Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একুশে ফেব্রুয়ারির সেই অমর গানগুলো

এন্টারটেইনমেন্ট করেসপনডেন্ট
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:১২

একুশে ফেব্রুয়ারি— বলা যায় এই দিনেই বাঙালি জাতি সব ধরনের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে প্রথমবারের মতো নিজের আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছিল রাজপথের আন্দোলন, যা ছিল স্বাধিকারের লড়াইয়ের সূচনা। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনই এই জাতিকে শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে নিজের দেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। আর একুশের সেই মাতৃভাষাকে রক্ষার চেতনাই এ দেশের মানুষকে পৃথিবীর বুকে বাঙালি হিসেবে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা।

বিজ্ঞাপন

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…’— এই গানে যেন মিশে আছে বাঙালির সবটুকু আবেগ। তাই এই দিনে শহিদ মিনার থেকে শুরু করে সব জায়গায় বেজে ওঠে একুশের অমর এই সংগীত। এই গানটির পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের আগে-পরে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান। আন্দোলনে প্রেরণা যোগাতে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের কবি সাতিহ্যিক এবং সঙ্গীতজ্ঞসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব শ্রেণির ব্যক্তিত্বরা। অমর একুশের মর্মান্তিক ঘটনা দেশের প্রধান প্রধান কবি ও গীতিকারদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল, দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আউল-বাউল, স্বভাবকবি, গ্রামীণ বয়াতি ও কবিয়ালদেরও একইভাবে আলোড়িত করেছিল। তার মধ্যে কিছু গান অমর হয়ে আজও বাঙালির মুখে মুখে সুর তোলে, হৃদয়ে জাগায় শিহরণ…

বিজ্ঞাপন

ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি
‘ভুলবো না ভুলবো না
ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি
ভুলবো না…
লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস
মিলিটারি আর মিলিটারি
ভুলবো না। ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
এই দাবিতে ধর্মঘট
বরকত সালামের
খুনে লাল ঢাকার রাজপথ’

ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের লেখা এই গানটি অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৩-৫৫ সাল পর্যন্ত একুশের প্রভাতফেরীতে গাওয়া হতো শীর্ষস্থানীয় ভাষাসংগ্রামীর এই গানটিই। এই গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন গাজীউল হকের ছোটভাই নিজাম উল হক।

আমার ভায়ের ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনা দেশের রক্ত রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি। ’

সেদিনের সেই আগুন ঝরা দিনেই কালজয়ী এই গানটি লিখেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্রথমে সুর দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরটিই কেড়ে নেয়া সবার মনপ্রাণ। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরীতে প্রথমবারের মতো আলতাফ মাহমুদের সুরের গানটিই গাওয়া হয়। এরপর তা হয়ে যায় ইতিহাস।

৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত অমর ২১শে ফেব্রুয়ারীর গানটি শুরুতে লেখা হয়েছিল কবিতা হিসেবে। সেটি ছিল ৩০ লাইনের। পরবর্তীতে এই কবিতার প্রথম ছয়টি লাইনই গান হিসেবে গাওয়া হয়।

প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে আগে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি
তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।
মা-ও কান্দে, বাপ-ও কান্দে, কান্দে জোড়ের ভাই
বন্ধু বান্ধব কাইন্দা কয়, হায়রে খেলার সাথী নাই
ও বাঙালি…’

একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার পর গ্রামীণ গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ রচনা করেছিলেন একটি মর্মস্পর্শী গান যেটি পল্লীগীতির সুরে সুরারোপিত হয়। গানটি শুনলে মনে হয় চোখের সামনেই যেন চাক্ষুষ দেখতে পারছি শহীদদের আত্মদান। তখন মনে হয় শহীদের এই বলিদান বৃথা যায়নি।

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়। ।
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে। ।
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়। ।
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়। ।
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
কও দেহি ভাই…’

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা গীতিকার এবং সুরকার, যিনি ছিলেন একুশের গানের প্রথম সুরকার, আব্দুল লতিফের (১৯২৭-২০০৫) লেখায় উঠে আসে মাতৃভাষার জন্য এক দীর্ঘ প্রাণবন্ত গান। জারির সুরের খুব সহজ ভাষায় এই গান যেন হৃদয়ের কথা বলে। প্রত্যেকটা মানুষের মনে যেন এই গান বাজে। আব্দুল লতিফের এই জারিতে বাংলার নানা ঐতিহ্য, নিসর্গ, সংস্কৃতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এ জারি হয়ে উঠেছে গণমানুষের অভিব্যক্তি। ভাষা আন্দোলনের গানের এই সার্বজনীন রূপ উত্তরকালে ছড়িয়ে যায় সবার মাঝে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, বাঙালিকে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।

সালাম সালাম হাজার সালাম
‘সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে। ।
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণ…’

ফজল-এ-খোদা রচিত শিল্পী আব্দুল জব্বারের সুরারোপিত ও তারই কণ্ঠের এই গান আজ প্রায় চার দশক ধরে শ্রোতাদের হৃদয় সিক্ত করছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে গানটি ব্যপকভাবে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর থেকে গানটি বেশি প্রচারিত হলেও মূলত ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণেই এই গান রচিত হয়। ২০০৬ সালে বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতা মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে ১২তম অবস্থানে অর্ন্তভূক্ত হয় গানটি। শহীদ স্মরণে এ গানের আবেদন কখনো ম্লান হবার নয়।

ভাষার প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ, আন্তরিকতা এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়ের ভাষার প্রতি আকুতির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের এই অমর একুশ। ভাষার জন্য অকুতোভায় বাঙালি কী করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের বদৌলতে এই দিনটি আমরা ভাগ করে নিয়েছি পুরো বিশ্বের সাথে।

সারাবাংলা/এজেডএস

একুশে ফেবুয়ারির গান