারাপ করবো কেনো? আমি টিমের সঙ্গে থাকতে পারলেই খুশি হবো।

ইমন ভাই বলেছিলেন, তোমাকে অন্য একটা চরিত্রে ভাবছি, আবার এ চরিত্রেও হতে পারে। মন খারাপ করো না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, মূল চরিত্রে থাকতে পারবো না। একদিন সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে অফিসে যেতে বললো। তারেক ভাইয়ের অফিস তখন মোহাম্মদপুর বাবর রোডে ছিল। অফিস থেকে তারেক ভাইয়ের গাড়িতে করে তার ফার্মগেটের বাসায় গেলাম।

ভাইয়া আমাকে ‘রানওয়ে’-এর একটি দৃশ্য—আয়নায় আমি আমার বিবেকের সঙ্গে কথা বলছি, করতে দিলেন। দৃশ্যটা করার পর, উনি আমাকে বললেন, অন্যভাবে করে দেখাতে পারবো কিনা। আমি অন্যভাবে চেষ্টা করলাম। এভাবে ৩ থেকে ৪ বার করলাম। তারেক ভাই বললেন, ঠিক আছে, তুমি আজকে যাও।

এরপরে একদিন আমাকে জানালো হলো আমি চরিত্রটার জন্য চূড়ান্ত হয়েছি। এ ঘটনা ২০০৮ সালের শেষের দিকের। বেশ কয়েকবার অডিশন মিলিয়ে চূড়ান্ত হতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লেগেছিল।

শুটিং শুরু করেছিলেন কবে? কোথায় কোথায় শুটিং করেছিলেন?

২০০৯ সালের শেষের দিকে। উত্তরায় আমাদের বেজ ক্যাম্প করা হয়েছিল। এয়ারপোর্টের পাশে অনেকগুলো দৃশ্যের শুটিং করা হয়েছিল। এয়ারপোর্টের পাশে রুহুলের বাড়ির সেট করা হয়েছিল। এছাড়া সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাভার এরকম বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়েছে।

প্রশ্নটা তারেক মাসুদ বেঁচে থাকলে ওনাকে করলে ভালো হতো। তারপরও আপনাকে করছি—একটা দৃশ্যে আপনি জঙ্গীবাদ থেকে ফিরে এসেছেন। বাড়ি ফিরছেন। এমন সময় আপনার মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য কীভাবে ধারণ করা হয়েছিল?

এরকম দৃশ্য ছবিতে বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছিল। আরেকটা দৃশ্য ছিল ঘরের ভিতর থেকে প্লেনটা যেতে দেখা যাচ্ছে। কখন কোন প্লেইন উঠবে, নামবে এটার শিডিউল তারেক ভাই আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ওই অনুযায়ী আমরা প্রস্তুত থাকতাম। তারপরও একই সঙ্গে শিল্পী ও প্লেনের শট ঠিকঠাক নেওয়া—এটা অবশ্যই তারেক ভাইয়ের মুন্সিয়ানা। এখানে আমি স্মরণ করছি মিশুক মনির ভাইকেও। দুজনের চমৎকার কেমেস্ট্রি ছিল।

শুটিংয়ের সময়কার বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কি?

শুটিংয়ের সময় আমি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। নার্ভাস হওয়ার কারণ আছে। ওই যে বলেছি সিনেমার শুটিংয়ের সঙ্গে একদমই পরিচিত ছিলাম না। ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম বিশাল আয়োজন। এত মানুষ দেখে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপরও ভাল-মন্দ মিলিয়ে কাজ চলছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি আমার ভালোটা দিতে পারছি না। শুটিংয়ের মাঝে একদিন তারেক ভাই আমাকে ডেকে নিলেন, ক্যাথরিনও ছিলেন।

তিনি আমাকে বললেন, তুমি যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবা তখন তুমিই রাজা। বাকি সব তোমার হুকুম মতো চলবে। যদি বলো এখন তাহলে এখনই সব হবে, না হলে না। সময় নাও, বুঝো। এরকম অনেক উপমা, সাহস, ভালোবাসা দিয়ে তিনি আমাকে তৈরি করেছেন।

খুব আন্তরিকতা দিয়ে উনি আপনার কাছ থেকে কাজটা আদায় করে নিয়েছেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম। একটা সময়ে গিয়ে আমারও ভালো লাগা শুরু হলো। মজার একটা স্মৃতি বলি, ছবির একটা দৃশ্য— আমি রিক্সায় করে যাচ্ছি। তখন পিছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা দেয়। আমি হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছিলাম। রিক্সাওলারও বাজে অবস্থা। প্রাইভেট কারের ড্রাইভার নেমে রিক্সাওলাকে উল্টো ধমকাতে শুরু করে। আমি এর প্রতিবাদ করলে সে লোক আমাকেসহ মারা শুরু করে।

এ দৃশ্যটা ধারণ করা হলো, অনেকটা গোপনে। আমি, রিক্সাওলা এবং প্রাইভেট কারের ড্রাইভার ছাড়া কেউ জানে না এটা অভিনয়। মারামারি সত্যি মনে করে তা ঠেকাতে লোকজন চলে আসে। এদিকে দৃশ্যটাকে প্রাণবন্ত করতে আমরা সত্যি সত্যি মারামারি করেছি। লোকজনও আমাদের মেরেছে। দৃশ্যটা শেষ হলে ইউনিটের সবাই ছুটে আসলো। তারেক ভাই, ক্যাথরিন ওনারা আসলেন। দুজনেই বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার কোথাও লেগেছে কিনা? এত আন্তরিকতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দেখাতে পারলে হয়তো বোঝা যেত।

এটা তো গেল শুটিং স্মৃতি। তারেক মাসুদের সঙ্গে এরপর অনেক মিশেছেন। ছবিটা নিয়ে আপনারা বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় ঘুরেছেন। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে? যা সবাইকে জানাতে চাইবেন।

শুটিংয়ের পরেও অনেকবার তার অফিসে, বাসায় গিয়েছি। তিনি অনেক আন্তরিকতার সাথে মিশতেন। তিনি সবসময় আমার ও আমার পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। কাজ-কর্মের কী অবস্থা জানতে চাইতেন। তারেক ভাই অভিভাবকের মতো গাইডলাইন দিতেন। সবসময় মনে হতো আমি বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। এ জিনিসটা মিস করি।

তারেক মাসুদের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর কীভাবে পেলেন। ওই খারাপ সময়টা কীভাবে পার করেছেন?

যখন খবরটা পাই তখন ঢাকাতেই ছিলাম। থিয়েটারের এক বন্ধু আমাকে বললো, তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বললাম, আবার বলো। সে পুনরায় বললো। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আমি টিভি অন করে দেখলাম, স্ক্রল হচ্ছে— তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। এক চ্যানেলের নিউজ দেখে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। হয় না, কোনো কারণে চ্যানেলটায় ভুল তথ্য এসেছে। মনকে কোনভাবেই শান্ত করতে পারছিলাম না। একটা একটা করে অনেকগুলো চ্যানেল দেখলাম। প্রায় প্রতিটা চ্যানেলেই এ জিনিসটা দেখাচ্ছিল। আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না।

এরপর আমি ফোন করি আলী আহসান ভাইকে। উনি আমাদের সঙ্গে ‘রানওয়ে’-তে আরিফ চরিত্রটি করেছে। তারপর তো আমি তারেক ভাইয়ের বাসায়, স্কয়ার হাসপাতাল গেলাম। সারাদিন একধরণের যন্ত্রণার মধ্যে কাটালাম। আর এটা তো আমার জন্য খুবই দুঃখের একটা ব্যাপার। বড় ভাইকে হারালে, অভিভাবকে হারালে যে যন্ত্রণাটা লাগে—সে যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তার শূন্যতাটা সবসময় দুঃখ দেয় আমাকে।

অনেকে যখন বলে, আপনি তো ভাই ভাগ্যবান। আপনি তারেক মাসুদের সবশেষ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এটা হয়তো, অনেকের কাছে সৌভাগ্যের। কারণ এরপর কারও তারেক ভাইয়ের ছবিতে কাজ করার সুযোগ হবে না। কিন্তু আমার এ জায়গাটাতেই দুঃখ। আমি শেষ সিনেমায় কাজ করেছি, এ তকমাটা নিতে চাই না। আমি চেয়েছি তার আরও কাজ করি। তার শূন্যতা তো পূরণ হবার না। প্রতিনিয়ত আমি তাকে খুব মিস করি।

পৌনঃপুনিক, জালালের গল্প, কালো মেঘের ভেলা, ঢাকা ড্রিম, সাঁতাও— আপনার কাজের সংখ্যা এত কম হওয়ার পিছনের কারণ কি ব্যক্তিগত পছন্দ নাকি অনেক সময় যেটা হয়, আপনার সঙ্গে কেউ ওইভাবে যোগাযোগ করেন নাই।

এ ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই বটে। এটার হিসেবটা আমিও অনেক সময় সঠিকভাবে মেলাতে পারি না। আমি তো কাজের লোক, কাগজ পাগল, ভালো কাজ করতেই চাই। আমি অন্তর্মুখী মানুষ। মানুষকে হাই, হ্যালো দেওয়ার অভ্যাসটা কম। এটা একটা কারণ হতে পারে— আমি বলছি না যে এটাই কারণ। আরেকটা কারণ হতে পারে, যারা কাজ করছেন তারা হয়তো আমাকে ভাবছেন না। তারা হয়তো ভাবছেন যাদের একটু ফলোয়ার আছে তাদেরকে নিয়ে। যাদেরকে নিলে হয়তো চ্যানেলে কাজটা চলবে। প্রকৃত অর্থে হয়তো কোনো চরিত্রে আসলেই আমাকে দরকার, কিন্তু ফ্যান ফলোয়ার নানা জটিলতায় ওনারা অন্য শিল্পী নিয়ে কাজ করছেন।

টিভি নাটক বা বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন?

টিভিতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ করেছি। বিজ্ঞাপনে কাজ করেছে বেশ কিছু। রবি, বিকাশের কাজ করা হয়েছে।

সম্প্রতি ‘সাঁতাও’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবিটি নিয়ে জানতে চাই।

ছবিটির গল্প কৃষকের সংগ্রামী জীবন, নারীর মাতৃত্বের সার্বজনীন রূপ এবং সুরেলা জনগোষ্ঠির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় আবর্তিত হয়েছে। এতে একজন প্রান্তিক কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করেছি। পরিচালক খন্দকার সুমনের পরিচালনায় এর আগে স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘পৌনঃপুনিক’-এ অভিনয় করেছিলাম। সে সুবাধে তার সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক হয়। ওই সম্পর্কের সূত্র ধরে তিনি আমাকে এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ডাকেন। ছবিতে আমি কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেছি। এর জন্য আমাকে কোদাল চালানো, ক্ষেতে ফসল কাঁটা শিখতে হয়েছে, নৌকা বাইচে অংশ নিতে হয়েছে। আমরা শুটিং করেছি রংপুর, লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পাড়ে।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

অভিনয় করে যাওয়া। ভালো ভালো ছবিতে অভিনয় করা।

সারাবাংলা/এজেডএস

তারেক মাসুদ ফজলুল হক রানওয়ে সাঁতাও


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর