‘পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছে ছিল, পারিশ্রমিক নিয়ে চিন্তা করি নাই’
১০ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৩০
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২ এ ‘শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক’ বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন হিমাদ্রি বড়ুয়া। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফ্লোর এবং সেট বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ‘রোহিঙ্গা’ ছবির জন্য তার এ পুরস্কার নিয়ে নানা ধরণের সমালোচনা হচ্ছেন। অকপটে সারাবাংলার সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আহমেদ জামান শিমুলের কাছে সকল সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।
শিল্প নির্দেশনার শুরুটা যেভাবে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে নাট্যকলায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি ১৯৯৭ সালে। ছাত্র অবস্থায় আমি থিয়েটার করতাম। এরপর ২০০৪ সালে এখানে (বিএফডিসি) ফ্লোর অ্যান্ড সেট ইনচার্জ হিসেবে চাকরিতে যোগ দিই। তারপর থেকে প্রচুর নাটক ও বিজ্ঞাপনের শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছি।
রোহিঙ্গা ছবির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
আমি যখন বিজ্ঞাপনে কাজ করতাম তখন অনেকেই বলতাম আমি সিনেমাই শিল্প নির্দেশনা দিতে চাই। কোনো সুযোগ আসলে আমাকে জানানোর জন্য। আমার পরিচিত বড় ভাই অঞ্জন বণিকের কাছে সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড ‘রোহিঙ্গা’ ছবিটির জন্য শিল্প নির্দেশক খোঁজ করেছিলেন। তখন অঞ্জন ভাই আমাকে কাজটি করার প্রস্তাব দেন। আমি আগ্রহ প্রকাশ করি। ডায়মন্ড ভাইয়ের সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিল। তবে অঞ্জন ভাই এবার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শিল্প নির্দেশক হিসেবে। এ জন্য আমি অঞ্জন ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। ডায়মন্ড ভাইয়ের বাসায়, সিনেমাটোগ্রাফার মজনু ভাইসহ বসে ওনার গল্পটা শুনলাম। এভাবে আমি কাজটার সঙ্গে যুক্ত হলাম।
ছবির শুটিং কোথায় কোথায় করলেন?
অনেক জায়গায় করেছি। মহেশখালীর ওইদিকে একটা চরের মধ্যে শুটিং করেছিলাম। ইউনিটের সবাই জায়গাটা পছন্দ করেছিল। ওখানে ৪-৫টা সেট বানিয়ে আমরা শুটিং করেছিলাম। ওখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এছাড়া এফডিসিতে দুটা, গাজীপুরে শুটিং করেছি। কক্সবাজারের নাজিরটেকে ১৯ দিন শুটিং করেছিলাম।
পুরস্কারপ্রাপ্তির মুহূর্তের অনুভূতি কেমন ছিল?
কোন একটা পুরস্কার পাওয়ার পর মানুষ যেরকম তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না─ আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন হয়েছে। এটা আসলে অনুভূতিটা অনুধাবন করার বিষয়।
কাজটা করার সময় কি মনে হয়েছিল পুরস্কার পাবেন?
অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড একজন ভাল পরিচালক। ওনার আগের কাজগুলো ভালো হয়েছে। উনি খুব ধরে ধরে কাজ করেন, শ্রম দেন কাজের পিছনে, অনেক সময় দেন। ওনার ছবিগুলো একাধিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে─ যেমন, ‘নাচোলের রানী’। ওনার ‘গঙ্গযাত্রা’-য় আমার সহকর্মী ছিলেন কলমতর, শিল্প নির্দেশনায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। আমারও মনে পুরস্কার পাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, পারিশ্রমিক নিয়ে চিন্তা করি নাই। কারণ ওনার ছবিতে আমার সিনিয়ররা কাজ করে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
এফডিসির একজন কর্মকর্তা হিসেবে কিভাবে আপনারা একটি ছবির শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন? এর প্রক্রিয়া কী?
‘রোহিঙ্গা’ ছবিতে আমি যখন যুক্ত হয় তখন ডায়মন্ড ভাই মনে হয় নায়িকা নিয়ে ২-৩ দিনের প্রি-শুট করে ফেলেছেন। এরপর মূল শুট শুরুর সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন আমি তাকে নিয়মটা বলি। নিয়ম অনুযায়ী, আমরা এফডিসির নিয়োগপ্রাপ্ত শিল্প নির্দেশক। কেউ যখন এফডিসিতে শুটিং করে তখন শিল্প নির্দেশক হিসেবে আমরা যারা এখানে চাকরি তাদেরকে যে কাউকে ওই ছবির জন্য এনলিস্টেট করতে হয়। ডায়মন্ড ভাই তার ছবির জন্য আমাকে এফডিসিতে ১৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে এনলিস্টেড করে। আমার সিনিয়র কলমতর ও আবদুস সামাদ ভাইয়ের মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা কিন্তু এফডিসির কর্মকর্তা ছিলেন। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ছবির এনলিস্টেড শিল্প নির্দেশক হতেন। শুধু শিল্প নির্দেশকরা না, এফডিসির ক্যামেরা থেকে শুরু করে এখানকার যে কোন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যে কোনো ছবির জন্য এফডিসিতে এনলিস্টেড করলে ওই ছবির শুটিং তারিখে তিনি ‘অন ডিউটিতে’ থাকেন। আলাদা ছুটির কোনো ব্যাপার থাকে না।
এর জন্য কি আপনারা আলাদা পারিশ্রমিক পান?
না, এফডিসি থেকে আমরা মাসিক বেতন পাই। ওই ছবির শুটিং যখন যেখানে থাকে আমাদেরকে নিয়ম অনুযায়ী নিজে উপস্থিত থাকতে হয়। কারণ তখন তা আমার অফিস ডিউটি। তবে এফডিসি আমাকে যে শুটিংয়ে পাঠালো এর জন্য ছবির প্রযোজক থেকে একটা ভাড়া বা পারিশ্রমিক নেয়। যা প্রতিষ্ঠানের আয়। হ্যাঁ, অনেক সময় প্রযোজকরা হয়ত আলাদা করে আমাদেরকে সম্মানী দেন। অথবা দেন না। তবে ‘রোহিঙ্গা’তে আলাদা পারিশ্রামিকের আশায় কাজ করিনি।
সিনেমাতে মাত্র শুরু করলেও শিল্প নির্দেশনার অন্য জায়গায় অনেক কাজ করা হয়েছে। সে অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে জানতে চাইবো, নিজের মতো করে কাজ করার স্বাধীনতা নাকি বাজেটের ঘাটতি কোনটি বেশি সংকট অনুভব করেছেন কাজ করতে গিয়ে?
এখানে দুটো জিনিস কাজ করেছে। একটা ছবি ভালো হতে হলে আপনাকে গ্রুপ ওয়ার্ক করতে হবে। আপনি যদি সুন্দর ভিউ সৃষ্টি না করতে পারেন তাহলে ছবিটা কিন্তু ভালো লাগবে না। আমাদের দেশে অনেকেই সেটকে গুরুত্ব দেয় না। যারাই গুরুত্ব দেয় তারাই কিন্তু পুরস্কার পায়। বিজ্ঞাপনে ভালো বাজেট থাকে বলে কাজটা ঠিকঠাক করা যায়। ছবির ক্ষেত্রে বাজেটটা অনেক সময় কম থাকে। আবার তো বললামই অনেকেই সেটকে গুরুত্বই দেয় না।
আপনি এফডিসির গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আছেন। এটি আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তিতে প্রভাব বিস্তার করেছে─ এমন সমালোচনা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে। জবাবে কী বলবেন?
জুরি বোর্ডে যারা ছিলেন তারা কি আমার কথা শুনবে? তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মহোদয় কিংবা মুশফিকুর রহমান গুলজার বা রিয়াজ ভাই কি আমার কথা শুনবে? ওখানে এফডিসির প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের এমডি স্যার ছিলেন। ওনাকে কি প্রভাবিত করার ক্ষমতা আমার আছে? আমি তো ওনার অধীনস্থ কর্মচারী। আর সমালোচকরা সমালোচনা করবেই। এধরণের সমালোচনা আসলে অমূলক।
‘রোহিঙ্গা’ ছবির একজন অভিনেতা দাবি করেছেন তিনি ছবিটির শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন, আপনি নন। এ অভিযোগের জবাব কীভাবে দিবেন?
এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। উনি ছবিটির একজন অভিনেতা। শিল্প নির্দেশক নন। উনি একটা সেট বানানো সময় শুধু একবার মিস্ত্রিদের কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, এ এটা এরকম কর, ওটা এখানে ওখানো রাখো। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওই সেটটি আমরা ব্যবহারই করিনি। আর এ ছবির প্রথম দিন থেকে এফডিসি থেকে শুরু করে সব জায়গায় শিল্প নির্দেশক হিসেবে আমি এনলিস্টেড, আমি ডিজাইন করলাম। উনি আমার সহকারীও ছিলেন না, এমনকি সেট মিস্ত্রিও নন, তাহলে কেনো এমন হাস্যকর দাবি করলেন তা বুঝলাম না। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে বাংলাদেশ অংশের শুটিংয়ের সময় সেট নির্মাণে আমি সহায়তা করেছি। তাই বলে কি আমি বলতে পারবো আমি ওই ছবির শিল্প নির্দেশক? আপনারা পরিচালক বা কলাকুশলীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন আমি কাজ করেছি কিনা?
এ অর্জনটি কাকে উৎসর্গ করতে চান?
প্রয়াত সহকর্মী কলমতর ভাই ও বাবা-মাকে। আমার বাবা-মা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে খুব খুশি হতো।
নতুন আর কোনো ছবিতে কি কাজ করছেন?
লুবনা শারমিন পরিচালিত সরকারি অনুদানের শিশুতোষ ছবি ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’। এটি নির্মিত হচ্ছে শাহরিয়ার কবিরের গল্প অবলম্বনে। ছবিটি। সামনে সেন্সর হবে। এফডিসির প্রযোজনায় জাকির হোসেন রাজুর পরিচালনায় ‘চাদর’। এটিতে আমি ও রহমত উল্লাহ বাসুর সঙ্গে যৌথভাবে শিল্প নির্দেশনা দিয়েছে। এটাও সেন্সরের অপেক্ষায় রয়েছে।
সারাবাংলা/এজেডএস
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রোহিঙ্গা শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক হিমাদ্রি বড়ুয়া