তারামন বিবি – যে তারা কখনও নেভার নয় (শেষ পর্ব)
৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:০১
রেহমান মোস্তাফিজ ।।
এভাবেই দশগরিয়ার ক্যাম্পে দিন কাটছিল তারামন বিবির। কখনো সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বা কখনো পাগল সেজে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গিয়ে খবরাখবর আনতেন তিনি।
একদিন মুহিব হালদার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সবাইকে নিয়ে আসেন কেতনতারিতে। পাকবাহিনী ততদিনে বিমান হামলা শুরু করে দিয়েছে। আকাশ থেকে বিশাল বিশাল বিমান ১০-১২ টা করে বোমা মেরে চলে যায়। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে থাকার জায়গাটুকুও নাই অনেকের। মুক্তিযোদ্ধাদেরও রাত কাটানোর আর অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ নিরাপদে রাখার জায়গা নাই। তখন আজিজ মাস্টার একদিন নির্দেশ দেন বাঙ্কার বানানোর। এক রাতের মধ্যেই তারামন বিবিসহ বাকিরা মাটি কেটে ১৫ ফুট বাই ১২ ফুটের একটা বাঙ্কার বানিয়ে ফেলেন।
দিনের আলোতে সেখানেই লুকিয়ে থাকতে হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের। বিমান থেকে প্রতিদন শেলিং হয়। শেলিং এর শব্দে বাঙ্কারের মাটি ধ্বসে যেতে থাকে তবুও সেখানেই লুকিয়ে থাকা লাগে৷ এভাবেই চলছিল।
১০-১৫ দিন পরের কথা। তখন আগ্রহায়ণ মাস চলছে৷ একদিন দুপুরের দিকে একটা বিমান আসে। বিমানটা দেখতে একটু অন্যরকম। গায়ে আবার পতাকা লাগানো। তারামন বিবিরা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তারামন বিবি মনে মনে ঠিক করেন, যাই হোক না কেন গুলি ছুঁড়বে। গুলি ছোঁড়ার প্রস্তুতিও নেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মহিব হালদার বাঁধা দেন। বিমানটা মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
তারপর রেডিওতে শোনা যায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তারামন বিবি মনে করতে পারেন না ঘোষণাটা শুনে তার কেমন লাগছিল তখন। শুধু মনে আছে খবরটা শুনে দুই চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা বইতে শুরু করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর তারামন বিবি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। খুঁজে বের করেন বাবা-মা কে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে আসলেও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। না ছে থাকার কোন জায়গা না জোটে পেটপুরে খাবার। শেষে চরেই বাসা বাঁধে তারা। কিন্তু তারামন বিবির স্বপ্ন পূরণ হয় না। বাকি চার বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও তাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। সবাই বলে ‘মেয়ে ভাল না, চরিত্র খারাপ। ক্যাম্পে থাকা মেয়ে।’
তারামন বিবি তাই মেনে নিয়ে বিয়ের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেন। কিন্তু একদিন আবদুল মজিদ নামের একজন তার মা কে তারামন বিবিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তারামন বিবির মায়ের মেনে না ছাড়া উপায় ছিল না। ১৯৭৫ সালে এক টাকার দেনমোহরে তারামন বিবির বিয়ে হয়। চরেই ঘর বাঁধে তারা। চরের পাড় ভাঙে সেইসাথে তাদের বাড়িও ভেঙে যায়। আবারো নতুন করে বাড়ি করে আবারও চর ভাঙে। এভাবেই ভাঙা গড়ার খেলায় কেটেছে বাকিটা জীবন।
মাঝে আনন্দের ঘটনা বলতে ১৯৭৩ সালে তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। কিন্তু তারামন বিবির আর খোঁজ নেয়না কেউ। না রাষ্ট্র, না সাধারণ জনগণ, না মিডিয়া। অসম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেও লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান তারামন বিবিরা।
১৯৯৫ সাল। ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম খুঁজে বের করেন তারামন বিবিকে। তারামন বিবি তখন দারিদ্রতার চাপে পিষ্ট এক গ্রাম্য রমনী। বিমল কান্তি দেই প্রথম তারামন বিবি আর তার সাহসিকতার কাহিনী উন্মোচন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টের সরকারি লোকজন আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির খোঁজে। ইন্টারভিউ নেওয়া হয় তার। উনি যে মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমান সংগ্রহ করার প্রয়োজনে ঢাকায় ফিরে যায় দলটা। আকাশ প্রতিদিন কত তারা ঝরে পড়ে তার হিসেব কতজনই বা রাখে। সাধারণ বাঙালি কিশোরি তারামন বিবির অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার ইতিহাসও কি তবে ঢাকা পড়ে যাবে?
না সব তারা অজান্তেই ঝরে পড়ে না। কোন কোন তারা নিজেরা আলোকিত হয়ে উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান। এমনই একজন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অসম সাহসী যোদ্ধা তারামন বিবি। ক্ষণজন্মা এই নারীর জন্মই হয়েছিল যুগের পর যুগ আলো ছড়াতে।
সরকারি লোকজন ঢাকায় ফেরার বিমল কান্তি তারামন বিবিকে সাহস দেন। বলেন, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা, আপনাকে এই দেশ স্বীকৃতি দেবেই। তবে এর আগে চিহ্নিত করতে হবে এই যা।’ এসব শুনে কষ্ট পান তারামন তবুও চুপচাপ সহ্য করে যান। এরপর ঢাকায় কিছু সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। প্রেসক্লাবে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয় তারামন বিবিকে। জানতে চাওয়া হয় তিনি ধর্ষিত হয়েছিলেন কিনা। একজন নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে এটা যেন অনেকের চিন্তারও বাইরের। কিন্তু দমে না গিয়ে চুপচাপ সবকিছুর জবাব দেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।
পরবর্তীতে প্রেসক্লাবের সেই প্রশ্নোত্তর নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিনের প্রশ্নবানে তিনি বিব্রত, লজ্জিত ও অপমানিত হয়েছিলেন। তবুও তিনি সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছেন এই ভেবে যে এই ইতিহাসের সঠিক তথ্য মানুষের জানা প্রয়োজন। উনি মুক্তিযোদ্ধা এ তথ্য সঠিক হওয়া প্রয়োজন বলে। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বীরপ্রতীক তারামন বিবিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অবশেষে প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলেন বীর যোদ্ধা।
এরপর ধীরে ধীরে সুদিনের দেখা মিলতে থাকে তারামন বিবির। তাকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক লেখেন ‘বীরপ্রতীকের খোঁজে’। আনিসুল হকের লেখা বাংলা নাটক ‘করিমন বেওয়া’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন তারামন বিবি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার মেয়ের জামাইয়ের হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হিসেবে চাকরি হয়। সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর এলাকার বিচার শালিসেও তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতে থাকে।
সারাজীবন কষ্ট ভোগের পর অবশেষে জীবনের এই অংশটাকে উপভোগও করছিলেন শেষ দশ বছর ধরে। দিনগুলো নাতী আশীষ নিয়ে আর বিচার শালিস নিয়ে ব্যস্ততায় কাটছিল বেশ। শেষ দুই-তিন বছর ধরেই শরীরটা বিদ্রোহ করছিল বেশ। প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট ছিল। এবছরের শুরুতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল কয়েকবার। সেসময় নিজের শেষ ইচ্ছে হিসেবে বলেছিলেন ‘অনেক দিন ধইরা বুকের ব্যথা আর শ্বাসকষ্টে ভুগতাছি। মধ্যে মধ্যে শ্বাসকষ্ট এত বাইরা যায় গা যে, মনে হয় আর বাঁচুম না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ সরকার আমারে অনেক কিছু দিছে। আর কিছু চামু না। মরণের আগে একটাই এহন চামু। যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধে গেলাম সেই বঙ্গবন্ধু কন্যারে আরেকবার না দেইখা মরলে শান্তি পামু না। আমার এহন শেষ ইচ্ছা শেখ হাসিনারে আরেক নজর দেইখা শান্তিতে মরতে চাই।’
অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন এ মাসের শুরুর দিকেই। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে পরবর্তীতে ময়মনসিংহ সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানেও কাজ না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে পারায় আবার নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখানেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশ মাতার জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া সাহসী এই নারী।
তারামন বিবি সেই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন যারা চিরকালই অর্থ, সম্পদ, জমিন ও উপর্যুক্ত জীবিকা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। অথচ শুধুমাত্র মাটির টানে ও হৃদয়ের সততা থেকে দেশের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গেছেন পদে পদে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি কায়মনবাক্যে স্বদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গল ছাড়া কিছু চান নি। বর্তমানে প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধে প্রতি অনীহা বা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে অসীম ক্ষমতা দেখে বা তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার চেষ্টায় বলেছিলেন ‘এই দ্যাশ বানের জলে ভাইসা আসে নাই।’
কত কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা তরুন প্রজন্মকে সেটা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন ‘আমার যে সন্তানরে আমি মানুষ করছি, দশ মাস দশ দিন প্যাটে রাখছি। তারপর এই সন্তানদের বড় করতি অনেক কষ্ট লাগছে। তার চেয়ে ত্যাগুন কষ্ট আমাদের এই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে আমার লাগছে।’
তারামন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম শ্রদ্ধার আসনে থেকে যাবেন আরেকটা কারনে। স্বাধীনতার পর প্রথম গেজেটে খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মাত্র দুজন। প্রথম নামটা ছিল ডক্টর সেতারা বেগম আর অন্য নামটা ছিল তারামন বিবির। এদের মাঝে তারামন বিবি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন।
তার গেজেট নামঃ মোছাম্মদ তারামন বেগম
গেজেট নাম্বারঃ ৩৯৪
প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ তারামন বিবি- যে তারা কখনও নেভার নয়
সারাবাংলা/আরএফ