শান্ত দুপুর। গলির মাথায় রোদ পড়েছে সোনালি হয়ে। এক কোণে পুরোনো একটা টিনের ঘরের সামনে হাসনাহেনা গাছটা যেন বাতাসে একটু একটু দুলছে। ওর পাশেই বসে আছে হাসনা নামে মেয়েটি। হাতে একটা পেঁচানো ওড়না, চোখে হারিয়ে যাওয়া বিকেলের ছায়া।
হাসনা কারও কাছে প্রেমিকা নয়, কারও মনের মানুষও নয়। সে একজন যৌনকর্মী। কিন্তু তার পরিচয় কি কেবল এটুকুই? প্রশ্নটা যাই হোক। হাসনার উত্তরটা ছিলো খুব স্বাভাবিক স্বরে,
‘হাসনাহেনা গাছটা আমি নিজের হাতে লাগাইছি। সকালে একবার জল না দিলে মনটা খালি খালি লাগে।’
ওর কথা শুনেই মনে হলো, ও যেন বলতে চাইছে, ‘আমিও একজন মানুষ, আর পাঁচজনের মতো।’
কষ্টগুলো ধুয়ে যায় না সহজে _
ছোটবেলা কেটেছে ফরিদপুরে। স্কুলে যেত, হাসত, দৌড়াত। একদিন বাবার মৃত্যুর পর সব বদলে গেল। অভাব, কাজের খোঁজ, শেষে শহরে আসা। একটা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু বাঁচতে চাওয়া মায়ের চিকিৎসা আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেনি।
হাসনা চোখ নামিয়ে বলল ‘এই কাজ আমি বেছে নিইনি। এই কাজ আমাকে বেছে নিয়েছিল।’
তার গলায় কোনো অভিমান নেই, কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস যেন প্রতিটি শব্দের ফাঁকে ফাঁকে বাজে।
দিন আসে, রাত নামে _
হাসনার দিনগুলো খুব সাধারণ—যেমনটা হয় একজন মায়ের, একজন মানুষের। সকালে বাজার করা, কাপড় ধোয়া, দুপুরে রান্না। এরপর… সন্ধ্যার পরই তার জীবনের অন্য পাতা খুলে যায়। যে পাতায়, অন্য মানুষগুলোর জীবনের কথা লেখা নেই। তার মতো কয়েকজন হাসনার জীবন জড়িয়ে থাকে। হাসনা বলেন, ‘রাতের কাজ করাটা এখন জীবনের একটা অংশ। এখন মাঝে মাঝে গল্প বলি পাড়ার মেয়েদের, কিভাবে এই জীবন থেকে দূরে থাকা যায়’, সে বলল হাসিমুখে।
আমার একটা ছোট মেয়ে আছে—সুমনা। স্কুলে যায়, ছবি আঁকে, মাঝে মাঝে আমাকে বলে, ‘তুমি আমার বান্ধবী’। সেই শব্দটা বলার সময়, হাসনার মুখে যে আলোর রেখা দেখা যায়, তা কোনো রঙে আঁকা যায় না।
হাসনা স্বপ্ন দেখে—সুমনা একদিন বড় হবে, নিজের চায়ে দোকান খুলবে, হয়তো কাউকে ভালোবাসবে, আর কেউ যেন তাকে কখনো ছোট না করে।
হাসনাহেনা গাছটা এখনো বাতাসে দুলছে। হাসনা এবার উঠে দাঁড়ায়, একটু জল ছিটায় গাছের গোড়ায়। এই একটা ছোট্ট কাজেই যেন তার নিজস্ব এক জীবনের ছাপ আছে—একটা পরিচয়, যেখানে সে কেবল শরীর নয়, একজন মানুষ।
এতোক্ষণ যে হাসনার গল্প বলছিলাম। সে মোহম্মদপুরের বসবাস করা একটি যৌনপল্লীর নারী। এবার হাসনা এবার আমাকেই প্রশ্ন করে উঠলো-
‘আমি ট্যাক্স দিই, বাসাভাড়া দিই, সন্তান পড়াই—তবু কেউ বলে না, আমি একজন শ্রমিক। আমি কি শ্রমিক না?’
তারা অন্ধকারেই হারিয়ে যায় _
হাসনার জবাব না দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নিজের কর্মব্যস্ততায়। যেখানে ব্যস্ত ঢাকা। রিকশার ঘণ্টা, হাঁটার শব্দ, ফুটপাথে তাড়া। এ সব কিছুর মাঝেও কেউ কেউ রয়ে যায় আড়ালে—তারা আছে, অথচ নেই। তাদের পেশা নেই, পরিচয় নেই। কেবল একরাশ সংকোচ আর সমাজের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া দৃষ্টি। এই যৌনকর্মীদের নিয়ে সমাজ চুপ, অথচ সমাজেই তারা বেঁচে থাকে।
ছায়ার ভেতরের মানুষগুলো _
বাংলাদেশে আনুমানিক এক লাখের বেশি যৌনকর্মী আছেন। তারা আমাদের শহরেরই বাসিন্দা, আমাদের মতোই নাগরিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাগজে, পেশার তালিকায়, মর্যাদার মানচিত্রে তাদের জায়গা এখনো নিশ্চিত নয়।
তাদের জীবিকা হয়তো সমাজের চোখে বিতর্কিত। কিন্তু আবার অনেক মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়। আইনত বাংলাদেশে যৌনকর্মী হওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু পেশাগত স্বীকৃতির অভাবে তারা রয়ে গেছেন এক অদৃশ্য সীমার ভেতরে।
স্বীকৃতি মানে কি বৈধতা, না মর্যাদা?
যৌনকর্মীরা আইনত প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের নেই কোনো শ্রমিক পরিচয়, নেই সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো। রোগ হলে চিকিৎসা মেলে না ঠিকঠাক, শিশুরা স্কুলে যেতে গেলে পরিচয়ে বাধে সংকট, আর পুলিশি হয়রানি তো নিত্যসঙ্গী।
এই পরিস্থিতিতে ‘পেশা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মানে কেবল কাজকে বৈধ করা নয়—এটি একটি সম্মানের কাঠামো গড়ে দেওয়া, যেখানে একজন নারী তার জীবনের পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পান, এবং সেই পথের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা পান।
কিছু পরিবর্তনের গল্প _
সাম্প্রতিক সময়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন থেকে, যৌণকর্মীদের পেশাকে স্বীকৃতি জানানোর দাবি তোলা হয়েছে। আবার ধর্মীয় দলগুলো থেকে এসেছে বাধা । শেষমেষ কোথায় গিয়ে এই স্বীকৃতি দাবির সমাপ্তি ঘটে, তা জানা নেই।
এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু এনজিও, মানবাধিকার সংগঠন এবং নারী অধিকার কর্মীরা যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছেন। স্বাস্থ্যসেবা, বিকল্প জীবিকা, আইনি সহায়তা—এসব কিছু পাওয়া যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘যৌনকর্মী’ পেশাকে শ্রমের স্বীকৃতি দেওয়া এখনো অনেক দূরের পথ। এই স্বীকৃতি না থাকায় তারা বঞ্চিত থাকেন শ্রম আইন, স্বাস্থ্য বীমা, নিরাপত্তা কিংবা অবসরের সুযোগ থেকে।
সমাজ কি শুধু বিচার করে?
যৌনকর্মীরা কারো মা, কারো বোন, কারো প্রতিবেশী। তারা এই সমাজের প্রান্তিক সত্য। স্বীকৃতি মানে তাদের কাজের প্রশংসা নয়, বরং কাজটি যে বাস্তবতা—তা মেনে নেওয়া। সমাজের ভেতরে থাকা এই অদৃশ্য শ্রমিকদের পরিচয় দিলে, তাদের প্রতি সহানুভূতি জন্মায় না শুধু—জন্মায় ন্যায্যতা।
পরিশেষে _
প্রতিটি পেশার পেছনে থাকে জীবন টিকিয়ে রাখার এক সংগ্রাম। যৌনকর্মীরাও সেই সংগ্রামে লড়ছেন প্রতিদিন। যদি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাদের জীবনের প্রতি সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে হয়তো একদিন হাসনাহেনা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাসনা বলবেন—’হ্যাঁ, আমি কাজ করি। আমার পেশার নাম আছে।’
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডটনেট