Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সঙ্গীতের মহাসমুদ্রে বালির দেখাও পাইনি: কুমার বিশ্বজিৎ

আশীষ সেনগুপ্ত
১ জুন ২০২২ ১৪:৩২

দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। সংগীত নিয়েই যার ধ্যান-জ্ঞান। গলা সেধেছেন সংগীতের সব ঘরানার সুরেই। অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে এখনও শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরসবুজ হয়ে আছেন তিনি। আজ (১ জুন) এই সঙ্গীতশিল্পীর জন্মদিন।

১৯৬৩ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। তার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। বাংলা আধুনিক কিংবা চলচ্চিত্রের গানে দীর্ঘ চার দশক ধরে কণ্ঠ দিচ্ছেন তিনি। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেছেন। এখনও নিয়মিত গান গেয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার সংগীত জীবনের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছিলেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপনডেন্ট আশীষ সেনগুপ্ত-এর সাথে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। আজ শিল্পীর জন্মদিনে সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ সারাবাংলার পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো—

  • যাত্রা শুরু সেই ’৮২ তে—

না! ’৮২ তে আমাকে চেনা শুরু। সত্যিকার অর্থে ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেটা ছিল শরণার্থী শিবিরে আমার গান গাওয়া। আর সেজন্য আমি ৫ টাকা করে পারিশ্রমিকও পেতাম। শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। আমি ফেনী সাবরুম বর্ডারে তিবরা বাজার অংশে ছিলাম। সেখানে আমার প্রথম গান গেয়ে আয়। সেটা একাত্তরের যুদ্ধের সময়।

তারপরে আমি প্রথম ব্যান্ড’র হয়ে গান গাওয়া শুরু করলাম ১৯৭৭-এ। ‘রিদম ৭৭’। সেটাই আমার প্রথম ব্যান্ডদল। তখন তো কর্পোরেট শো বলে কিছু ছিল না, চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিয়ে বাড়িতে গায়ে হলুদে গান গাইতাম। তারপর আমি টেলিভিশনে বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম। তার একটা ছিল একটা গোষ্ঠীভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘বর্ণালি’। নওয়াজেশ আলি খানের প্রযোজনায়। তারপরে যুবমেলায় ১৯৮০ সালের দিকে। তখন থেকেই চেনাটা একটু একটু করে শুরু হচ্ছিল। ‘শিউলিমালা’ নামে একটা অনুষ্ঠান করলাম ১৯৮২’র প্রথম দিকে। সেখানেই গাইলাম ‘তোরে পুতুলের মতো করে’। আর সেই আমাকে চেনা শুরু।

  • ১৯৮২ থেকে আজ অবধি—

আমি মনে করি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এতোটা বছর কোন বিষয় না। কারণ আমি এখন বুঝতে পেরেছি, আমার মধ্যে একটু পরিপক্বতা এসেছে। সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন হওয়া উচিত দুই জীবনের মতো। একটা মানুষের গড় আয়ু যদি ৬০ বা ৬৫ হয়ে থাকে, বা ৫০’র উপরে হয়ে থাকে। একটা জীবনে শৈশব চলে যায় না জেনে। কৈশোর আসে নানা রকমের স্বপ্ন নিয়ে, তারুণ্য আসে, বৈবাহিক জীবন আসে, নিজেকে গোছাতে গোছাতে সময় এমনিই চলে যায়। সৃষ্টির জন্য যে সময়টা দরকার, আমার মনে হয় একটি মানুষের দুইটা জীবনও যথেষ্ট নয়। যাহোক আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, আমার কাছে মনে হয় এখনো সঙ্গীত যদি মহাসমুদ্র হয়ে থাকে, সেখানে আমি বালিরও দেখা পাইনি।

  • তাহলে টার্নিং পয়েন্ট ওই- তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে—

হ্যাঁ, ওই গানটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট। বলা যায় ওই গানটা দিয়েই আমার জনপ্রিয়তা আসে। সাথে সাথে আমার পরিচিতিটা অনেক বেড়ে যায়। সেই বছরই আমি চলচ্চিত্রেও গান করি আলাউদ্দিন আলীর সুরে ইন্সপেক্টর ছবিতে। পাকিস্তানি গায়ক আলমগীরের সাথে। মজার ব্যাপার হলো একই বছর (৮২তে) আমার অ্যালবামও বের হয়। তাই ১৯৮২ সালটাকে আমি আমার মাইলস্টোন ইয়ার বলবো। আমার কাছে স্মরণীয় একটা বছর। এই সালেই টেলিভিশনে পরিচিত হওয়া, চলচ্চিত্রে গান গাওয়া, আবার অ্যালবামও বের হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তাই ওই বছরটা আমার কাছে বেশ উল্লেখযোগ্য একটা বছর।

  • শ্রোতাদের প্রত্যাশা পূরণ… কতটুকু?

প্রত্যাশার জায়গাটা কতদূর পূরণ করতে পেরেছি জানি না। আমার চেষ্টা অবিরত ছিল, আছে। আমার একটা বড় প্রাপ্তি অনেক বেশি আড়ষ্টও করেছে আমাকে, সেটা হচ্ছে আমার শ্রোতাদের কোনো বয়সসীমা নেই। বলা যায় ৯ থেকে ৯০ বছর বয়সের। তাদের তৃপ্ত করা, এ ব্যাপারটার জন্য আমাকে খুব সচেতনভাবে কাজ করতে হয়েছে। এখনো যেহেতু কাজ করছি, আমি জানি না কিছুটা হলেও পরিতৃপ্ত করতে পেরেছি কি না। যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তাদের তো আর অনলাইনে গিয়ে গান শোনার অভ্যাসটা নেই। টেকনিক্যাল সাইডেও তারা অতটা অভিজ্ঞ নয়। আমার মা-ই বলছিলেন, তোর কি অ্য়ালবাম বের হয় না? (একরাশ হাসি) আমি বললাম, কেন? বললেন, দেখি নাতো। তুই কি এখন আর গান গাস না? বললাম এখন এগুলো অনলাইনে হয়, ইউটিউবে হয়। অবাক হয়ে বললেন ইউটিউব কী? স্বাভাবিকভাবেই উনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। বললেন, আমি অতকিছু জানি না, আমাকে একটা টেপ-রেকর্ডার এনে দিস, আমি ইচ্ছামতো গান শুনবো। এই ধরনের কিছু শ্রোতা আমার সৃষ্টির থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। যারা মাঝবয়সী তারা কর্মব্যস্ত, তারা অনলাইনে গিয়ে গান শোনেন কি না আমি জানি না। অনলাইনে শুধু একটা নির্দিষ্ট বয়স-ই শ্রোতা আছে। তাই বলা যায় একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রোতা আমার কমে গেছে। যাই হোক আমি প্রত্যাশা পূরণের কতদূর পেরেছি জানি না। চেষ্টা করেছি পূরণের। যদি না পেরে থাকি তাহলে সেটার দায়ভার বা ব্যর্থতা আমি মেনে নেবো, মেনে নিচ্ছি।

  • প্লে-ব্যাকে সম্পৃক্ততা—

চলচ্চিত্রে একটা রেওয়াজ আছে, বিভিন্ন টাইপের গান। আচ্ছা, এই গানটা তো উনি ভালো গেয়েছিলেন। সেই স্টাইলের গানই আমাকে দিয়ে গাওয়ানো শুরু হয়ে গেলো। যেটার মধ্যে চটকদার কিছু কথা, শুধুমাত্র বিনোদনের বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কাব্য বা সাহিত্য একটু কম। বলা যায় রসালো গান। আমি সবারই কাজ করলাম। সেই ৮২ থেকে। সুবলদা, আলম ভাই, বুলবুল ভাই, শেখ সাদি খান সবার সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। অহরহ কাজ করে যাচ্ছি। চলচ্চিত্রে প্রায় ৪০০-৫০০ গান হয়ে গেলো। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম যখন কোনো অনুষ্ঠানে গান করি সেখানে কোনো শ্রোতাই চলচ্চিত্রের গানের জন্য অনুরোধ করেনা। তখন আমি আবার আমার আগের জায়গায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এইখানে স্বাধীনতা আছে। ইচ্ছামতো বা পছন্দমতো কাজ করতে থাকলাম। যার ফলে আমার অ্যালবামের গান চলচ্চিত্রকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে আমি বরাবরই মনে করি যে, চলচ্চিত্রে গান করে আমার একটা লাভ হয়েছে। আমি প্রচুর নতুন কিছু শিখতে পেরেছি, কিভাবে ভয়েস থ্রো করতে হয়, এক্সপ্রেশান দিতে হয়, অর্থাৎ কথার সাথে অভিনয়টাও করা- এই বিষয়গুলো শেখার একটা সুযোগ হয়েছিল। যেমন একেকজন মিউজিক ডিরেক্টরের মানে একেক ধরনের টেস্ট। তাদের শেখানোর ব্যাপারটাও ভিন্ন। কোন কথার সাথে কোন অভিব্যক্তি দিতে হবে, এই বিষয়গুলো আমার খুবই কাজে লেগেছে। কিন্তু তারপরও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে আমার অ্যালবামের গান অনেক বেশি জনপ্রিয়।

  • গানের বাণীতে পরিশীলিত ব্যবহার—

অনেকে জানতে চান, আমি খুব বেশি বিরহের গান পছন্দ করি কেন? মান্না দের একটি গানের কথা মনে পড়ছে, এই জীবনের বেশিটাই দুঃখ। আমি মনে করি একজন সঙ্গীতশিল্পী একটি জনগোষ্ঠীর পছন্দের প্রতিনিধি। তাই একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষের ব্যথার বিষয়গুলো আমি উপস্থাপন করি। আর সঙ্গীত মানে একটা আর্ট। এটা একটা শিল্প। আমি কখনোই মনে করিনা সঙ্গীত বিনোদনের একটা মাধ্যম। বিনোদন থাকবে, তবে সেটার মধ্যেও একটা পরিশীলিত বিষয় থাকবে। অনেক বেশি কাব্য, অনেক সাহিত্য। একটা দেশের মান বিচার করা হয় তার নিজস্ব সংস্কৃতি দিয়ে। এই জাতিটা কতটুকু উন্নত, কতটুকু পরিশীলিত, মানসম্পন্ন সেটা বিচার করা হচ্ছে সংস্কৃতি দিয়ে। আমি হয়তো একটা লোকের সাথে মিশছি, তাকে দিয়ে একটা জাতি বিচার করা যায় না। তার শিল্প-সংস্কৃতি দিয়ে জানা যায় তারা কতটা উন্নত। তো এই দায়িত্ববোধটা আমার মধ্যে আছে। আর আমাদের বেড়ে ওঠাটা যাদের গান শুনে, সেই শিক্ষাটা একটু অন্যরকম ছিল। আমরা যখন বড় হয়েছি, তখন আমাদের গান শোনার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও এবং পূজা সংখ্যার গান। তখন ছিল হেমন্ত, মান্না দে, কিশোর কুমার, লতা মুঙ্গেশকার, সলিল চৌধুরী বা শ্যামল মিত্রের গান। এদের গানগুলোর পেছনে যারা কাজ করতেন, তারা ছিলেন সঙ্গীতের একেকজন মহারথী। যেমন পুলক বন্দোপাধ্যায়, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার বা সলিল চৌধুরী তাদের যে কথা বা বাণী। তার কাছাকাছি যাওয়া তো সম্ভব না। তবু চেষ্টা করেছি সেই আঙ্গিকে বা মানসম্পন্ন কিছু দিতে। কতটুকু পেরেছি জানি না, তবে আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, আমি কখনোই গা ভাসাইনি। সেটা কথার ক্ষেত্রে হোক, সুরের ক্ষেত্রে হোক।

  • প্রজন্ম – সেই সময়-এই সময়—

আমার কাছে মনে হয় যে আগের বিষয়গুলো ছিল ফিজিক্যালি কানেক্টেড। যেমন কেউ যদি জন্মদিনে ফেসবুকে ফুল এঁকে দেয়, আর যদি একটা ফুল আমার বাসায় পাঠায়, তার প্রথমটা বায়বীয় আর দ্বিতীয়টা আমার ফিজিক্যালি পাওয়া। আমি জানি না এই দুটোর মধ্যে কোন তুলনা হয় কি? একটা অ্যালবাম আসবে এই বছর, সেটা দোকানে গিয়ে লাইন ধরে কেনা। গানগুলো বারবার করে বাসায় শোনা, অ্যালবামের মোড়কটা দেখা, এই অনুভুতি গুলো এখন আর নেই। আমরা অনেক বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক বা পারিপার্শিক অবস্থার জন্য জীবন যুদ্ধে এত বেশি ব্যস্ত যে সময়ের স্বল্পতার জন্যই এসব করা হচ্ছে। এটাই হয়তো সত্যি। দিন দিন আমাদের আবেগগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বলতে ইচ্ছা করছে যে, একটা সময় ছিল একটা গ্রামে সবাই সবাইকে চিনতো। সেটা ২ মাইল হোক বা ১০ মাইল দূরে হোক। আর এখন একই বিল্ডিং-এ থাকি কিন্তু কেউ কাউকে চিনি না। হয়তো লিফটে দেখা হয়। কেউ কারো সাথে কথা বলি না। পৃথিবীটা সংকুচিত হতে হতে একেবারে চার দেয়ালের মধ্যে চলে আসছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিগুলো হয়ে গেছে খুবই সীমিত, যেমন ল্যাপটপ, ট্যাব অথবা টেলিফোন স্ক্রিন। সংকুচিত। মাথাটাও সবসময় নীচে। সারাক্ষণ দৃষ্টি থাকে নীচে। আমি বলবো সত্যিকার অর্থে পৃথিবীকে জানতে হলে মানুষের সাথে হৃদ্যতা রাখতে হবে। আগে যে আমরা একান্নবর্তী পরিবারে ছিলাম, সেখানে অনেক বেশি শিক্ষণীয় ছিল। নিরাপত্তা ছিল। অনেক আদর্শিক ছিল। আর এখন যা হচ্ছে আমি জানি না সেটা কি আধুনিকতা না কি অন্য সংস্কৃতির ভর। এ প্রজন্মকে যদি বলতে তাহলে বলবো, দৃষ্টিটা একটু প্রসারিত করতে হবে, মাথাটা উপরে তুলতে হবে।

  • সঙ্গীত পরিচালনা—

আমার সঙ্গীত পরিচালনাটা মূলত সৌখিনতারই ব্যাপার ছিল। আমার প্রতিটা অ্যালবামের ২/৩ টা কাজ আমি নিজেই করেছি। আবার অর্ধেকটা বা পুরো অ্যালবামও করেছি। আমার খুব ইচ্ছা করে যে নতুন কিছু করি যেটা মাথার মধ্যে ঘোরে। কিন্তু সে কাজ করার মতো মিউজিশিয়ান আমাদের এখানে খুবই কম। যেসব রিয়েলিটি শো হচ্ছে, সেখান থেকে প্রচুর সঙ্গীত শিল্পী বেরিয়েছে। কিন্তু মিউজিশিয়ান বের করার জন্য সেরকম কোন প্ল্যাটফর্ম আমরা তৈরি করতে পারিনি। যা কিছু হয়েছে সেটা ব্যান্ডের থেকে সার্চ করে, ওয়েস্টার্ন বিশেষ করে বেজ গিটারিস্ট, ড্রামার বা গিটারিস্ট পেয়েছি। কিন্তু সেই ধরনের এথনিক বা আদি, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল ঘরানার মিউজিশিয়ানের বড়ই অভাব। যেগুলো আমার মাথায় ঘোরে, সেই কাজ গুলো কি-বোর্ড দিয়ে করতে ইচ্ছা করে না। বড় কিছু করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু করার সুযোগ নেই বলেই সঙ্গীত পরিচালনাটা সেভাবে করা হয়ে উঠছে না। দুএকটা অর্ডারি কাজ যেগুলো করছি, তাতে তৃপ্ত নই আমি।

  • বর্তমানে অনলাইনে প্রকাশিত গানের সামগ্রিক অবস্থা—

আমাদের দেশের অনলাইনে যে গানগুলো ভিউয়ার্সের চরম পর্যায়ে, খুব কম গান আছে শোনার মতো, অধিকাংশ গানই হালকা বিনোদনের বিষয়। ত্রিশ লক্ষ লোকের আত্মাহুতি, শুধু মাত্র একটা ভূখণ্ড, একটি পতাকা, একটি ভাষা, এর পাশাপাশি সংস্কৃতিও একটি বিষয়। এটাকে অবমাননা করা ঠিক নয়। দুঃখ হয় যে অনেক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ব্যক্তিকেও দেখেছি শুধু মাত্র অর্থের জন্য, পরিচিতির জন্য, এত দায়িত্বহীন কাজ করেছে। আমরা যে কাজ করেছিলাম ৮০’র দশকে, আমার জীবনের প্রথম অ্যালবাম- ‘তোর রিনিঝিনি কাঁকনের শব্দ নির্ঘুম স্বপ্নে বাজেরে, আর নন্দিত বাঁধনের শিহরণ দু চোখের জানালায় জাগেরে’। সেখানে অনেক বেশি কাব্য ছিল। এটা একটা কবিতা। সেই কবিতাকে আমরা গান করেছিলাম। অনেকে বলে ৮০’র দশক ৯০’র দশক ছিল সৃষ্টির সবচেয়ে সোনালি সময়। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হচ্ছে একটা অংশ থেকে কপি একটা অংশে পেস্ট। সেটা অর্কেস্ট্রা বা কম্পোজিশান সব ক্ষেত্রেই। এমনকি গানের বাণীর ক্ষেত্রেও। আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি, আমার গান যা গেয়েছি, পরেরটা তার চাইতে ব্যতিক্রম। যে গান সৃষ্টি হয়েছে পুর্বে, যার আদলে আমি এই গানটা সৃষ্টি করেছি, তার চাইতে আলাদা। এ ব্যাপারগুলো আমরা আগেই ভাবতাম, তারপরে সৃষ্টিতে নামতাম। আমি বলবো নতুন প্রজন্মকে তার অস্তিত্বের জন্য, শিকড়ের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সংস্কৃতিকে অনেক বেশি লালন করতে হবে। সৃষ্টির পেছনে সময় দিতে হবে।

  • বেড়ে ওঠার গল্প—

আমার বাড়ি আসলে যে জায়গায়, সেটা প্রাকৃতিক দিক থেকেও অনেক সাংগীতিক। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, পাহাড়ি এলাকা। সেখানে যেমন পাহাড়, সমুদ্র, পরিবেশটাও তাই। ঠাকুর ঘরে পূজা হচ্ছে। ঠাকুরমা গান গাচ্ছেন। বাসায় মহিলারা সবাই গান করতেন। তাদের জন্য গানের শিক্ষক আসতো। প্রায়দিন বাড়িতে কীর্ত্তনীয়ারা আসতেন। আবার কোনকোন দিন পাহাড় থেকে বৈরাগী-বৈরাগীনীরা আসতেন। এসব দেখতে দেখতে রন্ধ্রে কখন যে গান ঢুকে গেলো জানিইনা। বাড়িতে পূজা সংখ্যার রেকর্ডগুলো আনা হতো। সেসব শুনতাম, আস্তে আস্তে সব রক্তে মজ্জায় ঢুকতে থাকলো। একসময় বোনকে শেখাতে গানের শিক্ষক আসতেন। তখন আমি এতোটাই ছোট ছিলাম যে, আমাকে শেখানো হোতোনা। কিন্তু আমি কি শেখানো হচ্ছে খেয়াল করতাম। শিক্ষক চলে আমি সেগুলো গেয়ে শোনাতাম। তখন আমার দাদু খেয়াল করলেন যে, আমি গান না শিখেও গেয়ে শোনাতে পারি। তারমানে আমার আগ্রহ আছে। তখন আমাকেও গানের ক্লাসে সংযুক্ত করা হলো। তখন যে সব শিক্ষকরা ছিলেন, তারা ১০/১২টা গান শেখাতে শেখাতেই ৩/৪ বছর কাটিয়ে দিতেন। আমার আবার অত ধৈর্য ছিলোনা। আমি দিনেই ৫টা গান তুলে ফেলতাম। আমার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা হচ্ছে আমি যে কোন কিছু খুব দ্রুত ধরতে পারি, যেটা পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে বা পেশাগত ক্ষেত্রে খুবই কাজে আসছে। তো মজার বিষয় হচ্ছে, এরমধ্যে আমাদের গানের শিক্ষক আসা বন্ধ করে দিলেন। দাদু চিন্তায় পড়লেন গানের শিক্ষক আসেন না কেন। যোগাযোগ করা হলে শিক্ষক তাঁকে বললেন, আপনার নাতিকে শেখাতে হলে আমার আরো অনেক গান শিখতে হবে। সেইখান থেকে শুরু। এরপর চট্টগ্রাম শহরে আসলাম। নিয়মিত গান শেখা শুরু। কলেজে যখন গেলাম, তখন রেডিও-তে নবাঙ্কুর নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। সেখানে গান গাওয়া শুরু। তখন চট্টগ্রাম বেতারের দায়িত্বে ছিলেন তাহের সাহেব। উনি আমাকে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাইতে দেখে বললেন, তুমি রেডিওতে আসো। আমি বললাম, আমার পক্ষে গতানুগতিক অডিশন দেওয়া সম্ভব না। উনি বললেন অডিশন দিতে হবে না, তুমি আজ থেকেই রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী। রেডিওর মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তাই। তোরে পুতুলের মতো করে… গানটা জনপ্রিয় হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন নিজদায়িত্বে আমাকে তালিকাভুক্ত করে নিয়েছিল।

  • যে গানটা আপনাকে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ করে তোলে—

আসলে আলাদা করে কোনও গান বের করা কঠিন। রেকর্ডিং’র পরে গানগুলো আমার আর শুনতে ইচ্ছা করে না। কারণ শোনার পর মনে হয় এই জায়গাটা আরেকটু অন্যরকম করা যেতো। বা আরেকবার রেকর্ডিং করলে ভালো হতো। দেখা যায় আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চাইতে ঐ গবেষণায় বেশি ব্যস্ত থাকি। একটা গানের কথা বা সুর বা গায়কি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবো, তার চেয়ে পারফেকশান বেশি খুঁজি। যার ফলে এখনো পর্যন্ত জানি না, যদি ঐ সময়টা কখনো আসে, তাহলে হয়তো গানটাকে গান হিসাবে শুনে বাছাই করতে পারবো। কোনটা কতটুকু পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ মুহূর্তে একটা গানের কথা বলা যায়, যেটা সবমিলিয়ে আমার পরিপূর্ণ মনে হয়েছে। ‘কোন কোন রাত খুব বড় মনে হয়’। ডা. গোলাম মোস্তফার লেখা, আমার সুরে, সবাই মিলে কাজটা করেছিলাম। অসাধারণ একটা কম্পোজিশান ছিল। এর জন্য মানাম ভাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই। ‘একা মন একা ঘরে, আঁধারের অভিসারে একা একা শুধু কথা কয়…’

  • শেষের কথা—

আমরা শিল্পের যদি বিভিন্ন শাখা ধরি, যেখানে নাটক, নৃত্য, সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, তারমধ্যে সঙ্গীত হচ্ছে অনেক পাওয়ারফুল একটা মাধ্যম। একটা নাটক কিন্তু দেখতে হয়। আর সঙ্গীত না দেখেও অনুভব করা যায়, উপলব্ধি করা যায়। ৫২’র আন্দোলন থেকে ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সঙ্গীত সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্যারালাইসড রোগীকে সঙ্গীত দিয়ে সুস্থ করে তোলা হচ্ছে। সঙ্গীত এতো বেশি পাওয়ারফুল, একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিকেও যদি জিজ্ঞেষ করা হয়, কি নেবে তুমি? যদি সে সঙ্গীতপ্রেমী হয়, সে হয়তো একটা গান শুনতে শুনতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। সঙ্গীত অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি জাগ্রত করে। অনেক বেশি দেশপ্রেম, অনুভব ও উপলব্ধির বিষয়। আমি মনে করি শিল্পের সব চাইতে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গীত।

সারাবাংলা/এএসজি

কুমার বিশ্বজিৎ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর