শিল্পকলা আইনের সংশোধনীর খসড়ায় নেই ‘চলচ্চিত্র’
৬ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৪১
ঢাকা: ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯’ সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। জনসাধারণের অভিমতের জন্য আইনটির খসড়া এরই মধ্যে একাডেমির ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী নিয়ে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অভিমত দেওয়া যাবে। জানা গেছে, প্রকাশিত খসড়া বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ’ থেকে ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ বাদ দেওয়া। আর বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীরা।
তাদের দাবি, যেখানে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিচর্চার জন্য যেখানে শিল্পকলা একাডেমিতে শুধু ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা প্রয়োজন, সেখানে চলচ্চিত্রকেই মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এটি বাদ দিলে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার হোঁচট খাবে। আর শিল্পকলা একাডেমির কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা চলচ্চিত্র অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু এখানকার চলচ্চিত্র বিভাগটি খুবই ছোট। আর এতে বরাদ্দও কম, যা দিয়ে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র বিভাগের কথা চিন্তাই করা যায় না। সেজন্য এটি বাদ দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ যেসব সংশোধনী আনা হচ্ছে আইনে
নতুন আইনটি ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ নামে অভিহিত হবে। ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯’-এর যেসব ধারা-উপধারায় ‘একাডেমী’ শব্দটি রয়েছে সেখানে ‘একাডেমি’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হবে।
বাংলা একাডেমির মতো শিল্পকলা একাডেমির প্রধান হবেন ‘সভাপতি’। প্রথিতযশা শিল্পী, শিক্ষাবিদ, প্রাজ্ঞজন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অথবা স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদক বা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দুই বছরের জন্য এই পদে অধিষ্ঠিত হবেন।
একাডেমির পরিচালনা ও প্রশাসনের দায়িত্ব আগের মতো পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকলেও আগের মতো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এর সভাপতি হবেন না। একাডেমির সভাপতিই হবেন পরিষদের সভাপতি।
আগের ছয়টি বিভাগ ভেঙে নয়টি বিভাগ প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে─ ১. দৃশ্যশিল্প বিভাগ, ২. আলোকচিত্র বিভাগ, ৩. নাট্য বিভাগ, ৪. সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগ, ৫. প্রশিক্ষণ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ, ৬. গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ৭. প্রযোজনা ও মিডিয়া বিভাগ, ৮. প্রশাসন বিভাগ ও ৯. অর্থ ও হিসাব বিভাগ।
খসড়া আইনে আগের আইনের ধারা ৪ প্রতিস্থাপিত হয়েছে ৪ (ক), ৪ (খ) দিয়ে। এছাড়া প্রতিস্থাপিত হয়েছে ধারা ৫, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৫, ১৬। ধারা ৭ এর পরে ধারা ৭ (ক), ধারা ১৯ এর পর ১৯ (ক), ১৯ (খ) সন্নিবেশ করা হয়েছে। সংশোধন করা হয়েছে ধারা ৯।
যা বলছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন সারাবাংলাকে বলেন, “শিল্পকলা একাডেমির বিদ্যমান বিভাগগুলোর মধ্যে ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভাগ’ রয়েছে। এই বিভাগের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখানে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিচর্চার পরিসর ও পরিবেশকে আরও সংহত এবং শক্তিশালী করার জন্য বিগত সময়ে আমরা ধারাবাহিকভাবে দাবি জানিয়ে এসেছি যে, একাডেমিতে একটি স্বতন্ত্র ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করা হোক। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় চলচ্চিত্রকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এই অপচেষ্টার প্রতিবাদ জানাই।
শিল্লকলা থেকে নির্মাতা হয়েছেন খন্দকার সুমন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শিল্পকলার আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব, প্রদর্শনী ও সেমিনার থেকে আমার মতো অসংখ্য নির্মাতা তৈরি হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি ঘিরে আমাদের দেশে যে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তার সক্ষমতা আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।’
সুমন আরও বলেন, ‘আমরা আগে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে শিল্পকলার কাছ থেকে ভাড়া থেকে শুরু করে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা পেতাম। সংশোধনীতে চলচ্চিত্র বিভাগ বাদ গেলে এইসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বড়ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
শিল্পকলা একাডেমির কর্তা ব্যক্তিরা যা বলছেন
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ খসড়ায় ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ বাদ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। আধুনিক ‘এআই প্রযুক্তি’ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা চলচ্চিত্র অধিদফতর থাকার কথাও তিনি উল্লেখ করেন যুক্তিতে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ যেটা আছে সেটা মূলত অনুবিভাগ। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তাদের চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামো থেকে শুরু করে বিভাগটি পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ মানবসম্পদ লাগবে, আর যে পরিমাণ টাকা লাগবে, তার পরিমাণ অনেক।’
তিনি বলেন, ‘এআই, ডিআই, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি- এ ধরনের কাজ কম হচ্ছে বাংলাদেশে। সেসব কাজগুলো যদি আমরা পরিচর্যা করতে পারি, সেই টাকাটা যদি এখানে বিনিয়োগ করি তাহলে ভালো হবে। নতুন ধরনের প্রযুক্তি নির্ভর অবকাঠামো যদি গড়ে তুলি তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে অনেক লাভ হবে।’
‘চলচ্চিত্রের জন্য অনেক বিকল্প রাস্তা আছে’ উল্লেখ করে সৈয়দ জামিল বলেন, ‘সিনেমার জন্য থাকলেও নাটক ও মূকাভিনয়ের জন্য বিকল্প রাস্তা নেই। চলচ্চিত্র যতটা রাষ্ট্রীয়ভাবে সুবিধা পায়, অন্য জায়গাগুলো ততটা পায় না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদফতর ও ইনস্টিটিউট আছে চলচ্চিত্রের। তাদের আর্কাইভ ও অনুদানের ব্যবস্থাও আছে। এছাড়া এফডিসির মতো একটা জায়গা আছে। চলচ্চিত্রের জন্য অবকাঠাবোগত যে সুবিধা সরকার ও জনগণ ভোগ করে সেটা কিন্তু অন্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করা হয়।’
‘সকলের মতামতের জন্য আইনটির সংশোধনী খসড়া ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করেছি। এরই মধ্যে আমরা অনেকগুলো মতামত পেয়েছি। আগামী ১৩/১৪ নভেম্বর একাডেমির পরিষদ মিটিং আছে। সেখানে এসব মতামতসহ বিস্তারিত আলাপ হবে’─ বলেন সৈয়দ জামিল।
শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির সারাবাংলাকে বলেন, ‘খসড়াটি পরিষদে চূড়ান্ত হওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এর পর আইন মন্ত্রণালয় হয়ে সংসদে যাবে। সেখান থেকে এটি পাস হয়ে আসতে হবে। তবে মহাপরিচালক বলেছেন, চাইলে অধ্যাদেশের মাধ্যমেও কার্যকর করা যাবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গঠিত হয়। এর ১৫ বছর পর ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯’ পাস হয়। তখন থেকে এই আইনেই চলছিল বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনের শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানটি।
সারাবাংলা/এজেডএস/পিটিএম