Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নৈতিক অবক্ষয় থেকে উত্তোলনে দরকার মানসম্মত চলচ্চিত্র

জাফর হোসেন জাকির
২৪ জুন ২০২২ ১৯:৫৬

মানবসভ্যতার এক বিস্ময়কর আবিষ্কার চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র শিল্প যে কোনো দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সুস্থধারার শিল্পগুণসমৃদ্ধ ও মানসম্মত চলচ্চিত্র যেমন দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে ভূমিকা রাখে তেমনি দেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে। রুচিশীল সুস্থ জীবন-পরিবেশ সৃষ্টিতে, মানুষের সৎ ও সুশীল চরিত্র গঠনে, সমাজ জীবনে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চলচ্চিত্র যে শুধুই বিনোদন মাধ্যম তা নয়। যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে আনতে, চরিত্র গঠনে চলচ্চিত্র রাখে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রদায়গত বিভেদ, গোষ্ঠীগত হানাহানির ঊর্ধ্বে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন রচনায়ও চলচ্চিত্র প্রণোদনার উৎস। কিন্তু বর্তমানে আমরা কি দেখছি! আমরা দেখছি বাংলাদেশের বেশির ভাগ চলচ্চিত্র পরিণত হয়েছে বিকৃত রুচি-আশ্রিত পণ্যে। পরিভোগপ্রবন পুঁজিবাদী সভ্যতা ও বিভিন্ন দেশের লুটেরা ধনিকরা চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে লালন করছে বিকৃত রুচি, স্থূল যৌনাচার, উৎকট দেহপ্রদর্শন অশালীন বেশভূষা, লোমহর্ষক ঘটনাময় অপরাধ কাহিনী। অর্থ, অস্ত্র, নৈরাজ্য, যৌনতা ও হিংস্রতাকে পুঁজি করে তারা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে সংগ্রামী, দেশব্রতী চেতনা থেকে সরিয়ে পরিভোগপ্রবণ ক্রীড়নক করে তুলছে। আমাদের দেশও এই প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে নেই।

বিজ্ঞাপন

সাদাকালো বাংলা সিনেমার যুগকে বলা হয় রুপালি পর্দার সোনালি দিন। রঙিন বাংলা সিনেমার যুগকে অর্থাৎ নব্বই দশক এবং তার আগের দশকে বলা হয় বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ। ৯০ দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে বারো শতের কমবেশি। এক অনলাইন প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, ২০১৫ সালে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৩২২টি। মাঝখানে দেড় দশকে ৯শতের অধিক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ কি? কারণ রুচিশীল সুস্থ, মহৎ ব্যক্তিদের জীবন কাহিনী, বিজ্ঞানমনষ্ক, মানসম্মত সিনেমার বিপরীতে অশ্লীল ও অশালীন সিনেমা নির্মাণের প্রাদুর্ভাব মহামারি আকার ধারণ করে। ফলে সিনেমাপ্রেমিক মানুষেরা হল বিমুখ হতে থাকে। আগে মানুষ তার সপরিবারে হলে যেতো সিনেমা দেখার জন্য। বিনোদন নেওয়ার পাশাপাশি অনেক তথ্য আর জ্ঞান সমন্বয়ে হল থেকে বেড় হতো। কিন্তু চলচ্চিত্রে অশ্লীল ও অশালীন যুক্ত হওয়ায় মানুষ স্বজনদের সাথে সিনেমা দেখতে বসে অস্বস্তিতে ভুগেন,পড়ে যান মান সম্মানের টানাপোড়নে। কিশোর বেলায় বড়দের মুখে শুনতাম, যারা হলে ছবি দেখতে যান তারা ভালো মানুষ না। কারণ হলে নাকি আজকাল(কৈশোর কালে) অশ্লীল নোংরা ছবি দেখানো হয়। একদিন বাড়িতে না বলে লুকিয়ে পাশের বাড়ির সমবয়সী ভাইয়ের সাথে হলে সিনেমা দেখতে যাই। এলাকার কেউ দেখলো না কি সেই ভয় মনে পুষিয়ে টিকিট কেটে হলের ভেতরে ঢুকে বসে পড়লাম। সিনেমার নাম ‘ভয়াবহ’। বিরতির সময় পর্দায় ভেসে উঠলো অশ্লীল ভিডিও। কিছু বুঝতে না পেরে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এসব কি আসলো! উনি বললেন, বিরতি চলছে বিরতি! সেদিন সিনেমার হল থেকে বেড় হয়েছি আজ অব্দি দ্বিতীয়বার কোনো সিনেমা হলে প্রবেশ করিনি।

২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সময় নিউজের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, চলতি বছরে দেশে সচল সিনেমা হলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬২টি! দেশে ২৫টি জেলায় এখন আর কোনও সিনেমা হল নেই। যেগুলো আছে সেগুলো আজ আইসিইউতে। জাতীয় সংকট মোকাবেলায়, জাতীয় চেতনার সম্প্রসারণে ও জাতীয় জাগরণ সৃষ্টিতেও চলচ্চিত্র হতে পারে বলিষ্ঠ মাধ্যম।

আমরা দেখেছি সোভিয়েত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের ক্ষেত্রে জাতীয় উদ্দীপনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের অসাধারণ ভূমিকা উপলব্ধি করেই কমরেড লেলিন বলেছিলেন, ‘To us cinema is the most important of all arts.’ কালের বিবর্তনে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে দুনিয়ার খবরদারি করা যায়; চাইলেই দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশি সংস্কৃতি উপভোগ করা যায়। ভালো মনের মানুষ হওয়ার জন্য, নিজেকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যেমন নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে জানা প্রয়োজন ঠিক তেমনি অন্য জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জানা প্রয়োজন। জানার জন্য কিংবা বিনোদন নেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রবেশ করলেই বিভিন্ন অশ্লীল ও অশালীন ছবি কিংবা ভিডিও প্রায় ভাসতে থাকে। ফলে প্রথমেই অপসংস্কৃতির মধ্যে নিমজ্জিত করতে উৎসাহ প্রদান করে। দিনরাত্রি ভরে অশ্লীল ছবি আর ভিডিও দেখে যুবসমাজ দিনে দিনে যৌনতায় আসক্ত হয়ে জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধের খবর প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দেশে ৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত ছাত্রছাত্রীদের টেনে তুলতে হলে দরকার পাঠ্যবই-নির্ভর শিক্ষার পাশাপাশি তথ্যমূলক চলচ্চিত্র প্রদশর্ন করা। জীবনী ও বাস্তব ঘটনাভিত্তিক কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্য চিত্র, তথ্যচিত্র প্রভৃতির মাধ্যমে পরিপূরক শিক্ষা দেওয়া। ফলে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে। শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক, বিজ্ঞানমনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেগুলো খুবই সহায়ক হবে।

চলচ্চিত্রের দায়িত্ব কি দর্শককে শুধুই বিনোদন যোগানো? কাহিনীতে বিনোদনের প্রাধান্য না থাকলে কি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতি দর্শকের কোন আগ্রহ তৈরি হয় না? উত্তর সচেতন মানুষের অজানা নয় নিশ্চয়ই! বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরিচালকরা খ্যাতি অর্জন করেছেন তারা চলচ্চিত্রকে মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে চটক আর চাকচিক্য-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। বরং তারা এমন ছবির গতানুগতিক সূত্র প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ছবি প্রকাশ করেছেন সমাজসচেতন বক্তব্য এবং তাদের ছবির নির্মাণশৈলী হয়ে উঠেছে প্রথাবিরোধী, কুসংস্কার মুক্ত, বিজ্ঞানমনষ্ক ও নান্দনিক। ছাত্র তথা যুবসমাজ থেকে শুরু করে নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত সকলকে উত্তোলনের জন্য আমাদের দেশের পরিচালকদেরও স্থূল রুচি লালন না করে, অনাবিল আনন্দ দানের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও জাতিগঠনমূলক উপাদান যোজন করে মানসম্মত শিল্পকর্মের পর্যায়ে নির্মিত করে এদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ধারা তৈরি করে অন্ধ কুসংস্কার, মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা, বিজ্ঞান-বিমুখ মনোজড়তায় অনড় সমাজ পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

লেখক: কলাম লেখক

সারাবাংলা/এজেডএস

চলচ্চিত্র জাফর হোসেন জাকির নৈতিক অবক্ষয়

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর